ইতিউতি-মূল্যস্ফীতি সংকট এখনো কাটেনি by আতাউস সামাদ
কী বলব? দুঃখজনক ঘটনা নাকি জীবন ও সময়ের কঠিন করাঘাত? গত বুধবার রাতে একটা পাউরুটি কিনলাম। দাম ২৮ টাকা। এই একই রুটির মূল্য মাস দেড়-দুয়েক আগে বোধ হয় ছিল ২০ টাকা। সপ্তাহ দুয়েক আগে শুনলাম ওটার দাম হয়েছে ২২ টাকা। তা থেকে বেড়ে এক সপ্তাহ আগে হয়েছিল ২৫ টাকা। তারপর ২৮ টাকা।
কালের কণ্ঠ পত্রিকায় এ লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার আগেই যদি এর দাম ৩০ টাকা হয়ে যায়, তাহলেও বিস্মিত হব না। কারণ, আপাতত মূল্যস্ফীতির এটাই তো ধারা। রুটি প্রস্তুতকারক বেকারিটির অধিকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ওনারা হয়তো বুঝিয়ে দিতেন কেন রুটির দাম বেড়েছে। হয়তো বলতেন, বিশ্ববাজারে গমের দামের সঙ্গে সংগতি রেখেই রুটির দাম বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে খাদ্যশস্যের দাম কম_এ কথা তো প্রধানমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী সবাই বলেছেন ও বলছেন। বেকারি কর্তৃপক্ষ হয়তো এও বলতেন যে রুটির প্যাকেজিংয়ের খরচ বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ হঠাৎ করে চলে যেতে থাকলে উৎপাদন প্রক্রিয়াধীন যে আটা-ময়দা নষ্ট হয় সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার বিষয় আছে। শ্রমিক মজুরি বেড়ে গেছে_হয়তো সবই ছহি কথা অথবা অন্তত কিছুটা তো বটেই।
আবার কেউ হয়তো এ কথাও বলবেন, পাউরুটি খাবার এত শখ কেন? ঘরে বানানো আটার রুটি খেলেই হয়। তবে খেয়াল করে দেখুন, সেখানেও কিন্তু খরচ আছে_পানি, বৈদ্যুতিক আলো, আটা এসবেরও মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। চুলার গ্যাসের হবে। তা ছাড়া পাউরুটি শব্দটা শুনলে যদি ক্রেতার মধ্যবিত্ত বা তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার গন্ধ থাকে এবং সে ক্ষেত্রে তাঁর জন্য মূল্যস্ফীতি সহনীয়_এমন যুক্তি দাঁড় করাতে চান কেউ, তাঁদের সবিনয় বিবেচনার জন্য বলি, বহু গতরে খেটে খাওয়া মানুষ, যেমন রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, ঠেলা গাড়িওয়ালা দুপুরের খাওয়াটা পথের পাশেই সেরে নেন এক কাপ চা আর সঙ্গে একটা 'বন' (বনরুটি) দিয়ে। সেই বনরুটির দামও বাড়ছেই, আর দাম না বাড়লে তা আকারে ছোট হচ্ছে।
রুটির দাম প্রসঙ্গটি মনে পড়ার সঙ্গে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নেওয়া এক ব্রিটিশ সৈনিকের কথা মনে পড়ে। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ইপস উইচ শহরে আমার সম্বন্ধি প্রয়াত ডাক্তার আনোয়ারুল হকের বাড়িতে। আমার স্ত্রী ও আমি চিকিৎসার জন্য তাঁর বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। ডাক্তার সাহেব ও ভাবি, যার যার কাজে গেছেন। বাচ্চারা স্কুলে। সেদিন দুপুরে ওই বাড়িতে আমরা দুইজন। হঠাৎ কলিং বেল বাজল। কাচের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, দরজায় এক বৃদ্ধ। দরজা খুললে তিনি বললেন যে তিনি এ বাড়ির বাগানের মালি। বাড়ির সামনের ও ভেতরের বাগান পরিষ্কার করতে এসেছেন। আমরা যেন অচেনা মানুষ দেখে ভয় না পাই, বাড়ির পাশ দিয়ে উঠানে ঢোকা দরজা দিয়ে তিনি পেছনে চলে গেলেন। একটা শেডের ভেতর রাখা কাঁচি, ছুরি, শাবল, বেলচা বের করে বাগান পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন। আমরা দরজা খোলার সময় টের পেয়েছিলাম যে বাইরে খুব ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বৃদ্ধ ওই বাতাসেই একমনে কাজ করছেন। গায়ে একা জ্যাকেট ও হাতে মোটা দস্তানা। ওভাবে কাজ করতে দেখে একসময় তাঁকে ডেকে বললাম, 'এক কাপ চা খাবেন! বাইরে তো খুব ঠাণ্ডা।' তিনি বললেন, 'থ্যাংক ইউ, তবে কাজ শেষ করে নিই।' আধঘণ্টা পর তিনি বললেন, চা খেতে তৈরি। আমরা তিনজনই চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে আরেকটু বিস্তারিত পরিচিত হলাম। তিনি বললেন, তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ছিলেন। নরওয়ে ও সুইডেনের ফিয়র্ডগুলোতে তাঁদের জাহাজ জার্মান ইউ বোট ও যুদ্ধজাহাজের খোঁজে থাকত। তাঁদের সঙ্গেই প্রহরারত আরেক ব্রিটিশ জাহাজ ঘায়েল হলে তার নাবিকদের কিভাবে সাগর থেকে টেনে তুলেছিল তাঁদের জাহাজ সে কথা বললেন। যুদ্ধ শেষে নৌবাহিনীর চাকরি শেষ। পরে কর্মজীবনের বেশির ভাগ কেটেছে একটি স্থানীয় সরকারের ক্লার্কের পদে। এখন অবসরে আছেন। যুদ্ধের কাহিনী প্রসঙ্গে থাকার সময় প্রশ্ন করেছিলাম, 'উইনস্টন চার্চিল কেমন নেতা ছিলেন।' উত্তর দিলেন, 'আমি তাঁকে খুব গ্রেট মনে করি না। অবশেষে জানতে চাইলাম, 'এই ঠাণ্ডার মধ্যে গার্ডেনারের কাজ করছেন কেন?' বৃদ্ধ সৈনিক ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন, "কী করব! জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কাউন্সিল ট্যাঙ্ বেড়েছে। আর আমার 'মিসাস' (স্ত্রী) নরম হয়ে গেছেন। তাঁর জন্য নিয়মিত ওষুধ কিনতে হয়। আই হ্যাড টু টেক কেয়ার অব দ্য ওল্ড লেডি।" বলে স্মিত হেসে চায়ের মগে শেষ চুমুক দিয়ে ওটা রান্নাঘরের বেসিনে রাখতে রাখতে বললেন, 'আমাকে এখন যেতে হবে আরেকটা বাগান পরিষ্কার করার জন্য। গরম চায়ের জন্য ধন্যবাদ। আই অ্যাম ফিলিং ওয়ার্ম।'
বৃদ্ধ চলে গেলে আমরা দুইজন খানিকক্ষণ আলাপ করেছিলাম বৃদ্ধ বয়সে কর্মজীবনের অর্জিত আয় থেকে সঞ্চয় ও পেনশন দিয়ে চলতে না পারার কষ্টের কথা, বেদনার কথা। এই বৃদ্ধের এখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও কর বৃদ্ধির জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তা আর হচ্ছে না। কায়িক পরিশ্রম করে বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যেদিন নির্বাচিত হন, সেদিনও তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'আমরা জানি এ মুহূর্তে বহু আমেরিকান তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজেরা জেগে জেগে ভাবছেন আগামীকাল বাড়ির কিস্তি বা কলেজের বেতন জোগাড় করবেন কোথা থেকে।' বাংলাদেশে আমাদের অনেকেই কিন্তু সেই বৃদ্ধ ব্রিটিশ সৈনিক বা বর্তমানের দুর্দশাগ্রস্ত অর্থ সংকটে পতিত মার্কিন নাগরিকদের মতো অবস্থায় আছি। আমাদের অনেককেই বৃদ্ধ বয়সে, একবার অবসরে যাওয়ার পর, আবার কিছু না কিছু আয় করার কথা ভাবতে হচ্ছে। এবং আমাদের অনেকের পক্ষেই উপার্জন করা খুব কঠিন কাজ, প্রথমত, বার্ধক্যের দরুন শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তির দরুন, দ্বিতীয়ত, সুবিধা মতো কাজের ক্ষেত্র ও সুযোগ না থাকার কারণে এবং তৃতীয়ত, সামাজিক অস্বস্তির ফলে বাধার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে যখন কথা বলেন, আমি সাধারণত তাঁদের বিশ্বাস করি। কারণ শেখ হাসিনা ও মতিয়া চৌধুরী ১৯৯৮-এর দীর্ঘ বন্যা থেকে সৃষ্ট কঠিন খাদ্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন সফলভাবে। খাদ্যমন্ত্রী ড. রাজ্জাক সরকারের হাতে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য আছে ও কী পরিমাণ আমদানির ব্যবস্থা হয়েছে, এ সম্পর্কে বা ওএমএস সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে দ্বিধা করেন না। তবে প্রধানমন্ত্রী যে দুই বেলা, তিন বেলা ও চার বেলা খাদ্য গ্রহণ করে এমন ব্যক্তিদের কথা বলেছেন, তাতে একটা আত্মতৃপ্তির ভাব আছে বলে অনুমান করি। এবার কিন্তু তিন বেলা ও চার বেলা খাইয়েরা কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময়ও ছিলেন এবং থাকবেন। রাজনীতিবিদ ও খ্যাতিমান লেখক আবুল মনসুর আহমদের 'ফুড কনফারেন্স' নামক ব্যঙ্গাত্মক লেখাতেও এঁদের দেখা পাওয়া যায়। আমার অনুরোধ যে এই সৌভাগ্যবান বা করিৎকর্মাদের দেখে কেউ যেন কর্মহীন, সাময়িকভাবে উপার্জনকারী, স্থির আয় এবং বাধ্য হয়ে শ্রমদানকারী বৃদ্ধ ও উপার্জনের জন্য অবসর থেকে আবার কাজে ফিরে আসা সীমিত আয়ের মানুষদের কথা ভুলে না যান। এ ক্ষেত্রে একটি সামাজিক পরিবর্তনের কথাও বলে রাখা প্রয়োজন। আমাদের যৌবনে যে যৌথ পরিবার প্রথা ছিল, তা প্রায় বিলুপ্ত_আমাদের দেশেও। সকলেই আর সকলের তরে নেই। এখন প্রায় সবাই আপনার তরে। এ ক্ষেত্রে বিবিধ কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছেন যাঁরা, তাঁরা অসুবিধাতেই আছেন। ফলে বহু মানুষ খুব কষ্টে আছেন সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির দরুন। আর মূল্যস্ফীতি ঘটছেই_জীবন ধারণের সর্বক্ষেত্রে। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। সে জন্যই পাউরুটির দাম দফায় দফায় বাড়তে থাকা ও বৃদ্ধ ব্রিটিশ সৈনিকের উদাহরণ দুটি উপস্থাপন করেছি। এখন সরকারের কর্তব্য হয় মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা অথবা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে চলা যায় এমনভবে বেতন ও মজুরি বাড়ে এবং বহু ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন নীতি গ্রহণ করা।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও দুর্নীতি থেকে আসা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। সম্প্রতি শেয়ারবাজারে যে বিশাল ধস হয়েছিল, যা ১৯৯৬-এর মহাধসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তা কিন্তু দুর্নীতির ফলে ঘটেছে। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত তদন্ত কমিটির প্রধান খালেদ ইব্রাহীম ইতিমধ্যে বলেছেন, বেআইনি না হলেও অনৈতিক কাজ যে হয়েছে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আর বাংলাদেশ খুঁজে পেয়েছে দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যাওয়ার পদচিহ্ন। এর সঙ্গে কিছু বিদেশি ব্যাংকও জড়িত। এসব দুর্নীতি দেশের মানুষের উপার্জনের পথ বন্ধ করে। মুদ্রা পাচারের জন্য ডলার সংকট থেকে কিছু মূল্যস্ফীতি হবেই। অর্থনীতিও দুর্বল হবে। এর সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ দলের বাইরের লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করছে। এটাও দুর্নীতি।
আদমশুমারির সাফল্যের জন্য সম্প্রতি প্রচার করা হচ্ছে কেউ যেন প্রতিবন্ধীদের ঘরে লুকিয়ে না রাখেন। ওই প্রচার শুনে মনে পড়ল আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীরা কাজ পায় খুব কমই। দৈহিক প্রতিবন্ধী ছাড়া আরেক ধরনের অসুবিধা বা বাধাগ্রস্ত মানুষ আছেন যাঁরা জন্মের সময় কোনো কারণে অথবা পরে কোনো মারাত্মক অসুখ অথবা শৈশবে অপুষ্টির জন্য সব সময় ঠিক আর দশজনের মতো করে কথা বলেন না অথবা প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা পাস করার মতো করে লিখতে বা পড়তে পারেন না। কিন্তু তাঁরা অনেক কাজই খুব সুন্দর করে করতে পারেন। তাঁদের অনেকেরই অন্যের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা ও মানসিকতা আছে এবং পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রখর। কিন্তু আমাদের এ রকম নাগরিকদের জন্য দেশে কোনো কর্মসংস্থানই নেই। তাই এঁরা বেকার এবং স্বভাবতই পরিবারের অন্যদের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। মূল্যস্ফীতি বা অভাব-অনটনের সময় এঁরা বড়ই করুণার পাত্র হয়ে যান এবং নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে ও আয়-বৈষম্য কমলে দেশে যে স্বস্তি আসত সেই পরিবেশে এই সামাজিক বাধাগ্রস্তরাও একটু ভালো থাকতেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আবার কেউ হয়তো এ কথাও বলবেন, পাউরুটি খাবার এত শখ কেন? ঘরে বানানো আটার রুটি খেলেই হয়। তবে খেয়াল করে দেখুন, সেখানেও কিন্তু খরচ আছে_পানি, বৈদ্যুতিক আলো, আটা এসবেরও মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। চুলার গ্যাসের হবে। তা ছাড়া পাউরুটি শব্দটা শুনলে যদি ক্রেতার মধ্যবিত্ত বা তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার গন্ধ থাকে এবং সে ক্ষেত্রে তাঁর জন্য মূল্যস্ফীতি সহনীয়_এমন যুক্তি দাঁড় করাতে চান কেউ, তাঁদের সবিনয় বিবেচনার জন্য বলি, বহু গতরে খেটে খাওয়া মানুষ, যেমন রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, ঠেলা গাড়িওয়ালা দুপুরের খাওয়াটা পথের পাশেই সেরে নেন এক কাপ চা আর সঙ্গে একটা 'বন' (বনরুটি) দিয়ে। সেই বনরুটির দামও বাড়ছেই, আর দাম না বাড়লে তা আকারে ছোট হচ্ছে।
রুটির দাম প্রসঙ্গটি মনে পড়ার সঙ্গে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নেওয়া এক ব্রিটিশ সৈনিকের কথা মনে পড়ে। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ইপস উইচ শহরে আমার সম্বন্ধি প্রয়াত ডাক্তার আনোয়ারুল হকের বাড়িতে। আমার স্ত্রী ও আমি চিকিৎসার জন্য তাঁর বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। ডাক্তার সাহেব ও ভাবি, যার যার কাজে গেছেন। বাচ্চারা স্কুলে। সেদিন দুপুরে ওই বাড়িতে আমরা দুইজন। হঠাৎ কলিং বেল বাজল। কাচের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, দরজায় এক বৃদ্ধ। দরজা খুললে তিনি বললেন যে তিনি এ বাড়ির বাগানের মালি। বাড়ির সামনের ও ভেতরের বাগান পরিষ্কার করতে এসেছেন। আমরা যেন অচেনা মানুষ দেখে ভয় না পাই, বাড়ির পাশ দিয়ে উঠানে ঢোকা দরজা দিয়ে তিনি পেছনে চলে গেলেন। একটা শেডের ভেতর রাখা কাঁচি, ছুরি, শাবল, বেলচা বের করে বাগান পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন। আমরা দরজা খোলার সময় টের পেয়েছিলাম যে বাইরে খুব ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বৃদ্ধ ওই বাতাসেই একমনে কাজ করছেন। গায়ে একা জ্যাকেট ও হাতে মোটা দস্তানা। ওভাবে কাজ করতে দেখে একসময় তাঁকে ডেকে বললাম, 'এক কাপ চা খাবেন! বাইরে তো খুব ঠাণ্ডা।' তিনি বললেন, 'থ্যাংক ইউ, তবে কাজ শেষ করে নিই।' আধঘণ্টা পর তিনি বললেন, চা খেতে তৈরি। আমরা তিনজনই চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে আরেকটু বিস্তারিত পরিচিত হলাম। তিনি বললেন, তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ছিলেন। নরওয়ে ও সুইডেনের ফিয়র্ডগুলোতে তাঁদের জাহাজ জার্মান ইউ বোট ও যুদ্ধজাহাজের খোঁজে থাকত। তাঁদের সঙ্গেই প্রহরারত আরেক ব্রিটিশ জাহাজ ঘায়েল হলে তার নাবিকদের কিভাবে সাগর থেকে টেনে তুলেছিল তাঁদের জাহাজ সে কথা বললেন। যুদ্ধ শেষে নৌবাহিনীর চাকরি শেষ। পরে কর্মজীবনের বেশির ভাগ কেটেছে একটি স্থানীয় সরকারের ক্লার্কের পদে। এখন অবসরে আছেন। যুদ্ধের কাহিনী প্রসঙ্গে থাকার সময় প্রশ্ন করেছিলাম, 'উইনস্টন চার্চিল কেমন নেতা ছিলেন।' উত্তর দিলেন, 'আমি তাঁকে খুব গ্রেট মনে করি না। অবশেষে জানতে চাইলাম, 'এই ঠাণ্ডার মধ্যে গার্ডেনারের কাজ করছেন কেন?' বৃদ্ধ সৈনিক ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন, "কী করব! জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কাউন্সিল ট্যাঙ্ বেড়েছে। আর আমার 'মিসাস' (স্ত্রী) নরম হয়ে গেছেন। তাঁর জন্য নিয়মিত ওষুধ কিনতে হয়। আই হ্যাড টু টেক কেয়ার অব দ্য ওল্ড লেডি।" বলে স্মিত হেসে চায়ের মগে শেষ চুমুক দিয়ে ওটা রান্নাঘরের বেসিনে রাখতে রাখতে বললেন, 'আমাকে এখন যেতে হবে আরেকটা বাগান পরিষ্কার করার জন্য। গরম চায়ের জন্য ধন্যবাদ। আই অ্যাম ফিলিং ওয়ার্ম।'
বৃদ্ধ চলে গেলে আমরা দুইজন খানিকক্ষণ আলাপ করেছিলাম বৃদ্ধ বয়সে কর্মজীবনের অর্জিত আয় থেকে সঞ্চয় ও পেনশন দিয়ে চলতে না পারার কষ্টের কথা, বেদনার কথা। এই বৃদ্ধের এখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও কর বৃদ্ধির জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তা আর হচ্ছে না। কায়িক পরিশ্রম করে বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যেদিন নির্বাচিত হন, সেদিনও তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'আমরা জানি এ মুহূর্তে বহু আমেরিকান তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজেরা জেগে জেগে ভাবছেন আগামীকাল বাড়ির কিস্তি বা কলেজের বেতন জোগাড় করবেন কোথা থেকে।' বাংলাদেশে আমাদের অনেকেই কিন্তু সেই বৃদ্ধ ব্রিটিশ সৈনিক বা বর্তমানের দুর্দশাগ্রস্ত অর্থ সংকটে পতিত মার্কিন নাগরিকদের মতো অবস্থায় আছি। আমাদের অনেককেই বৃদ্ধ বয়সে, একবার অবসরে যাওয়ার পর, আবার কিছু না কিছু আয় করার কথা ভাবতে হচ্ছে। এবং আমাদের অনেকের পক্ষেই উপার্জন করা খুব কঠিন কাজ, প্রথমত, বার্ধক্যের দরুন শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তির দরুন, দ্বিতীয়ত, সুবিধা মতো কাজের ক্ষেত্র ও সুযোগ না থাকার কারণে এবং তৃতীয়ত, সামাজিক অস্বস্তির ফলে বাধার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে যখন কথা বলেন, আমি সাধারণত তাঁদের বিশ্বাস করি। কারণ শেখ হাসিনা ও মতিয়া চৌধুরী ১৯৯৮-এর দীর্ঘ বন্যা থেকে সৃষ্ট কঠিন খাদ্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন সফলভাবে। খাদ্যমন্ত্রী ড. রাজ্জাক সরকারের হাতে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য আছে ও কী পরিমাণ আমদানির ব্যবস্থা হয়েছে, এ সম্পর্কে বা ওএমএস সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে দ্বিধা করেন না। তবে প্রধানমন্ত্রী যে দুই বেলা, তিন বেলা ও চার বেলা খাদ্য গ্রহণ করে এমন ব্যক্তিদের কথা বলেছেন, তাতে একটা আত্মতৃপ্তির ভাব আছে বলে অনুমান করি। এবার কিন্তু তিন বেলা ও চার বেলা খাইয়েরা কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময়ও ছিলেন এবং থাকবেন। রাজনীতিবিদ ও খ্যাতিমান লেখক আবুল মনসুর আহমদের 'ফুড কনফারেন্স' নামক ব্যঙ্গাত্মক লেখাতেও এঁদের দেখা পাওয়া যায়। আমার অনুরোধ যে এই সৌভাগ্যবান বা করিৎকর্মাদের দেখে কেউ যেন কর্মহীন, সাময়িকভাবে উপার্জনকারী, স্থির আয় এবং বাধ্য হয়ে শ্রমদানকারী বৃদ্ধ ও উপার্জনের জন্য অবসর থেকে আবার কাজে ফিরে আসা সীমিত আয়ের মানুষদের কথা ভুলে না যান। এ ক্ষেত্রে একটি সামাজিক পরিবর্তনের কথাও বলে রাখা প্রয়োজন। আমাদের যৌবনে যে যৌথ পরিবার প্রথা ছিল, তা প্রায় বিলুপ্ত_আমাদের দেশেও। সকলেই আর সকলের তরে নেই। এখন প্রায় সবাই আপনার তরে। এ ক্ষেত্রে বিবিধ কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছেন যাঁরা, তাঁরা অসুবিধাতেই আছেন। ফলে বহু মানুষ খুব কষ্টে আছেন সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির দরুন। আর মূল্যস্ফীতি ঘটছেই_জীবন ধারণের সর্বক্ষেত্রে। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। সে জন্যই পাউরুটির দাম দফায় দফায় বাড়তে থাকা ও বৃদ্ধ ব্রিটিশ সৈনিকের উদাহরণ দুটি উপস্থাপন করেছি। এখন সরকারের কর্তব্য হয় মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা অথবা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে চলা যায় এমনভবে বেতন ও মজুরি বাড়ে এবং বহু ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন নীতি গ্রহণ করা।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও দুর্নীতি থেকে আসা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। সম্প্রতি শেয়ারবাজারে যে বিশাল ধস হয়েছিল, যা ১৯৯৬-এর মহাধসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তা কিন্তু দুর্নীতির ফলে ঘটেছে। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত তদন্ত কমিটির প্রধান খালেদ ইব্রাহীম ইতিমধ্যে বলেছেন, বেআইনি না হলেও অনৈতিক কাজ যে হয়েছে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আর বাংলাদেশ খুঁজে পেয়েছে দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যাওয়ার পদচিহ্ন। এর সঙ্গে কিছু বিদেশি ব্যাংকও জড়িত। এসব দুর্নীতি দেশের মানুষের উপার্জনের পথ বন্ধ করে। মুদ্রা পাচারের জন্য ডলার সংকট থেকে কিছু মূল্যস্ফীতি হবেই। অর্থনীতিও দুর্বল হবে। এর সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ দলের বাইরের লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করছে। এটাও দুর্নীতি।
আদমশুমারির সাফল্যের জন্য সম্প্রতি প্রচার করা হচ্ছে কেউ যেন প্রতিবন্ধীদের ঘরে লুকিয়ে না রাখেন। ওই প্রচার শুনে মনে পড়ল আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীরা কাজ পায় খুব কমই। দৈহিক প্রতিবন্ধী ছাড়া আরেক ধরনের অসুবিধা বা বাধাগ্রস্ত মানুষ আছেন যাঁরা জন্মের সময় কোনো কারণে অথবা পরে কোনো মারাত্মক অসুখ অথবা শৈশবে অপুষ্টির জন্য সব সময় ঠিক আর দশজনের মতো করে কথা বলেন না অথবা প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা পাস করার মতো করে লিখতে বা পড়তে পারেন না। কিন্তু তাঁরা অনেক কাজই খুব সুন্দর করে করতে পারেন। তাঁদের অনেকেরই অন্যের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা ও মানসিকতা আছে এবং পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রখর। কিন্তু আমাদের এ রকম নাগরিকদের জন্য দেশে কোনো কর্মসংস্থানই নেই। তাই এঁরা বেকার এবং স্বভাবতই পরিবারের অন্যদের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। মূল্যস্ফীতি বা অভাব-অনটনের সময় এঁরা বড়ই করুণার পাত্র হয়ে যান এবং নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে ও আয়-বৈষম্য কমলে দেশে যে স্বস্তি আসত সেই পরিবেশে এই সামাজিক বাধাগ্রস্তরাও একটু ভালো থাকতেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments