বাঘা তেঁতুল-অবাধ তথ্যপ্রবাহ গবেষণালব্ধ জ্ঞান by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের গবেষণায় যেমন নেই ক্লান্তি, তেমনি অবাধ তথ্য সরবরাহে নেই কোনো কমতি। আসমান ও জমিনে এমন কিছু নেই, যা তাঁদের গবেষণার উপজীব্য নয়। মানুষের জীবনের এমন ঘটনা নেই, যা তাঁদের সংবাদের বিষয়বস্তু হতে পারে না। আমরা গবেষণার ধারে-কাছেও নেই।
তথ্য অধিকার অর্জিত হয়নি বলে তথ্যপ্রবাহটাও অবাধ হচ্ছে না। পশ্চিমা বন্ধুরা অন্য দেশের বিরুদ্ধে তাঁদের রাষ্ট্রের গোপন তৎপরতার কথা জানলেও প্রকাশ করেন না। কিন্তু ব্যক্তির একান্ত গোপনীয় খবরটিও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন। তাই ইরাক ও আফগানিস্তানের মানুষের জীবনের দুর্বিষহ সংবাদ আল-জাজিরা ছাড়া তাঁদের মাধ্যমে অতি সামান্যই প্রচারিত হয়।
এক প্রতিবেদনে জানা গেল, ইংল্যান্ডের সাদাম্পটনের ৪০ বছর বয়স্ক এক প্রৌঢ়ের পুরুষাঙ্গ আটকে গিয়েছিল স্টিলের পাইপে। প্রথমে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সাদাম্পটন জেনারেল হাসপাতালে। ওটা ছাড়ানোর যন্ত্রপাতি তাদের কাছে ছিল না। শেষ পর্যন্ত সাড়ে চার ইঞ্চির একটি গ্রাইন্ডার নিয়ে হাসপাতালে আসে সাদাম্পটন সেন্ট মেরি দমকল অফিসের একটি বিশেষ উদ্ধারকারী দল। অত্যন্ত ‘স্টেডি’ হাতে পাইপ কেটে উদ্ধার করা হয় ওটাকে। ভারতের কাগজে খবরটির ফলাও প্রচার হয়েছে।
আমাদের মতো জনবহুল দেশের প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে গিয়ে কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিলেও তার এক লাইন সংবাদ বেরোয় না ও দেশের কাগজে। অবশ্য আরও কোনো কোনো সংবাদ তাঁরা করেন না। সাদাম্পটনের ভদ্রলোকের কী আটকে গেল, অবশ্য আটকে গেলই বা কী করে, তা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ। কিন্তু ওদিকে আমেরিকার এমন সহযোগী হতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের লেজ আটকে গেছে আফগানিস্তানে ও ইরাকে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রতিবেদন হয় না।
বড় সাংবাদিকেরাও যে কখন কী করেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। মার্ক টালি উপমহাদেশে খুবই নামজাদা ব্রিটিশ সাংবাদিক। ভারত সরকার তাঁকে একবার ‘পদ্মশ্রী’ আবার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার দিয়েছে ‘নাইটহুড’ বা ‘স্যার’। কয়েক দিন আগে ভারতের রোলি বুকস থেকে বেরিয়েছে Hindutva, sex and Adventure নামে একটি বই। উপন্যাসের ঢংয়ে লেখা। নায়ক অ্যান্ড্রু লিউটের চরিত্রটি হলো মার্ক টালির। টালির একটি বই আছে, নাম নো ফুল স্টপ ইন ইন্ডিয়া। নায়ক লিউটের লেখা বইটির নাম নো কমাস ইন সাউথ এশিয়া। এ বইয়ে দেখানো হয়েছে টালি হিন্দুত্ববাদীদের একজন সহযোগী, ১৯৯০ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে দাঙ্গার একজন উসকানিদাতা এবং আরও গুরুতর যেটা, তা হলো, তিনি নারী সাংবাদিকদের প্রলুব্ধকারী। তাঁর দ্বারা এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর কথাও আছে।
পৃথিবীতে সাংবাদিকও দুই রকম, পাঠকও দুই প্রকার। এক দল পাঠক একটা সময় পর্যন্ত সব সাংবাদিকের সব কথাই বিশ্বাস করে। আরেক দল কোনো সাংবাদিকের কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। কিন্তু পশ্চিমা গবেষকদের বিশ্বাস করে বোকা ছাড়া সবাই।
পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে গবেষণার ফাইন্ডিংস প্রকাশিত হয়। ঘটা করে সেগুলোর অনুসন্ধানী তথ্য প্রকাশ করা হয়। সাংবাদিকেরা তা প্রচার করেন অতি উৎসাহে।
সবচেয়ে নিষ্ঠুর খবর বেরিয়েছে দ্য টেলিগ্রাফে। আগে জানতাম ধূমপান, এখন দেখছি সুন্দরী নারীও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রায় দিয়েছেন স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। আকর্ষণীয় নারীর সান্নিধ্যে পাঁচ মিনিট থাকলেই বিপদ। তাতে দেহের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন কলেস্টোরেলের মাত্রা বেড়ে যায়। হূদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও যৌন অক্ষমতার আশঙ্কা বাড়ে। তবে গবেষক সবচেয়ে খাঁটি কথা যা বলেছেন তা হলো, সুন্দরীর সঙ্গে এক কক্ষে পাঁচ মিনিট থাকলে প্রেমভাব জাগে পুরুষের। তবে যদি পুরুষটি দূরদর্শী হয় এবং ভাবে যে তাকে পাওয়া যাবে না—তা হলে হরমোনের মাত্রা ঠিক থাকে।
লাখ লাখ ডলার খরচ করে করা এই গবেষণায় যা জানা গেল তা আদম-হাওয়ার সময় থেকে সব পুরুষই জানে। এর মধ্যে আরেক গবেষণার ফলাফল নিয়ে খবর বেরিয়েছে ১২ মে। হাই আমরা তুলছি জন্মের পর থেকে। এবার জানা গেল, হাই তোলার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক নিবিড়।
হাই তোলা নিয়ে গবেষণালব্ধ বই একটা বেরিয়েছে ফরাসি দেশ থেকে। ডা. অলিভিয়ের ভালুজিনস্কির বইটিতে হাইসংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস আলোচিত হয়েছে। তবে ওই বইয়ে ওলন্দাজ এক হাইবিজ্ঞানী যা বলেছেন তা ফেলে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেছেন, হাই তোলার সঙ্গে যৌন আবেদনের সম্পর্ক রয়েছে। তরুণী সেক্রেটারি বা পিএ যদি দেখেন যে তাঁর কর্তা ঘন ঘন হাই তুলছেন, তা হলে সর্বনাশ। পুরুষ সহকর্মীকে কোনো নারী যদি বারবার হাই তুলতে দেখে, তা হলে তাঁর ওখান থেকে অবিলম্বে টেবিল সরিয়ে নেওয়া উচিত। এ বই রচনার আগে মিস লিউনস্কির সাক্ষাৎকার নেওয়া উচিত ছিল। তিনিই বলতে পারেন, বিল ক্লিনটন ঘন ঘন হাই তুলতেন কি না! অবশ্য নারীরাও হাই তুলতে জানে। শুধু ওই লেখা নয়, হাই নিয়ে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনও হবে প্যারিসে, ২৪-২৫ জুন।
ওই বইয়ে যা নেই তা হলো, হাই তোলার সঙ্গে রাজনীতির কী সম্পর্ক? বইটির একটি পরিচ্ছেদ আমাকে লিখতে দিলে আমি প্রমাণ করে দিতাম, রাজনীতির সঙ্গে হাইয়ের সম্পর্ক কতটা। ক্লান্তি ও অবসাদের প্রকাশ ঘটে হাই তোলায়। বিশেষ ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণও হাই তোলে। তবে জনগণ যদি লক্ষ্য করে যে সরকারি নেতারা শুধু খিল খিল করে হাসছেন এবং প্রধান বিরোধী দলের নেতারা ড্রয়িংরুমে বসে হাই তুলছেন, তখন জনগণ ডবল হাই তোলে। প্যারিস হাই সম্মেলনে আমি যোগ দিলে বলতাম, আমরা তিনবার হাই তুলি: যখন দেখি ঘর অন্ধকার ও মাথার ওপর পাখা ঘুরছে না, রান্নাঘরে চুলায় গ্যাস নেই এবং বন বন করে ঘোরা মাথা নিয়ে যখন গোসলখানায় গিয়ে দেখি কলে পানি নেই। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে হাসি নয়, হাই-ই স্থায়ী।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
এক প্রতিবেদনে জানা গেল, ইংল্যান্ডের সাদাম্পটনের ৪০ বছর বয়স্ক এক প্রৌঢ়ের পুরুষাঙ্গ আটকে গিয়েছিল স্টিলের পাইপে। প্রথমে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সাদাম্পটন জেনারেল হাসপাতালে। ওটা ছাড়ানোর যন্ত্রপাতি তাদের কাছে ছিল না। শেষ পর্যন্ত সাড়ে চার ইঞ্চির একটি গ্রাইন্ডার নিয়ে হাসপাতালে আসে সাদাম্পটন সেন্ট মেরি দমকল অফিসের একটি বিশেষ উদ্ধারকারী দল। অত্যন্ত ‘স্টেডি’ হাতে পাইপ কেটে উদ্ধার করা হয় ওটাকে। ভারতের কাগজে খবরটির ফলাও প্রচার হয়েছে।
আমাদের মতো জনবহুল দেশের প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে গিয়ে কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিলেও তার এক লাইন সংবাদ বেরোয় না ও দেশের কাগজে। অবশ্য আরও কোনো কোনো সংবাদ তাঁরা করেন না। সাদাম্পটনের ভদ্রলোকের কী আটকে গেল, অবশ্য আটকে গেলই বা কী করে, তা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ। কিন্তু ওদিকে আমেরিকার এমন সহযোগী হতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের লেজ আটকে গেছে আফগানিস্তানে ও ইরাকে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রতিবেদন হয় না।
বড় সাংবাদিকেরাও যে কখন কী করেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। মার্ক টালি উপমহাদেশে খুবই নামজাদা ব্রিটিশ সাংবাদিক। ভারত সরকার তাঁকে একবার ‘পদ্মশ্রী’ আবার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার দিয়েছে ‘নাইটহুড’ বা ‘স্যার’। কয়েক দিন আগে ভারতের রোলি বুকস থেকে বেরিয়েছে Hindutva, sex and Adventure নামে একটি বই। উপন্যাসের ঢংয়ে লেখা। নায়ক অ্যান্ড্রু লিউটের চরিত্রটি হলো মার্ক টালির। টালির একটি বই আছে, নাম নো ফুল স্টপ ইন ইন্ডিয়া। নায়ক লিউটের লেখা বইটির নাম নো কমাস ইন সাউথ এশিয়া। এ বইয়ে দেখানো হয়েছে টালি হিন্দুত্ববাদীদের একজন সহযোগী, ১৯৯০ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে দাঙ্গার একজন উসকানিদাতা এবং আরও গুরুতর যেটা, তা হলো, তিনি নারী সাংবাদিকদের প্রলুব্ধকারী। তাঁর দ্বারা এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর কথাও আছে।
পৃথিবীতে সাংবাদিকও দুই রকম, পাঠকও দুই প্রকার। এক দল পাঠক একটা সময় পর্যন্ত সব সাংবাদিকের সব কথাই বিশ্বাস করে। আরেক দল কোনো সাংবাদিকের কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। কিন্তু পশ্চিমা গবেষকদের বিশ্বাস করে বোকা ছাড়া সবাই।
পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে গবেষণার ফাইন্ডিংস প্রকাশিত হয়। ঘটা করে সেগুলোর অনুসন্ধানী তথ্য প্রকাশ করা হয়। সাংবাদিকেরা তা প্রচার করেন অতি উৎসাহে।
সবচেয়ে নিষ্ঠুর খবর বেরিয়েছে দ্য টেলিগ্রাফে। আগে জানতাম ধূমপান, এখন দেখছি সুন্দরী নারীও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রায় দিয়েছেন স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। আকর্ষণীয় নারীর সান্নিধ্যে পাঁচ মিনিট থাকলেই বিপদ। তাতে দেহের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন কলেস্টোরেলের মাত্রা বেড়ে যায়। হূদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও যৌন অক্ষমতার আশঙ্কা বাড়ে। তবে গবেষক সবচেয়ে খাঁটি কথা যা বলেছেন তা হলো, সুন্দরীর সঙ্গে এক কক্ষে পাঁচ মিনিট থাকলে প্রেমভাব জাগে পুরুষের। তবে যদি পুরুষটি দূরদর্শী হয় এবং ভাবে যে তাকে পাওয়া যাবে না—তা হলে হরমোনের মাত্রা ঠিক থাকে।
লাখ লাখ ডলার খরচ করে করা এই গবেষণায় যা জানা গেল তা আদম-হাওয়ার সময় থেকে সব পুরুষই জানে। এর মধ্যে আরেক গবেষণার ফলাফল নিয়ে খবর বেরিয়েছে ১২ মে। হাই আমরা তুলছি জন্মের পর থেকে। এবার জানা গেল, হাই তোলার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক নিবিড়।
হাই তোলা নিয়ে গবেষণালব্ধ বই একটা বেরিয়েছে ফরাসি দেশ থেকে। ডা. অলিভিয়ের ভালুজিনস্কির বইটিতে হাইসংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস আলোচিত হয়েছে। তবে ওই বইয়ে ওলন্দাজ এক হাইবিজ্ঞানী যা বলেছেন তা ফেলে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেছেন, হাই তোলার সঙ্গে যৌন আবেদনের সম্পর্ক রয়েছে। তরুণী সেক্রেটারি বা পিএ যদি দেখেন যে তাঁর কর্তা ঘন ঘন হাই তুলছেন, তা হলে সর্বনাশ। পুরুষ সহকর্মীকে কোনো নারী যদি বারবার হাই তুলতে দেখে, তা হলে তাঁর ওখান থেকে অবিলম্বে টেবিল সরিয়ে নেওয়া উচিত। এ বই রচনার আগে মিস লিউনস্কির সাক্ষাৎকার নেওয়া উচিত ছিল। তিনিই বলতে পারেন, বিল ক্লিনটন ঘন ঘন হাই তুলতেন কি না! অবশ্য নারীরাও হাই তুলতে জানে। শুধু ওই লেখা নয়, হাই নিয়ে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনও হবে প্যারিসে, ২৪-২৫ জুন।
ওই বইয়ে যা নেই তা হলো, হাই তোলার সঙ্গে রাজনীতির কী সম্পর্ক? বইটির একটি পরিচ্ছেদ আমাকে লিখতে দিলে আমি প্রমাণ করে দিতাম, রাজনীতির সঙ্গে হাইয়ের সম্পর্ক কতটা। ক্লান্তি ও অবসাদের প্রকাশ ঘটে হাই তোলায়। বিশেষ ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণও হাই তোলে। তবে জনগণ যদি লক্ষ্য করে যে সরকারি নেতারা শুধু খিল খিল করে হাসছেন এবং প্রধান বিরোধী দলের নেতারা ড্রয়িংরুমে বসে হাই তুলছেন, তখন জনগণ ডবল হাই তোলে। প্যারিস হাই সম্মেলনে আমি যোগ দিলে বলতাম, আমরা তিনবার হাই তুলি: যখন দেখি ঘর অন্ধকার ও মাথার ওপর পাখা ঘুরছে না, রান্নাঘরে চুলায় গ্যাস নেই এবং বন বন করে ঘোরা মাথা নিয়ে যখন গোসলখানায় গিয়ে দেখি কলে পানি নেই। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে হাসি নয়, হাই-ই স্থায়ী।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments