পামুকের জাদুঘর by আ আজিজ
ইস্তাম্বুল, গ্রীষ্মের এক তীব্র রোদ ঝলসানো দিন। ঔপন্যাসিক অরহান পামুক তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, চোখ নিবদ্ধ দূরের মারমার নদীর দিকে—জানালা দিয়ে মারমার আর গোল্ডেন হর্নের মিলিত স্রোতের ঝিলিক অন্যদিন সে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে। আজ তার মনে বিরক্তি, বিষণ্নও। ‘আমি একজন লেখক। আমার কাজ লেখালেখি।
কিন্তু আমি কী করছি, আমি বানাচ্ছি জাদুঘর?’ এ সময় মারমারের জল কেটে এগিয়ে আসে একটা মালবাহী জাহাজ। বেশ উঁচু স্বরে বাজানো লোকগানের আওয়াজে নিজের স্বগতোক্তি চাপা পড়ে যায়। ঘরভর্তি বইয়ের মধ্যেই তার বাঁ পাশে খানিক উঁচুতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বসা এক পাখি—শঙ্খচিল। হঠাৎ দেখে যে কারও মনে হতে পারে সে ওই প্রাণহীন পাখির সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন। আসলে তার ছড়ানো-ছিটানো বইয়ের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জাদুঘরের জন্য খুঁজে আনা নানা উপকরণ: সল্টশেকার, পোর্সেলিনের মূর্তি, অদ্ভুত দর্শন দরজার হাতল, পুরোনো লটারির টিকিট আর গ্রাইন্ডার মেশিন। হলুদ রঙের এক প্লাকার্ডে বড় বড় তুর্কি বর্ণমালায় লেখা ‘জীবনের এসব জিনিসকে আমি ভুলতে চাই না।’ অসম্ভব এক ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরছে—কত কাজ সামনে, লেকচারের প্রোগ্রাম রয়েছে হার্ভার্ডে, যে উপন্যাসটি সে এখন লিখছে, তাতেও তেমন একটা অগ্রগতি নেই। তার নতুন প্রেম ঔপন্যাসিক কিরণ দেশাইয়ের সঙ্গে বেড়ানোর পরিকল্পনাও স্থগিত হয়ে আছে। বাইরের মালবাহী জাহাজের উঁচু স্বরের গান তখনো বেজে চলেছে। ভ্রু কুঁচকে উঠল তার।
নোবেল বিজয়ী লেখক অরহান পামুকের জাদুঘর খোলার গল্পের শুরু ১০ বছর আগে, ইস্তাম্বুলেই। পামুক তখন সবে বোরহেসীয় ঘরানার উপন্যাস মাই নেম ইজ রেড শেষ করেছে, ঔপন্যাসিক হিসেবে তখনো তেমন পরিচিতি জোটেনি, কিন্তু সেই তখন থেকেই একটা প্রেমের উপন্যাসের প্লট ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে মাথায়, এক ভগ্ন হূদয় যুবকের গল্প—কেমাল, যে একই সঙ্গে যেন পামুকের আরেক প্রতিভু—পামুক নিজেই যেন নতুন উপন্যাস দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স-এর চরিত্র কেমাল। উপন্যাসের নায়ক কেমাল ইস্তাম্বুলের সম্ভ্রান্ত বংশীয় এক তরুণ তুর্কি, যে প্রেমে পড়েছে এক দরিদ্র আত্মীয়ের তরুণীকন্যা ফুসুনের। এখান থেকেই পামুক মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স-এ পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছে কয়েক যুগের ঘোর হতাশা, শ্রেণী-সংঘাত আর সামাজিক বিভাজনের বোরহেসীয় কাহিনির, পূর্ব আর পশ্চিমের চিরায়ত সাংস্কৃতিক সংঘাতের কাহিনির।
এ উপন্যাসের শেষ ভাগে ফুসুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রকম স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করেছে কেমাল, বিপুল আগ্রহ আর নিষ্ঠা নিয়ে। আর এই সংগ্রহের মধ্য দিয়েই জন্ম নিচ্ছে এক স্মৃতিঘরের, মিউজিয়াম অব ইনোসেন্সের।
এই উপন্যাসের চরিত্র কেমালের মতোই পামুক খুলছে এক স্মৃতিচিহ্নের জাদুঘর, উপন্যাসের ৮৩ পরিচ্ছেদের মতো ৮৩টি সংগ্রহ নিয়েই এই সংগ্রহশালা। ‘এই উপন্যাস আমি লিখেছি ১০ বছর ধরে’, বলছে পামুক, ‘এ সময় নানা বস্তুকে আমি ব্যবহার করেছি লেখার উপাদান হিসেবে। এসব বস্তু কখনো অনায়াসে ঢুকে গেছে আমার উপন্যাসে আবার কখনো—যখন আমি কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে থমকে গেছি—লিখতে পারছি না, অথচ আমার কাহিনি তীব্রভাবে নতুন কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছে, তখন আমি দোকানের জানালায় চোখ রেখেছি, খুঁজেছি আমার চারপাশে, বন্ধুবান্ধবের বাসায়, ফ্লি মার্কেটে (সাপ্তাহিক বাজার, যেখানে লোকজন পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করে), এন্টিকের দোকানে—সেই সময়টা ছিল এক ধরনের ক্লান্তিহীন অন্বেষণের সময়। আর অন্বেষণের মধ্য দিয়েই মিউজিয়াম অব ইনোসেন্সের জন্ম।’ এখানে পামুকের জাদুঘরের কিছু বাছাই জিনিসের ছবি, সঙ্গে লেখকের কথা উপস্থাপিত হলো।
এ বছর উনিশ শতকের এক দালানে জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। দর্শনার্থীদের জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোনো প্রবেশমূল্য দিতে হবে না, তবে বইয়ের সঙ্গে ছাপা হয়েছে একটি করে টিকিট, দর্শনার্থীকে ওই টিকিট সঙ্গে আনতে হবে। সংগ্রহের মধ্যে আছে চার হাজার ২১৩টি সিগারেটের শেষাংশ, ২৩৭টি চুলের ক্লিপ, ৪১৯টি ন্যাশনাল লটারির টিকিট আর একটা গ্রাইন্ডার।
এই জাদুঘর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পামুক বলেছে: ‘আমার মা বলত, আমার বই কেউ পড়বে না। তেমনি আমার এই জাদুঘরেও কারও পা পড়বে না, আমি হয়তো কেবল আমার নিজের পায়ের আওয়াজই পাব এখানে।’ বিগত বছরগুলোতে পামুক স্বল্প পরিচিত, অখ্যাত অনেক সংগ্রহশালা ঘুরে বেড়িয়েছে—চিনের হাংজুর ঐতিহ্যবাহী ওষুধ জাদুঘর থেকে বাদ পড়েনি আমেরিকার স্মিথফিল্ডের হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী আভা গার্ডনারের ক্ষুদ্র সংগ্রহশালাও। তার উপন্যাসের চরিত্র কেমালও এক জাদুঘর থেকে আরেক জাদুঘরে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কেমাল আর পামুকের মিল অনেক। কিন্তু তাই বলে কি পামুক আর কেমাল একই ব্যক্তি? ‘আমি কেমাল নই, কিন্তু এটা আমি কাউকে বোঝাতেও পারব না যে আমি কেমাল নই। কারণে আমি শুধু ঔপন্যাসিক।’ পামুকের ব্যাখ্যা।
‘আমি কাউকে কোনো ভুল ধারণা দিতে চাই না। আমি এই জাদুঘর নিয়ে সুখী। তলস্তয়ের স্কুল ছিল, আরেক লেখকের নিজস্ব পত্রিকা ছিল, তৃতীয়জনের ছিল সিনেমা বানানোর স্বপ্ন, এখনো কারও আছে প্রিয় রাজনীতি। এই জাদুঘর আমার স্কুল, আমার পত্রিকা, আমার ফিল্ম, আমার রাজনীতি। এটা আমারই অংশ।’
নোবেল বিজয়ী লেখক অরহান পামুকের জাদুঘর খোলার গল্পের শুরু ১০ বছর আগে, ইস্তাম্বুলেই। পামুক তখন সবে বোরহেসীয় ঘরানার উপন্যাস মাই নেম ইজ রেড শেষ করেছে, ঔপন্যাসিক হিসেবে তখনো তেমন পরিচিতি জোটেনি, কিন্তু সেই তখন থেকেই একটা প্রেমের উপন্যাসের প্লট ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে মাথায়, এক ভগ্ন হূদয় যুবকের গল্প—কেমাল, যে একই সঙ্গে যেন পামুকের আরেক প্রতিভু—পামুক নিজেই যেন নতুন উপন্যাস দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স-এর চরিত্র কেমাল। উপন্যাসের নায়ক কেমাল ইস্তাম্বুলের সম্ভ্রান্ত বংশীয় এক তরুণ তুর্কি, যে প্রেমে পড়েছে এক দরিদ্র আত্মীয়ের তরুণীকন্যা ফুসুনের। এখান থেকেই পামুক মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স-এ পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছে কয়েক যুগের ঘোর হতাশা, শ্রেণী-সংঘাত আর সামাজিক বিভাজনের বোরহেসীয় কাহিনির, পূর্ব আর পশ্চিমের চিরায়ত সাংস্কৃতিক সংঘাতের কাহিনির।
এ উপন্যাসের শেষ ভাগে ফুসুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রকম স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করেছে কেমাল, বিপুল আগ্রহ আর নিষ্ঠা নিয়ে। আর এই সংগ্রহের মধ্য দিয়েই জন্ম নিচ্ছে এক স্মৃতিঘরের, মিউজিয়াম অব ইনোসেন্সের।
এই উপন্যাসের চরিত্র কেমালের মতোই পামুক খুলছে এক স্মৃতিচিহ্নের জাদুঘর, উপন্যাসের ৮৩ পরিচ্ছেদের মতো ৮৩টি সংগ্রহ নিয়েই এই সংগ্রহশালা। ‘এই উপন্যাস আমি লিখেছি ১০ বছর ধরে’, বলছে পামুক, ‘এ সময় নানা বস্তুকে আমি ব্যবহার করেছি লেখার উপাদান হিসেবে। এসব বস্তু কখনো অনায়াসে ঢুকে গেছে আমার উপন্যাসে আবার কখনো—যখন আমি কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে থমকে গেছি—লিখতে পারছি না, অথচ আমার কাহিনি তীব্রভাবে নতুন কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছে, তখন আমি দোকানের জানালায় চোখ রেখেছি, খুঁজেছি আমার চারপাশে, বন্ধুবান্ধবের বাসায়, ফ্লি মার্কেটে (সাপ্তাহিক বাজার, যেখানে লোকজন পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করে), এন্টিকের দোকানে—সেই সময়টা ছিল এক ধরনের ক্লান্তিহীন অন্বেষণের সময়। আর অন্বেষণের মধ্য দিয়েই মিউজিয়াম অব ইনোসেন্সের জন্ম।’ এখানে পামুকের জাদুঘরের কিছু বাছাই জিনিসের ছবি, সঙ্গে লেখকের কথা উপস্থাপিত হলো।
এ বছর উনিশ শতকের এক দালানে জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। দর্শনার্থীদের জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোনো প্রবেশমূল্য দিতে হবে না, তবে বইয়ের সঙ্গে ছাপা হয়েছে একটি করে টিকিট, দর্শনার্থীকে ওই টিকিট সঙ্গে আনতে হবে। সংগ্রহের মধ্যে আছে চার হাজার ২১৩টি সিগারেটের শেষাংশ, ২৩৭টি চুলের ক্লিপ, ৪১৯টি ন্যাশনাল লটারির টিকিট আর একটা গ্রাইন্ডার।
এই জাদুঘর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পামুক বলেছে: ‘আমার মা বলত, আমার বই কেউ পড়বে না। তেমনি আমার এই জাদুঘরেও কারও পা পড়বে না, আমি হয়তো কেবল আমার নিজের পায়ের আওয়াজই পাব এখানে।’ বিগত বছরগুলোতে পামুক স্বল্প পরিচিত, অখ্যাত অনেক সংগ্রহশালা ঘুরে বেড়িয়েছে—চিনের হাংজুর ঐতিহ্যবাহী ওষুধ জাদুঘর থেকে বাদ পড়েনি আমেরিকার স্মিথফিল্ডের হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী আভা গার্ডনারের ক্ষুদ্র সংগ্রহশালাও। তার উপন্যাসের চরিত্র কেমালও এক জাদুঘর থেকে আরেক জাদুঘরে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কেমাল আর পামুকের মিল অনেক। কিন্তু তাই বলে কি পামুক আর কেমাল একই ব্যক্তি? ‘আমি কেমাল নই, কিন্তু এটা আমি কাউকে বোঝাতেও পারব না যে আমি কেমাল নই। কারণে আমি শুধু ঔপন্যাসিক।’ পামুকের ব্যাখ্যা।
‘আমি কাউকে কোনো ভুল ধারণা দিতে চাই না। আমি এই জাদুঘর নিয়ে সুখী। তলস্তয়ের স্কুল ছিল, আরেক লেখকের নিজস্ব পত্রিকা ছিল, তৃতীয়জনের ছিল সিনেমা বানানোর স্বপ্ন, এখনো কারও আছে প্রিয় রাজনীতি। এই জাদুঘর আমার স্কুল, আমার পত্রিকা, আমার ফিল্ম, আমার রাজনীতি। এটা আমারই অংশ।’
No comments