মন্দা-ইউরোপীয় ইউনিয়নে মহাসংকট by সুজিত চৌধুরী
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের ঘন কুয়াশা কেটে গেছে; চটজলদি এই সিদ্ধান্তে যাঁরা পৌঁছেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপীয় মুদ্রাব্যবস্থার বর্তমান মহাসংকট তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। গ্রিসের অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ ‘ইউরো’ মুদ্রাব্যবস্থার ওপর বিরাট আঘাত।
যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদনে গ্রিসের অবস্থান মাত্র তিন শতাংশ। ইউরোপের এই ঐতিহ্যবাহী দেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া। গ্রিস সরকার কর বাড়াচ্ছে, পেনশন কমিয়ে দিচ্ছে, পেনশনে যাওয়ার বয়সসীমা বাড়িয়ে দিচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে ১৩ এবং ১৪ মাসের বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এফআইএমএফ ঋণ সাহায্য দিতে গিয়ে এই শর্তগুলো মেনে নিতে বাধ্য করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে বিশ্বের আর্থিক বাজারে যে মহাসংকট ২০০৭ থেকে পৃথিবীব্যাপী পণ্য আদান-প্রদানে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত কিছু দেশের উৎপাদনব্যবস্থার ওপর এত বড় আঘাত হানতে পারে, আগে কেউ এভাবে ভাবেনি। গ্রিসে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিশ্ববাজারে, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমন মার্কেটে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। গ্রিসের এই মহাদুর্যোগ অপ্রত্যাশিতভাবে এসেছে বলা যাবে না।
সংকট গ্রিসে রাজনৈতিক চেহারাও নিয়েছে। ব্যাপক জনবিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘাত ও ধর্মঘট-অবরোধে বেশ কয়েকজন নিহতও হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়-দায়িত্ব নিয়েও। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নব্য সদস্য দেশগুলোয় সংকট বরাবর ছিল। মাত্র কিছুদিন আগে হাঙ্গেরি সরকার বাজেট কাটছাঁট করেছে। হাঙ্গেরিতেও সংকটের মূল বোঝা টানতে হয়েছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে। জার্মানি ৪৮০ বিলিয়ন ‘ইউরো’র গ্যারান্টি দিয়ে তাদের ধসে পড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুসংগঠিত করতে পেরেছে। জার্মানিতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। জোট শরিক নয়া উদারবাদীদের দল চেষ্টা করেছে জার্মান সরকারের ঋণের বোঝা শ্রমজীবী এবং নিম্নবিত্তের ঘাড়ে চাপাতে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, নিম্নতম মজুরির সীমারেখা কমানো যাবে না। কর্মজীবীদের কর্মসংস্থানের আইনগত গ্যারান্টিও তুলে নেওয়া যাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে জার্মানি সংকট মোকাবিলায় অবশ্যই সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। জার্মানি মূলত রপ্তানিমুখী অর্থনীতি। ‘ইউরো’ মুদ্রাব্যবস্থার কারণে জার্মানরাই সবচেয়ে লাভবান। জার্মানির রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ যায় ইউরোজোনের দেশগুলোতে। মুদ্রা অবমূল্যায়নের সুযোগ না থাকাতে জার্মান পণ্য ইউরো বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে যাচ্ছে।
পুঁজিবাদী মুক্তবাজারে সংকট আসে চক্রাকারে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সংকট ব্যতিক্রমধর্মী। ইউরোপীয় মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ রয়েছে। স্পেন ও পর্তুগালের অবস্থাও নড়বড়ে। স্পেনে বেকারের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। জার্মানির মতো সংঘবদ্ধ সামাজিক গ্যারান্টি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে নেই। কর্মজীবীদের পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। স্পেনে বসবাসকারী অনেক প্রবাসী এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা সুশৃঙ্খল রাখার দিকে সব সময় সতর্ক নজর রেখেছে। কিন্তু মুদ্রাব্যবস্থা তো আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রতিবিম্ব। উৎপাদিত পণ্য এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পরিবর্তন করার যোগ্যতা না থাকলে শিল্পোন্নত দেশেও সংকট উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করে আর জমানো টাকার প্রতি হাত দেয় না। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমতে থাকে। গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগালের মূল সমস্যা এখানেই। বিশ্ব অর্থবাজারের গভীর সংকট কাটিয়ে উঠতেই এই অর্থনীতিগুলো হিমশিম খেয়েছে। বিশ্ববাজারে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় পণ্যসম্ভারে পরিবর্তনের যে দ্রুতগতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তাদের হার মানতে হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুর্বল সংকেত শুধু মুদ্রনীতি দিয়ে সংশোধন করা যায় না। ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ে এখন অনেকে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনের মতো দুর্বল উৎপাদনকাঠামোর অর্থনীতিগুলোকে ইউরো-এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব এসে পড়েছে। তাতে করে তারা নিজস্ব মুদ্রা অবমূল্যায়ন করে পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুযোগ করে নিতে পারত। এ রকম ধারণা এখন আর অজনপ্রিয় নয়। একটি শক্তিশালী মুদ্রাব্যবস্থা সরাসরি একটি গতিশীল উৎপাদনব্যবস্থার গ্যারান্টি নয়। শক্তিশালী ‘ইউরো’ও দুর্বল অর্থনীতি সবল করতে ব্যর্থ।
জার্মানি ও ফ্রান্স ইউরো মুদ্রাব্যবস্থার এই দুই বৃহৎ অর্থনীতি নিজস্ব স্বার্থে চাইবে না মুদ্রাব্যবস্থায় ফাটল লাগুক। গ্রিসকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। গ্রিসের অর্থনীতি চাঙা করার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রিস সরকার কি গজিয়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে? কর্মজীবীরাই বা কেন বারবার সরকার ও শিল্পপতিদের তৈরি করা সংকটের বোঝা বহন করতে থাকবে। সংকটের বোঝা ভাগাভাগি করে নেওয়ার আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এখানে জার্মানির অর্থনীতিবিদদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বিতর্ক উল্লেখযোগ্য। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কর্মজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া চাহিদা বাড়বে না, মানুষ কেনাকাটা করবে না। গ্রিসে মজুরি কমানোর প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। সংকট গভীর হলে তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়। আরেক দল অর্থনীতিবিদ বলছেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের পারস্পরিক সহযোগিতা আর আগের মতো শক্তিশালী নয়, যে যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সামগ্রিক সমস্যায় ওদের দায়বদ্ধতাও কম নয়।
জার্মানি ও ফ্রান্সের কয়েকটি বড় ব্যাংক গ্রিসকে সাত বিলিয়ন ইউরো সাহায্য দিতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে। একদল অর্থ-সাংবাদিক খুঁজে বের করেছে এখানে সুনির্দিষ্ট স্বার্থ জড়িত। গ্রিস সরকারের জার্মান ব্যাংকগুলোতে ২৭ বিলিয়ন ইউরো এবং ফ্রান্সের ব্যাংকগুলোতে ৩০ বিলিয়ন ইউরোর ঋণপত্র রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো নিজের স্বার্থেই এসব ঘোষণা দিচ্ছে। গ্রিসের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে ওরা ওদের অর্থ আর পাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ‘ইউরো’র স্থিতিশীলতা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অতীব প্রয়োজন। তবে স্বার্থদ্বন্দ্বে যদি সব প্রতিষ্ঠান সাহায্যের নামে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন এসে যেতে পারে এবং এসেছে। ইউরোপে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের কিছু জরুরি প্রশ্নও রয়েছে। কেন এখন হঠাৎ রেটিং এজেন্সিগুলোকে স্পেন এবং পর্তুগাল নিয়ে এত সতর্কবাণী করতে হচ্ছে। ইউরোপের বড় বড় অর্থনীতি আগে কি এই অশনিসংকেত শুনতে পায়নি? এটাও তো একধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শুধু অর্থনীতিবাদী ক্লাব হলেই চলবে না। ইউনিয়ন সৃষ্টির শুরুতে যেমন রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা আসল ব্যাপার ছিল, এখনো শক্তিশালী অর্থনীতিগুলোর রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করা উচিত। নাহলে গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট যেভাবে রাজনৈতিক সংকটে গড়িয়েছে, যেভাবে জনবিক্ষোভ ও সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেই একই পরিণতি থেকে ইউরোপের অন্য দেশগুলো কতটা মুক্ত থাকবে তা বলা যায় না।
এবং এটাও ভাবা দরকার যে, চক্রাকারে আবর্তিত অর্থনৈতিক সংকটের ঢেউ বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের গায়ে লাগতে কতটা দেরি। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে সংকটে কারো কারো সুবিধা, কিন্তু সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যখন সংকটে পড়ে তখন দুর্বলদের খেসারত দিতে হয় সবচেয়ে বেশি।
সুজিত চৌধুরী: জার্মান প্রবাসী অর্থনীতিবিদ, বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে বিশ্বের আর্থিক বাজারে যে মহাসংকট ২০০৭ থেকে পৃথিবীব্যাপী পণ্য আদান-প্রদানে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত কিছু দেশের উৎপাদনব্যবস্থার ওপর এত বড় আঘাত হানতে পারে, আগে কেউ এভাবে ভাবেনি। গ্রিসে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিশ্ববাজারে, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমন মার্কেটে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। গ্রিসের এই মহাদুর্যোগ অপ্রত্যাশিতভাবে এসেছে বলা যাবে না।
সংকট গ্রিসে রাজনৈতিক চেহারাও নিয়েছে। ব্যাপক জনবিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘাত ও ধর্মঘট-অবরোধে বেশ কয়েকজন নিহতও হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়-দায়িত্ব নিয়েও। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নব্য সদস্য দেশগুলোয় সংকট বরাবর ছিল। মাত্র কিছুদিন আগে হাঙ্গেরি সরকার বাজেট কাটছাঁট করেছে। হাঙ্গেরিতেও সংকটের মূল বোঝা টানতে হয়েছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে। জার্মানি ৪৮০ বিলিয়ন ‘ইউরো’র গ্যারান্টি দিয়ে তাদের ধসে পড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুসংগঠিত করতে পেরেছে। জার্মানিতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। জোট শরিক নয়া উদারবাদীদের দল চেষ্টা করেছে জার্মান সরকারের ঋণের বোঝা শ্রমজীবী এবং নিম্নবিত্তের ঘাড়ে চাপাতে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, নিম্নতম মজুরির সীমারেখা কমানো যাবে না। কর্মজীবীদের কর্মসংস্থানের আইনগত গ্যারান্টিও তুলে নেওয়া যাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে জার্মানি সংকট মোকাবিলায় অবশ্যই সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। জার্মানি মূলত রপ্তানিমুখী অর্থনীতি। ‘ইউরো’ মুদ্রাব্যবস্থার কারণে জার্মানরাই সবচেয়ে লাভবান। জার্মানির রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ যায় ইউরোজোনের দেশগুলোতে। মুদ্রা অবমূল্যায়নের সুযোগ না থাকাতে জার্মান পণ্য ইউরো বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে যাচ্ছে।
পুঁজিবাদী মুক্তবাজারে সংকট আসে চক্রাকারে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সংকট ব্যতিক্রমধর্মী। ইউরোপীয় মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ রয়েছে। স্পেন ও পর্তুগালের অবস্থাও নড়বড়ে। স্পেনে বেকারের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। জার্মানির মতো সংঘবদ্ধ সামাজিক গ্যারান্টি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে নেই। কর্মজীবীদের পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। স্পেনে বসবাসকারী অনেক প্রবাসী এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা সুশৃঙ্খল রাখার দিকে সব সময় সতর্ক নজর রেখেছে। কিন্তু মুদ্রাব্যবস্থা তো আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রতিবিম্ব। উৎপাদিত পণ্য এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পরিবর্তন করার যোগ্যতা না থাকলে শিল্পোন্নত দেশেও সংকট উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করে আর জমানো টাকার প্রতি হাত দেয় না। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমতে থাকে। গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগালের মূল সমস্যা এখানেই। বিশ্ব অর্থবাজারের গভীর সংকট কাটিয়ে উঠতেই এই অর্থনীতিগুলো হিমশিম খেয়েছে। বিশ্ববাজারে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় পণ্যসম্ভারে পরিবর্তনের যে দ্রুতগতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তাদের হার মানতে হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুর্বল সংকেত শুধু মুদ্রনীতি দিয়ে সংশোধন করা যায় না। ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ে এখন অনেকে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনের মতো দুর্বল উৎপাদনকাঠামোর অর্থনীতিগুলোকে ইউরো-এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব এসে পড়েছে। তাতে করে তারা নিজস্ব মুদ্রা অবমূল্যায়ন করে পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুযোগ করে নিতে পারত। এ রকম ধারণা এখন আর অজনপ্রিয় নয়। একটি শক্তিশালী মুদ্রাব্যবস্থা সরাসরি একটি গতিশীল উৎপাদনব্যবস্থার গ্যারান্টি নয়। শক্তিশালী ‘ইউরো’ও দুর্বল অর্থনীতি সবল করতে ব্যর্থ।
জার্মানি ও ফ্রান্স ইউরো মুদ্রাব্যবস্থার এই দুই বৃহৎ অর্থনীতি নিজস্ব স্বার্থে চাইবে না মুদ্রাব্যবস্থায় ফাটল লাগুক। গ্রিসকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। গ্রিসের অর্থনীতি চাঙা করার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রিস সরকার কি গজিয়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে? কর্মজীবীরাই বা কেন বারবার সরকার ও শিল্পপতিদের তৈরি করা সংকটের বোঝা বহন করতে থাকবে। সংকটের বোঝা ভাগাভাগি করে নেওয়ার আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এখানে জার্মানির অর্থনীতিবিদদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বিতর্ক উল্লেখযোগ্য। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কর্মজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া চাহিদা বাড়বে না, মানুষ কেনাকাটা করবে না। গ্রিসে মজুরি কমানোর প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। সংকট গভীর হলে তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়। আরেক দল অর্থনীতিবিদ বলছেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের পারস্পরিক সহযোগিতা আর আগের মতো শক্তিশালী নয়, যে যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সামগ্রিক সমস্যায় ওদের দায়বদ্ধতাও কম নয়।
জার্মানি ও ফ্রান্সের কয়েকটি বড় ব্যাংক গ্রিসকে সাত বিলিয়ন ইউরো সাহায্য দিতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে। একদল অর্থ-সাংবাদিক খুঁজে বের করেছে এখানে সুনির্দিষ্ট স্বার্থ জড়িত। গ্রিস সরকারের জার্মান ব্যাংকগুলোতে ২৭ বিলিয়ন ইউরো এবং ফ্রান্সের ব্যাংকগুলোতে ৩০ বিলিয়ন ইউরোর ঋণপত্র রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো নিজের স্বার্থেই এসব ঘোষণা দিচ্ছে। গ্রিসের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে ওরা ওদের অর্থ আর পাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ‘ইউরো’র স্থিতিশীলতা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অতীব প্রয়োজন। তবে স্বার্থদ্বন্দ্বে যদি সব প্রতিষ্ঠান সাহায্যের নামে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন এসে যেতে পারে এবং এসেছে। ইউরোপে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের কিছু জরুরি প্রশ্নও রয়েছে। কেন এখন হঠাৎ রেটিং এজেন্সিগুলোকে স্পেন এবং পর্তুগাল নিয়ে এত সতর্কবাণী করতে হচ্ছে। ইউরোপের বড় বড় অর্থনীতি আগে কি এই অশনিসংকেত শুনতে পায়নি? এটাও তো একধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শুধু অর্থনীতিবাদী ক্লাব হলেই চলবে না। ইউনিয়ন সৃষ্টির শুরুতে যেমন রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা আসল ব্যাপার ছিল, এখনো শক্তিশালী অর্থনীতিগুলোর রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করা উচিত। নাহলে গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট যেভাবে রাজনৈতিক সংকটে গড়িয়েছে, যেভাবে জনবিক্ষোভ ও সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেই একই পরিণতি থেকে ইউরোপের অন্য দেশগুলো কতটা মুক্ত থাকবে তা বলা যায় না।
এবং এটাও ভাবা দরকার যে, চক্রাকারে আবর্তিত অর্থনৈতিক সংকটের ঢেউ বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের গায়ে লাগতে কতটা দেরি। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে সংকটে কারো কারো সুবিধা, কিন্তু সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যখন সংকটে পড়ে তখন দুর্বলদের খেসারত দিতে হয় সবচেয়ে বেশি।
সুজিত চৌধুরী: জার্মান প্রবাসী অর্থনীতিবিদ, বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক।
No comments