খোলা হাওয়া-এসএসসি পরীক্ষার ফল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
গত কয়েক দিনে দেশের শিক্ষাচিত্রে যোগ হয়েছে বড় দুটি ঘটনা। এর একটি হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, অন্যটি বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি এবং সে-সম্পর্কিত বিতর্ক। দুটি ঘটনারই ভালোমন্দ আছে, তবে মন্দের অনুপাতে ভালোর পরিমাণটা বেশি এবং তা নিয়ে আমরা আশান্বিত হতে পারি।
একই সঙ্গে মন্দ দিকগুলোর দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে, যাতে এগুলোর পুনরাবৃত্তি যতটা সম্ভব কমানো যায় এবং একসময় পুনরাবৃত্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আমরা সবাই বিশ্বাস করি, শিক্ষা হচ্ছে সেই শক্তি, যা জাতি হিসেবে এই শতাব্দীর পথ ধরে উন্নত দেশগুলোর মিছিলে আমাদের শামিল হতে সাহায্য করবে। শিক্ষা নিয়ে হেলাফেলা আত্মঘাতী প্রমাণিত হবে। আমাদের মধ্যে এ রকম আত্মঘাতী প্রবণতা আবার মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই প্রবণতাকেও রুখতে হবে।
প্রথমেই ভালোর কথাগুলো বলি। এসএসসি পরীক্ষায় সারা দেশে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাফল্য পেয়েছে, জিপিএ প্লাস প্রাপ্তির সংখ্যা বেড়েছে। সবগুলো বোর্ডেরই তারকাচিহ্নিত স্কুলগুলোর বাইরেও নতুন তারকা-স্কুলের জন্ম হচ্ছে। দুই হাজার ৯২৭টি স্কুলের সবাই পাস করেছে। টেলিভিশনের সংবাদে দেখলাম, স্কুলে স্কুলে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা আনন্দ উল্লাস করছে। ঢাকার মগবাজারের এক মিষ্টির দোকানমালিক জানালেন, ফল প্রকাশের দিন বিকেলের মধ্যে তাঁর দোকানের সব মিষ্টি বিক্রি হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি ভালো যে আরেকটি সংবাদ তা হচ্ছে, এবারের পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে, নকলের ঘটনা কমেছে—অন্তত নকলের অভিযোগে শিক্ষার্থী এবং নকল সরবরাহ বা নকলে সহযোগিতা করার অপরাধে শিক্ষক বহিষ্কারের সংখ্যা এর প্রমাণ দেয়। এমপিওভুক্তির বিষয়টি অবশ্য আরেকটু জটিল, যেহেতু প্রতিযোগিতা অনুযায়ী অর্জনের অনুপাত এ ক্ষেত্রে অনেক কম। প্রায় সাত হাজার আবেদনপত্রের বিপরীতে এমপিওভুক্ত হয়েছে এক হাজার ২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারপরও, ২০০৪ সালের পর দীর্ঘ বিরতিতে এমপিওভুক্তির এই ঘটনা ঘটল এবং এই প্রথম একটি নীতিমালার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তি হলো। এই নীতিমালার চারটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হলো: প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার। শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, নীতিমালা শতভাগ মেনেই এসব প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি হয়েছে। সফল প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় স্থান পাওয়া এবং বাদ যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রচণ্ড বিতর্ক হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো লিখেছে, শিক্ষামন্ত্রী সহকর্মীদের ‘তোপের মুখে’ পড়েছেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীর ওপর নাখোশ হয়েছেন। শেষমেশ তালিকাটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের উত্তেজনা প্রশমিত করেছেন। না, এ বিষয়টি মোটেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তির ভালো দিকের অংশ নয়। এর উল্লেখ এ কারণে করেছি যে, এই বিবাদ-বিতর্ক বাদ দিলেও প্রক্রিয়াটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন রয়েছে। তা হলো, একটি সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে সরকারের কর্মকাণ্ডকে যে নিয়ে আসা যায় এবং ঘুষ লেনদেন ছাড়াও ঐতিহ্যগতভাবে ঘুষবান্ধব সরকারি কোনো প্রক্রিয়াকে যে নিষ্পন্ন করা যায়—এমপিওভুক্তির সাম্প্রতিক ওই ঘটনা তা প্রমাণ করেছে। তালিকাটি শেষ পর্যন্ত টিকবে কি টিকবে না, নীতিমালা জলে ফেলে মন্ত্রী-সাংসদদের দাবিমতো অন্যান্য স্কুলকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি হবে না, অথবা গায়ে বিএনপির গন্ধ লেগে থাকা স্কুল-কলেজগুলো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাদ দেওয়া হবে কি হবে না—সেসব প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্তির উদ্যোগটি ছিল ভালো এবং অন্যত্র অনুকরণযোগ্য। সরকারের একটি ভালো কাজে সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাংসদেরা যদি বাগড়া দেন, তা নিশ্চয়ই শেষ বিচারে আত্মঘাতী প্রমাণিত হবে, কিন্তু কাজটিকে, আরও নির্দিষ্টভাবে কাজের পেছনের নীতি-চিন্তাটিকে আমরা বাহবা দিই। কাগজে দেখেছি, ভুলত্রুটি ছিল তালিকায়, কোনো এলাকায় বেশি, কোনো এলাকায় কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তালিকায় স্থান পেয়েছে। তা হতেই পারে এবং এসব ত্রুটি সংশোধনের নিশ্চয়ই সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাবান অভিভাবকহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উন্নতির একটা সুযোগ এ রকম ভালো উদ্যোগ যে এনে দেবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
২.
এসএসসি পরীক্ষার মন্দ দিকগুলোর উল্লেখ করতে আমার ইচ্ছে হয় না। কেননা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আশাভঙ্গের কাহিনি। যারা ভালো করে, ফল বেরোনোর দিন তারা উল্লাস করে—কিন্তু যারা উত্তীর্ণ হতে পারে না, তারা কী করে? তারা সারা দিন বিমর্ষ থাকে, কাঁদে, গালমন্দ খায়, শূন্য চোখে পৃথিবীটাকে দেখে। নিজেদের অসামর্থ্য, দারিদ্র অথবা অমনোযোগকে দায়ী করে। কেউ কেউ অনেক বড় শাস্তি দেয় নিজেদের। সেসবের না হয় উল্লেখ না-ই করলাম। এই অকৃতকার্যদের জন্য আমার মনটা খুব খারাপ থাকে। এদের কথাও কেউ বলে না। অথবা অনেক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে যারা টেনেটুনে পাস করে, তাদের জন্যও কেউ কোনো সংবর্ধনার আয়োজন করে না। আজকাল শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়েছে। সচ্ছল পিতা-মাতারা চার থেকে ছয়জন শিক্ষক রেখে সন্তানদের পড়ান। সন্তানেরা গোল্ডেন জিপিএ না পেলে তাঁদের মুখে হাসি আসে না। আমার মনে হয়, আমরা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন থেকেও গোল্ডেন জিপিএ অর্জনকে অনেক বেশি মূল্য দিচ্ছি। যারা অকৃতকার্য, তাদের বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করছি। আমরা ‘এসএসসি পরীক্ষার্থী’দের বোধ-অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখছি না; তাদের আশা-নিরাশা, ভয়-পেরেশানি, কষ্ট-লজ্জা—এসব কিছুকেই বিবেচনায় না এনে শুধু তাদের ফল নিয়ে ভাবছি, তাদের সাফল্য-উদ্দিষ্ট যন্ত্র হিসেবে দেখছি। এটি সংগত কি না, আমাদের একটু ভাবতে হবে।
আমাদের উচিত হবে গ্রামের দিকে, সুবিধাবঞ্চিত স্কুলগুলোর দিকে তাকানো; আমাদের উচিত হবে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা যাতে নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তভাবে ভালো ফল নিয়ে এসএসসি পাস করতে পারে, তা নিশ্চিত করা এবং অকৃতকার্যদের সাফল্যের পথে নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের যথাযথ বাজেট থাকতে হবে। প্রয়োজনে অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমিয়ে স্কুলগুলোর জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। একবার কাগজে দেখেছিলাম, একটি গলফ কোর্সের পেছনে যত পয়সা খরচ হয় প্রতিবছর, তা দিয়ে পাঁচটি স্কুলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায়। গলফ কোর্সের জন্য যদি বরাদ্দ পাওয়া কঠিন না হয়, ওই পাঁচটি স্কুলের জন্য কেন হবে? অগ্রাধিকারের তালিকায় কোনটি ওপরে? দুস্থ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত সব শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি, বিনা মূল্যে শিক্ষা উপকরণ এবং টিফিনের ব্যবস্থা করতে হবে, একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করে ভালো শিক্ষকেরা যাতে গ্রামের স্কুলে পড়াতে যেতে উৎসাহী হন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি স্কুলে তিন মাসের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায়, যেখানে নিবিড় পঠনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের ঘাটতিগুলো পুষিয়ে নিতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি, কোনো শিক্ষার্থীই মৌলিকভাবে অক্ষম নয়। ক্ষমতা সবারই থাকে, শুধু তাকে জাগাতে হয়। এই জাগানোর কাজটা যাতে স্কুলগুলো প্রতি শ্রেণীতেই নিবিড়ভাবে করে, সে জন্য তাদের সহায়তা তহবিল এবং অন্যান্য সম্পদ দিতে হবে। সংবিধান সরকারকে এ রকম নির্দেশনাই দিচ্ছে। এটি অমান্য করা সরকারের উচিত হবে না।
এসএসএসসি পরীক্ষার ফল যেদিন বেরোয়, আমাকে কোনো না কোনো কাগজের রিপোর্টার দুটি প্রশ্ন করেন: ইংরেজির ফল খারাপ কেন হলো, এবার যদিও ইংরেজিতে সবাই ভালো করেছে এবং গ্রামের স্কুলের ফল খারাপ কেন? দুটি প্রশ্নের উত্তর আছে ওই এক জায়গায়, আমাদের মনোযোগের অভাব। ইংরেজি বিদেশি ভাষা, এটি রপ্ত করার জন্য যেসব পদ্ধতি-চর্চা-উপকরণ প্রয়োজন, আমাদের তার প্রায় কিছুই নেই। ইংরেজি শিক্ষা চলে মুখস্থ পদ্ধতিতে। ফলে প্রশ্ন যদি একটু এদিক-সেদিক হয়, তাহলে আর উপায় থাকে না। আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকি যে, ইংরেজি শিখতে হবে, তাহলে ভালো করে শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করে একই প্রশ্ন করে আমি যদি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ আর ধাদ্ধারা গোবিন্দপুর স্কুলের দুর্বল শিক্ষার্থী থেকে একই রকম ফল আশা করি, তা হবে একটা প্রহসন। অথচ ধাদ্ধারার শিক্ষার্থীর সেই অধিকার আছে ইংরেজির (বা যেকোনো বিষয়ে) ওই জ্ঞান লাভ করার, যা মির্জাপুরের শিক্ষার্থীটি পাচ্ছে। এর ব্যত্যয় সংবিধান স্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘনেরই শামিল।
৩.
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ) ভুক্তি নিয়ে যে বিতর্কের উল্লেখ আগে করেছি, সে প্রসঙ্গে ফিরে যাই। নিঃসন্দেহে একটি নীতিমালার ভিত্তিতে করা তালিকাটি বাদ দিয়ে নতুন তালিকা করাটা একটি বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে। যদি একটি নীতিমালা করাই হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সম্মান জানানো হলো না কেন? যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় তালিকা করতে হয়, তাহলে নীতিমালার কী দরকার ছিল? কাগজে পড়লাম, বিএনপি আমলে তৈরি স্কুল এমপিওভুক্ত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন এক মন্ত্রী। ওই মন্ত্রীর এলাকায় নিশ্চয় বিএনপির আমলে তৈরি একটি বা দুটি পুল আছে। তাহলে তো মন্ত্রীর এসব পুল ব্যবহার করা উচিত নয়। ঢাকার অনেক কাগজে দেখলাম শিক্ষামন্ত্রীকে ‘তোপের মুখে’ ফেলে তালিকা পুনর্বিবেচনার সমালোচনা হয়েছে। সংবাদ লিখেছে, ‘এমপি-মন্ত্রীদের অযৌক্তিক অভিযোগ-আবদারের কারণেই তালিকা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়’। ডেইলি স্টার লিখেছে তালিকাটি পর্যালোচনার নির্দেশ ছিল ‘তড়িঘড়ি করে দেওয়া’ এবং তা ‘দেশের শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খারাপ কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।’ সমকাল বলছে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিনামূল্যে ২০ কোটি বই প্রকাশ ও বিতরণে, একটি শিক্ষানীতির চূড়ান্তকরণে এবং ভালো ব্যবস্থাপনায় পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর ‘দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।’ আমারও বিশ্বাস, এমপিওভুক্তির কাজটি নুরুল ইসলাম নাহিদ সততার সঙ্গে এবং একটি নীতির আলোকে করেছিলেন। এর গঠনমূলক সংশোধনের পরিবর্তে এর প্রতি অনাস্থা দেখানোটা মন্ত্রী-সাংসদদের উচিত হয়নি।
তবে আমি আনন্দিত হব, যেদিন এমপিওভুক্তির জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আবেদন করতে হবে না, যেহেতু দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনমতো আর্থিক সহায়তা পাবে সরকার থেকে এবং সব শিক্ষক-সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দিনাদিপাত করতে পারবেন এবং উন্নত শিক্ষা দিতে পারবেন। তখন এসএসসির ফল প্রকাশের দিনগুলোও আর এত ব্যাপক গ্রাম-শহর, সচ্ছল-দরিদ্র বিভাজন নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথমেই ভালোর কথাগুলো বলি। এসএসসি পরীক্ষায় সারা দেশে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাফল্য পেয়েছে, জিপিএ প্লাস প্রাপ্তির সংখ্যা বেড়েছে। সবগুলো বোর্ডেরই তারকাচিহ্নিত স্কুলগুলোর বাইরেও নতুন তারকা-স্কুলের জন্ম হচ্ছে। দুই হাজার ৯২৭টি স্কুলের সবাই পাস করেছে। টেলিভিশনের সংবাদে দেখলাম, স্কুলে স্কুলে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা আনন্দ উল্লাস করছে। ঢাকার মগবাজারের এক মিষ্টির দোকানমালিক জানালেন, ফল প্রকাশের দিন বিকেলের মধ্যে তাঁর দোকানের সব মিষ্টি বিক্রি হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি ভালো যে আরেকটি সংবাদ তা হচ্ছে, এবারের পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে, নকলের ঘটনা কমেছে—অন্তত নকলের অভিযোগে শিক্ষার্থী এবং নকল সরবরাহ বা নকলে সহযোগিতা করার অপরাধে শিক্ষক বহিষ্কারের সংখ্যা এর প্রমাণ দেয়। এমপিওভুক্তির বিষয়টি অবশ্য আরেকটু জটিল, যেহেতু প্রতিযোগিতা অনুযায়ী অর্জনের অনুপাত এ ক্ষেত্রে অনেক কম। প্রায় সাত হাজার আবেদনপত্রের বিপরীতে এমপিওভুক্ত হয়েছে এক হাজার ২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারপরও, ২০০৪ সালের পর দীর্ঘ বিরতিতে এমপিওভুক্তির এই ঘটনা ঘটল এবং এই প্রথম একটি নীতিমালার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তি হলো। এই নীতিমালার চারটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হলো: প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার। শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, নীতিমালা শতভাগ মেনেই এসব প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি হয়েছে। সফল প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় স্থান পাওয়া এবং বাদ যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রচণ্ড বিতর্ক হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো লিখেছে, শিক্ষামন্ত্রী সহকর্মীদের ‘তোপের মুখে’ পড়েছেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীর ওপর নাখোশ হয়েছেন। শেষমেশ তালিকাটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের উত্তেজনা প্রশমিত করেছেন। না, এ বিষয়টি মোটেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তির ভালো দিকের অংশ নয়। এর উল্লেখ এ কারণে করেছি যে, এই বিবাদ-বিতর্ক বাদ দিলেও প্রক্রিয়াটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন রয়েছে। তা হলো, একটি সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে সরকারের কর্মকাণ্ডকে যে নিয়ে আসা যায় এবং ঘুষ লেনদেন ছাড়াও ঐতিহ্যগতভাবে ঘুষবান্ধব সরকারি কোনো প্রক্রিয়াকে যে নিষ্পন্ন করা যায়—এমপিওভুক্তির সাম্প্রতিক ওই ঘটনা তা প্রমাণ করেছে। তালিকাটি শেষ পর্যন্ত টিকবে কি টিকবে না, নীতিমালা জলে ফেলে মন্ত্রী-সাংসদদের দাবিমতো অন্যান্য স্কুলকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি হবে না, অথবা গায়ে বিএনপির গন্ধ লেগে থাকা স্কুল-কলেজগুলো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাদ দেওয়া হবে কি হবে না—সেসব প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্তির উদ্যোগটি ছিল ভালো এবং অন্যত্র অনুকরণযোগ্য। সরকারের একটি ভালো কাজে সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাংসদেরা যদি বাগড়া দেন, তা নিশ্চয়ই শেষ বিচারে আত্মঘাতী প্রমাণিত হবে, কিন্তু কাজটিকে, আরও নির্দিষ্টভাবে কাজের পেছনের নীতি-চিন্তাটিকে আমরা বাহবা দিই। কাগজে দেখেছি, ভুলত্রুটি ছিল তালিকায়, কোনো এলাকায় বেশি, কোনো এলাকায় কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তালিকায় স্থান পেয়েছে। তা হতেই পারে এবং এসব ত্রুটি সংশোধনের নিশ্চয়ই সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাবান অভিভাবকহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উন্নতির একটা সুযোগ এ রকম ভালো উদ্যোগ যে এনে দেবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
২.
এসএসসি পরীক্ষার মন্দ দিকগুলোর উল্লেখ করতে আমার ইচ্ছে হয় না। কেননা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আশাভঙ্গের কাহিনি। যারা ভালো করে, ফল বেরোনোর দিন তারা উল্লাস করে—কিন্তু যারা উত্তীর্ণ হতে পারে না, তারা কী করে? তারা সারা দিন বিমর্ষ থাকে, কাঁদে, গালমন্দ খায়, শূন্য চোখে পৃথিবীটাকে দেখে। নিজেদের অসামর্থ্য, দারিদ্র অথবা অমনোযোগকে দায়ী করে। কেউ কেউ অনেক বড় শাস্তি দেয় নিজেদের। সেসবের না হয় উল্লেখ না-ই করলাম। এই অকৃতকার্যদের জন্য আমার মনটা খুব খারাপ থাকে। এদের কথাও কেউ বলে না। অথবা অনেক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে যারা টেনেটুনে পাস করে, তাদের জন্যও কেউ কোনো সংবর্ধনার আয়োজন করে না। আজকাল শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়েছে। সচ্ছল পিতা-মাতারা চার থেকে ছয়জন শিক্ষক রেখে সন্তানদের পড়ান। সন্তানেরা গোল্ডেন জিপিএ না পেলে তাঁদের মুখে হাসি আসে না। আমার মনে হয়, আমরা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন থেকেও গোল্ডেন জিপিএ অর্জনকে অনেক বেশি মূল্য দিচ্ছি। যারা অকৃতকার্য, তাদের বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করছি। আমরা ‘এসএসসি পরীক্ষার্থী’দের বোধ-অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখছি না; তাদের আশা-নিরাশা, ভয়-পেরেশানি, কষ্ট-লজ্জা—এসব কিছুকেই বিবেচনায় না এনে শুধু তাদের ফল নিয়ে ভাবছি, তাদের সাফল্য-উদ্দিষ্ট যন্ত্র হিসেবে দেখছি। এটি সংগত কি না, আমাদের একটু ভাবতে হবে।
আমাদের উচিত হবে গ্রামের দিকে, সুবিধাবঞ্চিত স্কুলগুলোর দিকে তাকানো; আমাদের উচিত হবে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা যাতে নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তভাবে ভালো ফল নিয়ে এসএসসি পাস করতে পারে, তা নিশ্চিত করা এবং অকৃতকার্যদের সাফল্যের পথে নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের যথাযথ বাজেট থাকতে হবে। প্রয়োজনে অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমিয়ে স্কুলগুলোর জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। একবার কাগজে দেখেছিলাম, একটি গলফ কোর্সের পেছনে যত পয়সা খরচ হয় প্রতিবছর, তা দিয়ে পাঁচটি স্কুলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায়। গলফ কোর্সের জন্য যদি বরাদ্দ পাওয়া কঠিন না হয়, ওই পাঁচটি স্কুলের জন্য কেন হবে? অগ্রাধিকারের তালিকায় কোনটি ওপরে? দুস্থ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত সব শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি, বিনা মূল্যে শিক্ষা উপকরণ এবং টিফিনের ব্যবস্থা করতে হবে, একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করে ভালো শিক্ষকেরা যাতে গ্রামের স্কুলে পড়াতে যেতে উৎসাহী হন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি স্কুলে তিন মাসের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায়, যেখানে নিবিড় পঠনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের ঘাটতিগুলো পুষিয়ে নিতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি, কোনো শিক্ষার্থীই মৌলিকভাবে অক্ষম নয়। ক্ষমতা সবারই থাকে, শুধু তাকে জাগাতে হয়। এই জাগানোর কাজটা যাতে স্কুলগুলো প্রতি শ্রেণীতেই নিবিড়ভাবে করে, সে জন্য তাদের সহায়তা তহবিল এবং অন্যান্য সম্পদ দিতে হবে। সংবিধান সরকারকে এ রকম নির্দেশনাই দিচ্ছে। এটি অমান্য করা সরকারের উচিত হবে না।
এসএসএসসি পরীক্ষার ফল যেদিন বেরোয়, আমাকে কোনো না কোনো কাগজের রিপোর্টার দুটি প্রশ্ন করেন: ইংরেজির ফল খারাপ কেন হলো, এবার যদিও ইংরেজিতে সবাই ভালো করেছে এবং গ্রামের স্কুলের ফল খারাপ কেন? দুটি প্রশ্নের উত্তর আছে ওই এক জায়গায়, আমাদের মনোযোগের অভাব। ইংরেজি বিদেশি ভাষা, এটি রপ্ত করার জন্য যেসব পদ্ধতি-চর্চা-উপকরণ প্রয়োজন, আমাদের তার প্রায় কিছুই নেই। ইংরেজি শিক্ষা চলে মুখস্থ পদ্ধতিতে। ফলে প্রশ্ন যদি একটু এদিক-সেদিক হয়, তাহলে আর উপায় থাকে না। আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকি যে, ইংরেজি শিখতে হবে, তাহলে ভালো করে শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করে একই প্রশ্ন করে আমি যদি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ আর ধাদ্ধারা গোবিন্দপুর স্কুলের দুর্বল শিক্ষার্থী থেকে একই রকম ফল আশা করি, তা হবে একটা প্রহসন। অথচ ধাদ্ধারার শিক্ষার্থীর সেই অধিকার আছে ইংরেজির (বা যেকোনো বিষয়ে) ওই জ্ঞান লাভ করার, যা মির্জাপুরের শিক্ষার্থীটি পাচ্ছে। এর ব্যত্যয় সংবিধান স্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘনেরই শামিল।
৩.
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ) ভুক্তি নিয়ে যে বিতর্কের উল্লেখ আগে করেছি, সে প্রসঙ্গে ফিরে যাই। নিঃসন্দেহে একটি নীতিমালার ভিত্তিতে করা তালিকাটি বাদ দিয়ে নতুন তালিকা করাটা একটি বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে। যদি একটি নীতিমালা করাই হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সম্মান জানানো হলো না কেন? যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় তালিকা করতে হয়, তাহলে নীতিমালার কী দরকার ছিল? কাগজে পড়লাম, বিএনপি আমলে তৈরি স্কুল এমপিওভুক্ত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন এক মন্ত্রী। ওই মন্ত্রীর এলাকায় নিশ্চয় বিএনপির আমলে তৈরি একটি বা দুটি পুল আছে। তাহলে তো মন্ত্রীর এসব পুল ব্যবহার করা উচিত নয়। ঢাকার অনেক কাগজে দেখলাম শিক্ষামন্ত্রীকে ‘তোপের মুখে’ ফেলে তালিকা পুনর্বিবেচনার সমালোচনা হয়েছে। সংবাদ লিখেছে, ‘এমপি-মন্ত্রীদের অযৌক্তিক অভিযোগ-আবদারের কারণেই তালিকা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়’। ডেইলি স্টার লিখেছে তালিকাটি পর্যালোচনার নির্দেশ ছিল ‘তড়িঘড়ি করে দেওয়া’ এবং তা ‘দেশের শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খারাপ কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।’ সমকাল বলছে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিনামূল্যে ২০ কোটি বই প্রকাশ ও বিতরণে, একটি শিক্ষানীতির চূড়ান্তকরণে এবং ভালো ব্যবস্থাপনায় পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর ‘দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।’ আমারও বিশ্বাস, এমপিওভুক্তির কাজটি নুরুল ইসলাম নাহিদ সততার সঙ্গে এবং একটি নীতির আলোকে করেছিলেন। এর গঠনমূলক সংশোধনের পরিবর্তে এর প্রতি অনাস্থা দেখানোটা মন্ত্রী-সাংসদদের উচিত হয়নি।
তবে আমি আনন্দিত হব, যেদিন এমপিওভুক্তির জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আবেদন করতে হবে না, যেহেতু দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনমতো আর্থিক সহায়তা পাবে সরকার থেকে এবং সব শিক্ষক-সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দিনাদিপাত করতে পারবেন এবং উন্নত শিক্ষা দিতে পারবেন। তখন এসএসসির ফল প্রকাশের দিনগুলোও আর এত ব্যাপক গ্রাম-শহর, সচ্ছল-দরিদ্র বিভাজন নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments