হতবাক ফয়সাল শাহজাদের গ্রাম by দাউদ ইসলাম

সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে সম্প্রতি উচ্চারিত হয়েছে পাকিস্তানের অখ্যাত ছোট্ট গ্রাম মোহিব বান্ধার নাম। নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে গাড়িবোমা হামলার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ফয়সাল শাহজাদ ওই গ্রামেরই ছেলে। এ খবরে হতবাক গ্রামের মানুষ। সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের সন্তান শাহজাদ এমন কাণ্ড করতে পারে—এটা বিশ্বাসই করতে চাইছে না অনেকে।


বিষয়টিকে মার্কিন ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেও মনে করছে অনেক গ্রামবাসী।
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক শাহজাদের দুটি পারিবারিক বাড়ি রয়েছে পাকিস্তানে। একটি পেশোয়ার শহরে, অন্যটি মোহিব বান্ধা গ্রামে। দুটি বাড়ির বাইরেই আজকাল গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় লেগে থাকে, কিন্তু ভেতরে সুনসান নীরবতা।
পেশোয়ারের বাড়ির বাইরে বসে থাকা সাংবাদিক ও ক্যামেরা-ক্রুরা বলছেন, লোকজন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কয়েকজন গৃহকর্মী থাকলেও কড়া নাড়ার শব্দে সাড়া দিচ্ছে না তারা। এমনকি ফোনও ধরছে না।
শাহজাদের পৈতৃক বাড়ি পেশোয়ার শহরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্বে মোহিব বান্ধা গ্রাম। বিবিসির এক সাংবাদিক সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখেন প্রায় একই রকম দৃশ্য। শাহজাদ সম্পর্কে জানার জন্য বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। সঙ্গে বিপুলসংখ্যক উৎসুক মানুষ। ওই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা শাহজাদের এক জ্ঞাতিভাই ও তাঁর স্ত্রী তখন কাজে গেছেন, তাই দরজায় তালা।
তবে বাড়ির অধিবাসীদের কাজ থেকে ফেরার সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁদের পাত্তা পাওয়া গেল না। কারণ হিসেবে উপস্থিত স্থানীয় লোকজন বললেন, হয়তো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে চাইছেন না বলেই ঘরে ফিরছেন না তাঁরা।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন শাহজাদ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামের যেসব মানুষ শাহজাদকে দেখেছে তারা বলেছে, তাঁর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।
স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ফাইজ আহমদ বলেন, শাহজাদ ছিলেন হাসিখুশি ধরনের আর কর্মচঞ্চল মানুষ। তবে বছর তিনেক আগে বিয়ে করার পর থেকে বদলে যেতে শুরু করেন তিনি।
শাহজাদের এমন কাণ্ডের খবরে ব্যথিত তাঁর বাল্যবন্ধু নাসির খান। তাঁর বক্তব্য, নিরপরাধ মানুষকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না শাহজাদ। তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে শাহজাদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করেছেন তিনিও।
নাসির খান বলেন, শাহজাদকে কখনোই তালেবান কিংবা অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী সম্পর্কে কথা বলতে শোনা যায়নি। তবে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিষয় নিয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
২০০৯ সালের মাঝামাঝি শাহজাদের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল নাসিরের। একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেশোয়ারে গিয়েছিলেন শাহজাদ।
নাসির বলেন, ‘আমি জানতাম শাহজাদ সেবার বেশ কিছুদিন দেশে ছিলেন। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের পর আমি আর তাঁকে দেখিনি।’
গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বললেন, শাহজাদ যুক্তরাষ্ট্রে যা করেছেন, তা ভুল। কারণ, এটা তাঁদের গ্রামের বদনাম করেছে।
টাইমস স্কয়ারের ঘটনা বিশ্বাস করেনি গ্রামের অনেক মানুষ। তাদের দাবি, এটা অবিশ্বাস্য। সম্ভবত এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র।
তবে প্রবাসী শাহজাদ সম্পর্কে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের খুব একটা ধারণা নেই। এমনকি জ্ঞাতিভাই ইবরার খানও তাঁর সম্পর্কে জানেন খুব সামান্য। ইবরার বলেন, শাহজাদের বাবা বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। অধিকাংশ সময় তিনি ছিলেন দূরে দূরে। ফয়সাল ও তাঁর বড় ভাই আমির শাহজাদের জন্ম বাইরের কোনো শহরেই। তাঁরা পড়াশোনাও করেছেন অন্যত্র। ইবরার তাঁদের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানেন না।
শাহজাদ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন, তা অবশ্য বিশ্বাস করতে নারাজ ইবরার। ভাই নির্দোষ—এ দাবিতে অবিচল তিনি। ইবরার বলেন, ‘আপনি গ্রামের যেকোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। তারা বলবে, শাহজাদের পরিবার কোন ধরনের।’
গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই শাহজাদের বাবা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) বাহারুল হককে একজন সুশিক্ষিত ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে মনে করে থাকে।
পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য নিজেরাই স্বীকার করেছেন, মাতৃভূমি সফরের সময় জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন শাহজাদ। তিনি পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গি প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন বলে টাইম ম্যাগাজিনকে জানান এক কর্মকর্তা। জানা গেছে, পাকিস্তানি পাসপোর্টের আবেদনপত্রে নিজের জাতীয়তা ‘কাশ্মীরি’ বলে উল্লেখ করেন শাহজাদ। বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, কাশ্মীরের প্রতি এ আবেগ থেকে সেখানে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে থাকতে পারে তার।

No comments

Powered by Blogger.