ছাত্রলীগ-আবেগ নয়, চাই অঙ্গীকার by মাহমুদুর রহমান মান্না
১০ মে একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ অনুযায়ী ছাত্রলীগের নয়া নেতৃত্বের খোঁজে নেমেছে গোয়েন্দারা। ছাত্রলীগকে পথে আনতে নতুন নেতৃত্ব খোঁজা হচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব যাতে কোনোভাবেই বিতর্কের জন্ম না দেয়, বিষয়টি মাথায় রেখে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকে।
ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতাদের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে তাঁদের আমলনামাও তৈরি করেছে গোয়েন্দারা। এটি আমার আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে এই সরকার বিব্রত। বিভিন্ন মন্ত্রী, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর আচরণে ও উচ্চারণে এটা বোঝা গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন অনেকেই আশা করেছিল যে একটা কিছু হবে। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের বারো-চৌদ্দবার দেশের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। প্রতিবারই জনতার অনুরোধে ও চাপে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপও ছাত্রলীগের মধ্যে সে রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে, এটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের নেত্রীকে তাঁর পদে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন, কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর মত পাল্টাননি। তিনি কি ভেবেছিলেন এতে ছাত্রলীগ শুধরে যাবে? না, ছাত্রলীগ শোধরায়নি। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
কেন? যে নেতার কথা ছাড়া আওয়ামী লীগের গাছের পাতা নড়ে না, যাঁর ইশারায় দল ও দেশের বাঘা বাঘা ব্যক্তি ও নেতারা ধরাশায়ী হন, তাঁর কথা ছাত্রলীগের তরুণ নেতা-কর্মীরা মানবে না? ব্যাপারটা ভাবার মতো ছিল, গভীরভাবে ভাবা উচিত ছিল, যা হয়নি।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া মোটামুটিভাবে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তা কার্যকর করার ফলাফল তো ভালো দেখা যাচ্ছে না। দেশব্যাপী এই নৈরাজ্যের মুখে ছাত্রলীগের তরুণ নেতৃত্বের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। যতগুলো জায়গা বা শাখা সম্পর্কে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, তার কোথায়ও তাঁরা এ প্রসঙ্গে একটি সভাও করেননি। আর এ রকম একটা পরিস্থিতি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করবেনই কীভাবে? যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা নতুন, আর সব শাখার নেতৃত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের চাইতে প্রবীণ। ফলে দেশব্যাপী তাঁদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভেবে দুঃখ লাগে যে এই নেতৃত্ব বিদায় নেবেন ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। কারণ, বর্তমান অবস্থার সব দায় তাঁদের ওপর বর্তাবে।
আমি আমার পূর্বের কথায় ফিরে আসি, শেখ হাসিনার সেই পদক্ষেপ যে কাজে লাগল না, তার কারণ এই নয় যে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে আর আগের মতো মানেন না। কারণটি হলো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক। সামনে তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে হাজারটা প্রশ্ন, তাতে বিভ্রান্ত তাঁরা। এই যে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনুরোধ শুনলেন না, তার মানে কী? এটি কি সুচিন্তিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত? নাকি তাঁর সন্তানদের পথে আনার জন্য একটি আবেগপ্রসূত কাঠিন্য?
পাঠক, এই লেখক একজন রাজনীতির সন্তান। আমার রাজনীতির পাঠশালার নাম ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ তথা ছাত্র আন্দোলনের অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে এই বর্তমানেও গর্ববোধ করি আমি। এই যে জরুরি অবস্থার সময় ছাত্ররা আন্দোলন করল, বলা যায় দুই বছরে এই একটিই উদাহরণ, যার কাছে পেছনে থাকা সামরিক জান্তা পরাজিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগসহ কোনো রাজনৈতিক দলেরই উল্লেখ করার মতো ভূমিকা ছিল না তখন। কিন্তু এ-ও ঠিক, ছাত্র আন্দোলনের এই সুদীর্ঘ গৌরবগাথায় বর্তমানে কলঙ্কের দাগ লেগেছে। কারা করেছে সেগুলো? এ দেশের ছোট বা মাঝারি আকারের ছাত্রসংগঠনগুলো, যারা কোনো দিন ক্ষমতার স্বাদ পায়নি, তাদের এ সমস্যা নেই। এই সমস্যার ভিত্তি হলো ক্ষমতা। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই ছাত্রলীগ সামনে এসেছে। গতকাল বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন ছাত্রদল এসব করেছে। ক্ষমতাকে বুঝতে হবে যে তাদেরও পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার, অন্য সবকিছু পরিচ্ছন্ন করা দরকার। এটা কেবল আবেগ দেখানোর ব্যাপার নয়। আমি বরং বলব, একেবারে আবেগমুক্ত হয়ে গলদটা কোথায়, তা খুঁজে বের করতে হবে এবং এর মূল উৎপাটন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব ওবায়দুল কাদের (যিনি দীর্ঘদিন ছাত্ররাজনীতি করেছেন, ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, ছাত্রলীগের দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওকে কমিশনের প্রধান ছিলেন) সার্বিক ঘটনায় তাঁর হতাশা, দুঃখ ও লজ্জার কথা বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, যেন দ্রুত বিচার আইনে অপরাধীদের বিচার করা হয়।
অপরাধী কারা? কয়জন? আমি আমার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবং বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখেছি, অপরাধীর সংখ্যা সাধারণের তুলনায় সব সময় কম থাকে। এই অপরাধীদের ঠিকমতো খুঁজে বের করতে হবে এবং তাদেরই শাস্তি দিতে হবে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে গেলে ভয় পেলে চলবে না। কিন্তু খেয়াল করতে হবে, মাটি খুঁড়তে গিয়ে পুরো জমিটাই যেন নষ্ট করে না ফেলি। আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে যেন বাগান উজাড় হয়ে না যায়। ছাত্রলীগে যা কলুষ তা থেকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু তার মানে ছাত্রলীগ থেকে মুক্ত হওয়া নয়। আমি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে তো নয়ই, এমনকি সাময়িকভাবে এর কার্যক্রম স্থগিত করারও বিপক্ষে। আমি বরং লাগাতারভাবে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের সব অপশক্তি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে চাই। ছাত্রলীগকে দুর্বল বা অস্বীকার করলে অন্যরা বেড়ে যাবে, যাদের বেড়ে যাওয়া আমি চাই না।
পত্রিকায় পড়লাম, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ছাত্রলীগের সভায় যেতে অস্বীকার করেছেন। এমনকি অন্য কোনো সংগঠনের সভায় যদি ছাত্রলীগের নেতারা উপস্থিত থাকেন, সেখানেও যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। আমি খুব অবাক হয়েছি। বেগম মতিয়া চৌধুরী এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। মন্ত্রী ও নেতা হিসেবে তাঁর মতো সৎ ও নিষ্ঠ মানুষও বিরল। সেই তিনি যদি সত্যিই এ রকম বলে থাকেন, তবে তো ধরে নিতে হবে যে ছাত্রলীগ একেবারে পচে গেছে, যার কাছেও যাওয়া যায় না। ব্যাপারটা কি সত্যি এ রকম? ছাত্রলীগ একেবারে পচে গেছে? নিশ্চয়ই না। ছাত্রলীগে অবশ্য পচন ধরেছে। কিন্তু এখনো ঠিকমতো সততার সঙ্গে ব্যক্তি, গ্রুপ, আঞ্চলিকতা, আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে উঠে শুদ্ধি অভিযান চালালে ছাত্রসংগঠনকে আবারও সম্মানের জায়গায় আনা যাবে।
পত্রিকায় দেখলাম, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে এবং আগামী মাসেই গঠন করা হচ্ছে নতুন কমিটি। এটি একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, পদক্ষেপটা নিল কে বা কারা? এটা কি ছাত্রলীগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা উপলব্ধি? নাকি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে এ কথা বুঝতে হবে যে এখন ছাত্রলীগকে সক্রিয়ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কিংবা মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য কেবল এই বিবেচনায় গ্রহণ ও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য হতে পারে। ওকে কমিশন কিংবা বর্তমানে আওয়ামী লীগের তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল এই বিবেচনাতেই সঠিক হতে পারে। সহযোগী সংগঠন হিসেবে তাঁরা ছাত্রলীগকে আজকের রাজনীতির প্রয়োজন ও চাহিদা বোঝাবেন, তাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবেন এবং সতর্ক করে দেবেন এই বলে যে এর ব্যত্যয় হলে মূল দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকবে না।
এবার মূল প্রতিপাদ্যে আসি। নতুন কমিটির নেতৃত্বের খোঁজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাকে—এই খবর পড়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছি। দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে না, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসন চলে, তখন গোয়েন্দাদের রাজত্ব চলে। কিন্তু এই গোয়েন্দারা বিডিআর বিদ্রোহ ঠেকাতে পারে না; বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবরই রাখে না; নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার নামে সমগ্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের মধ্যে এ ধরনের চিন্তা কাজ করছে, তা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমি আশা করব, এই সংবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হবে।
পত্রিকায় এ-ও পড়লাম, ছাত্রলীগের এই কমিটি ভেঙে দিয়ে আগামী জুনে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হবে। এটি একটি ভালো খবর। গতবার যে রকম করে স্বচ্ছ ব্যালটবাক্সে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছিল, তা সবার প্রশংসা পেয়েছিল। এর মাধ্যমে যে নেতৃত্ব বেরিয়ে এসেছিল, তার ওপর আজ হয়তো অনেকেই হতাশ। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, এ অবস্থার দায় সব তাদের নয়। এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে এই পদ্ধতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে এই সরকার বিব্রত। বিভিন্ন মন্ত্রী, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর আচরণে ও উচ্চারণে এটা বোঝা গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন অনেকেই আশা করেছিল যে একটা কিছু হবে। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের বারো-চৌদ্দবার দেশের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। প্রতিবারই জনতার অনুরোধে ও চাপে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপও ছাত্রলীগের মধ্যে সে রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে, এটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের নেত্রীকে তাঁর পদে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন, কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর মত পাল্টাননি। তিনি কি ভেবেছিলেন এতে ছাত্রলীগ শুধরে যাবে? না, ছাত্রলীগ শোধরায়নি। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
কেন? যে নেতার কথা ছাড়া আওয়ামী লীগের গাছের পাতা নড়ে না, যাঁর ইশারায় দল ও দেশের বাঘা বাঘা ব্যক্তি ও নেতারা ধরাশায়ী হন, তাঁর কথা ছাত্রলীগের তরুণ নেতা-কর্মীরা মানবে না? ব্যাপারটা ভাবার মতো ছিল, গভীরভাবে ভাবা উচিত ছিল, যা হয়নি।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া মোটামুটিভাবে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তা কার্যকর করার ফলাফল তো ভালো দেখা যাচ্ছে না। দেশব্যাপী এই নৈরাজ্যের মুখে ছাত্রলীগের তরুণ নেতৃত্বের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। যতগুলো জায়গা বা শাখা সম্পর্কে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, তার কোথায়ও তাঁরা এ প্রসঙ্গে একটি সভাও করেননি। আর এ রকম একটা পরিস্থিতি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করবেনই কীভাবে? যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা নতুন, আর সব শাখার নেতৃত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের চাইতে প্রবীণ। ফলে দেশব্যাপী তাঁদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভেবে দুঃখ লাগে যে এই নেতৃত্ব বিদায় নেবেন ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। কারণ, বর্তমান অবস্থার সব দায় তাঁদের ওপর বর্তাবে।
আমি আমার পূর্বের কথায় ফিরে আসি, শেখ হাসিনার সেই পদক্ষেপ যে কাজে লাগল না, তার কারণ এই নয় যে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে আর আগের মতো মানেন না। কারণটি হলো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক। সামনে তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে হাজারটা প্রশ্ন, তাতে বিভ্রান্ত তাঁরা। এই যে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনুরোধ শুনলেন না, তার মানে কী? এটি কি সুচিন্তিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত? নাকি তাঁর সন্তানদের পথে আনার জন্য একটি আবেগপ্রসূত কাঠিন্য?
পাঠক, এই লেখক একজন রাজনীতির সন্তান। আমার রাজনীতির পাঠশালার নাম ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ তথা ছাত্র আন্দোলনের অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে এই বর্তমানেও গর্ববোধ করি আমি। এই যে জরুরি অবস্থার সময় ছাত্ররা আন্দোলন করল, বলা যায় দুই বছরে এই একটিই উদাহরণ, যার কাছে পেছনে থাকা সামরিক জান্তা পরাজিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগসহ কোনো রাজনৈতিক দলেরই উল্লেখ করার মতো ভূমিকা ছিল না তখন। কিন্তু এ-ও ঠিক, ছাত্র আন্দোলনের এই সুদীর্ঘ গৌরবগাথায় বর্তমানে কলঙ্কের দাগ লেগেছে। কারা করেছে সেগুলো? এ দেশের ছোট বা মাঝারি আকারের ছাত্রসংগঠনগুলো, যারা কোনো দিন ক্ষমতার স্বাদ পায়নি, তাদের এ সমস্যা নেই। এই সমস্যার ভিত্তি হলো ক্ষমতা। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই ছাত্রলীগ সামনে এসেছে। গতকাল বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন ছাত্রদল এসব করেছে। ক্ষমতাকে বুঝতে হবে যে তাদেরও পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার, অন্য সবকিছু পরিচ্ছন্ন করা দরকার। এটা কেবল আবেগ দেখানোর ব্যাপার নয়। আমি বরং বলব, একেবারে আবেগমুক্ত হয়ে গলদটা কোথায়, তা খুঁজে বের করতে হবে এবং এর মূল উৎপাটন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব ওবায়দুল কাদের (যিনি দীর্ঘদিন ছাত্ররাজনীতি করেছেন, ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, ছাত্রলীগের দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওকে কমিশনের প্রধান ছিলেন) সার্বিক ঘটনায় তাঁর হতাশা, দুঃখ ও লজ্জার কথা বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, যেন দ্রুত বিচার আইনে অপরাধীদের বিচার করা হয়।
অপরাধী কারা? কয়জন? আমি আমার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবং বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখেছি, অপরাধীর সংখ্যা সাধারণের তুলনায় সব সময় কম থাকে। এই অপরাধীদের ঠিকমতো খুঁজে বের করতে হবে এবং তাদেরই শাস্তি দিতে হবে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে গেলে ভয় পেলে চলবে না। কিন্তু খেয়াল করতে হবে, মাটি খুঁড়তে গিয়ে পুরো জমিটাই যেন নষ্ট করে না ফেলি। আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে যেন বাগান উজাড় হয়ে না যায়। ছাত্রলীগে যা কলুষ তা থেকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু তার মানে ছাত্রলীগ থেকে মুক্ত হওয়া নয়। আমি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে তো নয়ই, এমনকি সাময়িকভাবে এর কার্যক্রম স্থগিত করারও বিপক্ষে। আমি বরং লাগাতারভাবে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের সব অপশক্তি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে চাই। ছাত্রলীগকে দুর্বল বা অস্বীকার করলে অন্যরা বেড়ে যাবে, যাদের বেড়ে যাওয়া আমি চাই না।
পত্রিকায় পড়লাম, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ছাত্রলীগের সভায় যেতে অস্বীকার করেছেন। এমনকি অন্য কোনো সংগঠনের সভায় যদি ছাত্রলীগের নেতারা উপস্থিত থাকেন, সেখানেও যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। আমি খুব অবাক হয়েছি। বেগম মতিয়া চৌধুরী এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। মন্ত্রী ও নেতা হিসেবে তাঁর মতো সৎ ও নিষ্ঠ মানুষও বিরল। সেই তিনি যদি সত্যিই এ রকম বলে থাকেন, তবে তো ধরে নিতে হবে যে ছাত্রলীগ একেবারে পচে গেছে, যার কাছেও যাওয়া যায় না। ব্যাপারটা কি সত্যি এ রকম? ছাত্রলীগ একেবারে পচে গেছে? নিশ্চয়ই না। ছাত্রলীগে অবশ্য পচন ধরেছে। কিন্তু এখনো ঠিকমতো সততার সঙ্গে ব্যক্তি, গ্রুপ, আঞ্চলিকতা, আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে উঠে শুদ্ধি অভিযান চালালে ছাত্রসংগঠনকে আবারও সম্মানের জায়গায় আনা যাবে।
পত্রিকায় দেখলাম, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে এবং আগামী মাসেই গঠন করা হচ্ছে নতুন কমিটি। এটি একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, পদক্ষেপটা নিল কে বা কারা? এটা কি ছাত্রলীগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা উপলব্ধি? নাকি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে এ কথা বুঝতে হবে যে এখন ছাত্রলীগকে সক্রিয়ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কিংবা মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য কেবল এই বিবেচনায় গ্রহণ ও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য হতে পারে। ওকে কমিশন কিংবা বর্তমানে আওয়ামী লীগের তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল এই বিবেচনাতেই সঠিক হতে পারে। সহযোগী সংগঠন হিসেবে তাঁরা ছাত্রলীগকে আজকের রাজনীতির প্রয়োজন ও চাহিদা বোঝাবেন, তাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবেন এবং সতর্ক করে দেবেন এই বলে যে এর ব্যত্যয় হলে মূল দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকবে না।
এবার মূল প্রতিপাদ্যে আসি। নতুন কমিটির নেতৃত্বের খোঁজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাকে—এই খবর পড়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছি। দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে না, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসন চলে, তখন গোয়েন্দাদের রাজত্ব চলে। কিন্তু এই গোয়েন্দারা বিডিআর বিদ্রোহ ঠেকাতে পারে না; বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবরই রাখে না; নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার নামে সমগ্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের মধ্যে এ ধরনের চিন্তা কাজ করছে, তা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমি আশা করব, এই সংবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হবে।
পত্রিকায় এ-ও পড়লাম, ছাত্রলীগের এই কমিটি ভেঙে দিয়ে আগামী জুনে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হবে। এটি একটি ভালো খবর। গতবার যে রকম করে স্বচ্ছ ব্যালটবাক্সে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছিল, তা সবার প্রশংসা পেয়েছিল। এর মাধ্যমে যে নেতৃত্ব বেরিয়ে এসেছিল, তার ওপর আজ হয়তো অনেকেই হতাশ। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, এ অবস্থার দায় সব তাদের নয়। এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে এই পদ্ধতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
No comments