চারদিক-জননীর কাছে by মাহফুজ রহমান
হাজার হাজার সালাম নিও/ জাহানারা ইমাম,/ বাঙ্গালির মনে অমর হোক তোমার ওই নাম।/ তুমি মোদের সবারই মা/ তুমি মোদের আশা,/ দেশের জন্য করেছ উজাড়/ সকল ভালবাসা।/ জানি তুমি যাচ্ছো লড়ে/ করতে দেশের ভালো,/ রাজাকারকে হটিয়ে দিয়ে/ আনতে দেশে আলো।/
তোমার রুমী হারিয়ে গেছে/ দুঃখ কি মা তাতে?/ আমরা তোমার সন্তান সব/ থাকবো তোমার সাথে।
‘মাকে’ শিরোনামের এ ছড়াটির লেখক ১২ বছরের মারজানা সাবিহা শুচি। ছড়াটির এক জায়গায় লেখা—‘জানি তুমি যাচ্ছো লড়ে’, মানে ছড়াটি লেখার সময় ছোট্ট শুচির ‘মা’ লড়াই করছিলেন। কার বিরুদ্ধে, কেন সেই লড়াই? আর কোন সে ‘মা’, যাঁকে লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল? অতীত বলে, শুচির ‘মা’ তিনিই, যিনি রাজপথে নেমেছিলেন সাধারণ দেশপ্রেমিকদের নিয়ে। লড়াই করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমাম।
আমাদের অনেকেরই শহীদজননীকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে এক অর্থে তাঁকে আমরা দেখেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজপথে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া জাহানারা ইমামকে আমরা দেখেছি বইয়ের পাতায়, পত্রপত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের ছোট্ট ক্যানভাসে। একসময় মনে প্রশ্ন জাগে, কতটুকু দেখেছি তাঁকে, কতটুকু বুঝেছি তাঁর কথা? বই, পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের ছেঁড়া ছেঁড়া এবং ছোট ক্যানভাসের এই দর্শন কি তাঁকে চেনার জন্য যথেষ্ট? উত্তরটা অবশ্যই ‘না’। তাই আরও কাছ থেকে দেখতে চাই তাঁকে, আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাই তাঁর আন্দোলনমুখর জীবনটাকে। এ সময় হাতে একটা চিরকুট আসে, তাতে একটা ঠিকানা—শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর, কণিকা, ৩৫৫ শহীদজননী জাহানারা ইমাম সরণি, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, ঢাকা-১২০৫।
ভরদুপুর। তেতে আছে রাস্তাঘাট। ভাগ্যিস ঠিকানাটা খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। সপ্তাহে শুধু শনিবারই খোলা থাকে এই ‘কণিকা’। সিঁড়ি ভেঙে কণিকার দোতলার ঘরটাতে ঢুকতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। ঘরে ঢোকার ঠিক ডানে কাঁচা হাতে লেখা কয়েকটা পঙিক্ত বাঁধাই করে রাখা। সে কটা পঙিক্ত মারজানা সাবিহা শুচির, যে ছড়াটা দিয়ে এই লেখার শুরু। শুচির ছড়ার পাশে একটা লাঠি। জাদুঘরে কর্মরত একজন বললেন, ‘আম্মা (জাহানারা ইমাম) যখন অসুস্থ, তখন এই লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করতেন। রাজপথে বেরোতে হলেও লাঠিটি তাঁর হাতে থাকত।’ লাঠিটার অগ্রভাগে কালসিটে দাগ। কল্পনায় ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো দেখতে পাই। জাহানারা ইমাম এগিয়ে চলছেন, হাতে এই লাঠি! মিছিলের পুরোভাগে থাকা জননীর আলোকচিত্র। কোনো কোনো আলোকচিত্রে তর্জনী উঁচিয়ে বক্তৃতা করছেন তিনি। কোনোটাতে হয়তো সাধারণ জনগণের কথা শুনছেন, কোনোটায় আলোচনা করছেন আন্দোলনের সহযাত্রীদের সঙ্গে। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য, শারীরিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অবিচল শহীদজননী।
ঘরের একপাশে বই ও আলোকচিত্রের অ্যালবামের সংগ্রহ। জাহানারা ইমাম ও সংগ্রামমুখর জীবনের কথা জানতে চাইলে যে কেউ এখানে আসতে পারেন, দেখতে পারেন ছবি। তার পাশে সোফাসেট। এক কোণে ‘ঘাতক-দালালের বিচার চাই’ লেখা অনেক পোস্টার। ঘাতক গোলাম আযমের নাগরিকত্ববিষয়ক মামলার প্রমাণপত্র। একাত্তরে রাজাকারদের কুকীর্তির ফিরিস্তি। একপাশে শহীদজননীর ব্যবহূত চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, চিরনিটাও আছে সেখানে। আছে পুরোনো একটা গ্রামোফোন, ‘আম্মার অসুস্থাবস্থার সঙ্গী ছিল এই যন্ত্র। গান শুনতে বড় পছন্দ করতেন তিনি।’ ঘুরে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন জাদুঘরের একজন তত্ত্বাবধায়ক।
খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা একটা খাট। পাশে লেখা—এ খাটেই ঘুমাতেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। খাটের তাকে রাখা আছে ফুলদানি, ছোট ছোট পুতুল, বেটোভেন, ফিরোজা বেগমের নজরুলগীতিসহ আরও কিছু ক্যাসেট। পাশেই ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের লালরঙা একটা পুরোনো ক্যাসেটপ্লেয়ার। শহীদজননী যখন ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করছেন, তখন এ ক্যাসেটপ্লেয়ারটি ছিল তাঁর একান্ত সঙ্গী। কাহলিল জিবরানের দ্য প্রোফেট, দিনলিপি ১৪১৪; ড. বদিউজ্জামানের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুখ এমন কয়েকটি বইও সাজিয়ে রাখা আছে খাটের তাকে। খাটের পাশেই একটা ময়না পাখি বসে আছে। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই, কাছে গেলে বোঝা যায়—প্রাণ নেই পাখিটির দেহে। ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনের সময় শহীদজননীকে চট্টগ্রামের কেউ একজন এই পাখিটি উপহার দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, একটু পরপর ‘জয় বাংলা’ বলে ডাকাডাকি করত ময়নাটা! জননীর প্রিয় পাখিটি মারা গেছে তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পরে। ‘তাই প্রিয় পাখিটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা রাখা হয়েছে এখনো। জাদুঘরের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। ওয়েবসাইট খোলারও পরিকল্পনা আছে। জাদুঘরে এখন নতুন প্রজন্মের অনেকেই আসে। আমরা চাই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা নিয়মিত আসুক এখানে।’ নিজেদের পরিকল্পনার কথা বলছিলেন জাদুঘরের একজন তত্ত্বাবধায়ক।
ঘরের পুবে একটা বারান্দা। বারান্দাজুড়ে ফুলের গাছ আর ছবি। রাজপথের ছবির পাশাপাশি পারিবারিক অনেক ছবিও আছে সেখানে। বারান্দা থেকে ফের ঘরে। ঘরের দেয়ালে এক জায়গায় একটা চিঠি বাঁধাই করে রাখা। তাতে লেখা—‘...বজ্রের মতো হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠো, দেশের অপমান দূর করো। দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসার দুরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো। ইতি—তোমার আব্বু আম্মু।’ ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চে শহীদ রুমীর উদ্দেশে চিঠিটি লিখেছিলেন শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম। রুমী কথা রেখেছিলেন, এবার কি আমাদের পালা নয়?
‘মাকে’ শিরোনামের এ ছড়াটির লেখক ১২ বছরের মারজানা সাবিহা শুচি। ছড়াটির এক জায়গায় লেখা—‘জানি তুমি যাচ্ছো লড়ে’, মানে ছড়াটি লেখার সময় ছোট্ট শুচির ‘মা’ লড়াই করছিলেন। কার বিরুদ্ধে, কেন সেই লড়াই? আর কোন সে ‘মা’, যাঁকে লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল? অতীত বলে, শুচির ‘মা’ তিনিই, যিনি রাজপথে নেমেছিলেন সাধারণ দেশপ্রেমিকদের নিয়ে। লড়াই করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমাম।
আমাদের অনেকেরই শহীদজননীকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে এক অর্থে তাঁকে আমরা দেখেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজপথে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া জাহানারা ইমামকে আমরা দেখেছি বইয়ের পাতায়, পত্রপত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের ছোট্ট ক্যানভাসে। একসময় মনে প্রশ্ন জাগে, কতটুকু দেখেছি তাঁকে, কতটুকু বুঝেছি তাঁর কথা? বই, পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের ছেঁড়া ছেঁড়া এবং ছোট ক্যানভাসের এই দর্শন কি তাঁকে চেনার জন্য যথেষ্ট? উত্তরটা অবশ্যই ‘না’। তাই আরও কাছ থেকে দেখতে চাই তাঁকে, আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাই তাঁর আন্দোলনমুখর জীবনটাকে। এ সময় হাতে একটা চিরকুট আসে, তাতে একটা ঠিকানা—শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর, কণিকা, ৩৫৫ শহীদজননী জাহানারা ইমাম সরণি, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, ঢাকা-১২০৫।
ভরদুপুর। তেতে আছে রাস্তাঘাট। ভাগ্যিস ঠিকানাটা খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। সপ্তাহে শুধু শনিবারই খোলা থাকে এই ‘কণিকা’। সিঁড়ি ভেঙে কণিকার দোতলার ঘরটাতে ঢুকতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। ঘরে ঢোকার ঠিক ডানে কাঁচা হাতে লেখা কয়েকটা পঙিক্ত বাঁধাই করে রাখা। সে কটা পঙিক্ত মারজানা সাবিহা শুচির, যে ছড়াটা দিয়ে এই লেখার শুরু। শুচির ছড়ার পাশে একটা লাঠি। জাদুঘরে কর্মরত একজন বললেন, ‘আম্মা (জাহানারা ইমাম) যখন অসুস্থ, তখন এই লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করতেন। রাজপথে বেরোতে হলেও লাঠিটি তাঁর হাতে থাকত।’ লাঠিটার অগ্রভাগে কালসিটে দাগ। কল্পনায় ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো দেখতে পাই। জাহানারা ইমাম এগিয়ে চলছেন, হাতে এই লাঠি! মিছিলের পুরোভাগে থাকা জননীর আলোকচিত্র। কোনো কোনো আলোকচিত্রে তর্জনী উঁচিয়ে বক্তৃতা করছেন তিনি। কোনোটাতে হয়তো সাধারণ জনগণের কথা শুনছেন, কোনোটায় আলোচনা করছেন আন্দোলনের সহযাত্রীদের সঙ্গে। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য, শারীরিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অবিচল শহীদজননী।
ঘরের একপাশে বই ও আলোকচিত্রের অ্যালবামের সংগ্রহ। জাহানারা ইমাম ও সংগ্রামমুখর জীবনের কথা জানতে চাইলে যে কেউ এখানে আসতে পারেন, দেখতে পারেন ছবি। তার পাশে সোফাসেট। এক কোণে ‘ঘাতক-দালালের বিচার চাই’ লেখা অনেক পোস্টার। ঘাতক গোলাম আযমের নাগরিকত্ববিষয়ক মামলার প্রমাণপত্র। একাত্তরে রাজাকারদের কুকীর্তির ফিরিস্তি। একপাশে শহীদজননীর ব্যবহূত চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, চিরনিটাও আছে সেখানে। আছে পুরোনো একটা গ্রামোফোন, ‘আম্মার অসুস্থাবস্থার সঙ্গী ছিল এই যন্ত্র। গান শুনতে বড় পছন্দ করতেন তিনি।’ ঘুরে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন জাদুঘরের একজন তত্ত্বাবধায়ক।
খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা একটা খাট। পাশে লেখা—এ খাটেই ঘুমাতেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। খাটের তাকে রাখা আছে ফুলদানি, ছোট ছোট পুতুল, বেটোভেন, ফিরোজা বেগমের নজরুলগীতিসহ আরও কিছু ক্যাসেট। পাশেই ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের লালরঙা একটা পুরোনো ক্যাসেটপ্লেয়ার। শহীদজননী যখন ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করছেন, তখন এ ক্যাসেটপ্লেয়ারটি ছিল তাঁর একান্ত সঙ্গী। কাহলিল জিবরানের দ্য প্রোফেট, দিনলিপি ১৪১৪; ড. বদিউজ্জামানের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুখ এমন কয়েকটি বইও সাজিয়ে রাখা আছে খাটের তাকে। খাটের পাশেই একটা ময়না পাখি বসে আছে। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই, কাছে গেলে বোঝা যায়—প্রাণ নেই পাখিটির দেহে। ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনের সময় শহীদজননীকে চট্টগ্রামের কেউ একজন এই পাখিটি উপহার দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, একটু পরপর ‘জয় বাংলা’ বলে ডাকাডাকি করত ময়নাটা! জননীর প্রিয় পাখিটি মারা গেছে তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পরে। ‘তাই প্রিয় পাখিটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা রাখা হয়েছে এখনো। জাদুঘরের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। ওয়েবসাইট খোলারও পরিকল্পনা আছে। জাদুঘরে এখন নতুন প্রজন্মের অনেকেই আসে। আমরা চাই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা নিয়মিত আসুক এখানে।’ নিজেদের পরিকল্পনার কথা বলছিলেন জাদুঘরের একজন তত্ত্বাবধায়ক।
ঘরের পুবে একটা বারান্দা। বারান্দাজুড়ে ফুলের গাছ আর ছবি। রাজপথের ছবির পাশাপাশি পারিবারিক অনেক ছবিও আছে সেখানে। বারান্দা থেকে ফের ঘরে। ঘরের দেয়ালে এক জায়গায় একটা চিঠি বাঁধাই করে রাখা। তাতে লেখা—‘...বজ্রের মতো হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠো, দেশের অপমান দূর করো। দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসার দুরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো। ইতি—তোমার আব্বু আম্মু।’ ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চে শহীদ রুমীর উদ্দেশে চিঠিটি লিখেছিলেন শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম। রুমী কথা রেখেছিলেন, এবার কি আমাদের পালা নয়?
No comments