বিলেতে বাঙালি এমপি by উজ্জ্বল মেহেদী
গ্রামের নাম ভূরকি। এক অজপাড়া গাঁ। ‘ও, বুঝছি, বুঝছি! আফনারা আমরার রুশনারা আলীর বাড়িত যাইতা... সোজা গিয়া হাত-ওর বাউয়ের রাস্তায় যাইবাগি...’। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের লামাকাজি মোড়ের জনারণ্যে রেস্তোরাঁর মালিক ইরফান আহমদ গন্তব্যের কথা জানতে পেরে সহাস্যে এ কথা বলে পথ নির্দেশনা দিলেন।
কথায় বোঝা গেল এই কয় দিনে ওই একটি কথা তাঁর শতবার বলা হয়ে গেছে। পেছনে স্বগতোক্তির সুরে বলতে শোনা গেল, ‘রুশনারার গ্রাম না কইলে আর ভূরকি চেনার উপায় নাই...!’
সিলেট—সুনামগঞ্জ সড়ক। যেতে যেতে একটি সরু রাস্তার মিলনমুখ। ধানখেতের মেঠোপথের মতো এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়েছে দূরের শান্তশ্রী ভূরকি গ্রামে। রাস্তার মুখে রঙিন তোরণ। তাতে অভিনন্দন জানিয়ে গ্রামবাসী তোরণ বানিয়েছে, ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিশ্বনাথের ভূরকি গ্রামের রুশনারা আলী ইতিহাসের প্রথম বাঙালি এমপি নির্বাচিত হওয়ায় প্রাণঢালা অভিনন্দন’। এ যেন রুশনারার নাম দিয়ে অচেনা ভূরকি গ্রাম চেনা।
দুই হাজার জন-অধ্যুষিত ভূরকি গ্রামের মানুষের অধিকাংশের পেশা কৃষিকাজ। তার পরও কৃষি-গৃহস্থ পরিবার থেকে এ বাড়ি, ও বাড়ি করে যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর নানা দেশে প্রবাসী রয়েছেন অনেকে। গ্রামের একমাত্র বিদ্যাপীঠ ভূরকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অবকাঠামো আগে ছিল চৌচালা। এখন দালান। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয় রুশনারার প্রথম পাঠশালা।
বিদ্যালয়ের ঠিক পেছনেই রুশনারার নানাবাড়ি। নানাবাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে রুশনারাদের বাড়ি। বাঁশ-বন-বেতের ঝোপঝাড়ের আড়ালে ওই বসতঘরগুলো এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মানুষ আসছে, যাচ্ছে। ভিড় করছে। বাড়িতে থাকা একমাত্র চাচা হাজি আছদ্দর আলী জানান, মানুষ নিজে নিজেই বলাবলি করে এই বলে যে ‘বিলাত গিয়া ভোটে জেতা স্বপ্নে নি দেখছে কেউ?... আমরারে স্বপ্ন দেখাইল স্বপ্না।’
ভূরকি থেকে অক্সফোর্ড
রুশনারা গ্রামের বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় যুক্তরাজ্য পাড়ি দিয়েছিলেন। এ বিদ্যালয়ে তাঁর মা রানু বেগমকে পড়িয়েছেন যিনি, বর্তমানে অবসরে যাওয়া সেই শিক্ষক মো. হবিবুর রহমান রুশনারার প্রথম শিক্ষক। শৈশবের খোঁজে শুরুতে ওই শিক্ষাগুরুর মুখোমুখি হওয়া। বয়স তাঁর ৮০ ছাড়িয়ে গেলেও এখনো চশমা ছাড়াই বই পড়তে পারেন। দুপুরবেলায় বাড়ির বারান্দায় সাক্ষাৎ মিলল। শিক্ষক হবিবুর বলেন, ‘এই যে, আপনারা যে রাস্তা দিয়া বাড়ি এলেন, আগে এ রাস্তা ছিল গোপাট। শুধুই গরুর চলাচল। এখন মানুষ শুধু হাঁটে না, গাড়ি হাঁকায়। সেই সময় আমরা তো কল্পনাও করতে পারিনি সেই গোপাটে একদিন গাড়ি চলাচল করবে। সামান্য ওই বিষয়টি যদি কল্পনায় না থাকে, তাহলে আপনারাই বলুন, অজপাড়াগাঁ ভূরকি গ্রামের এক মেয়ে, তাও আবার আমার সেই ছাত্রীর এমন বিজয়ে; আমি খুশি, এত খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করার অবস্থা আমার নেই।’
নির্বাচনের আগে গত বছরের ডিসেম্বরে রুশনারা যখন সর্বশেষ গ্রামে এসেছিলেন, তখন শিক্ষক হবিবুরের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে শিক্ষক বলেন, ‘আমারই এক ছাত্রী ভূরকি থেকে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছে, সেটাই জেনে ছিলাম গর্বিত। আজ বিলেতে ভোটের রাজনীতিতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী—আমার শিক্ষকজীবন এতটা পূর্ণ হবে, ভাবতেও পারিনি।’
শৈশব মানে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি
স্মৃতি হাতড়ে রুশনারার বাবার বিলেত যাওয়ার প্রসঙ্গে প্রতিবেশী আত্মীয় ষাটোর্ধ্ব মাহমুদ আলী বলেন, ‘আইয়ুব সরকারের মার্শাল ল-এর সমে মেয়ের বাপ বিলেত যাওয়ার ভাউচার এক হাজার টেখা দি পাইছিলা। হেইসমে গিছিলা...।’ এ রকম ভাসা ভাসা বর্ণনা শুনে দেশে থাকা রুশনারার একমাত্র মামা আবদুর রউফ জানান, রুশনারার বয়স যখন সাত, তখন সপরিবারে যুক্তরাজ্য যাওয়া হয়। রুশনারা আলীর জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ। ব্রিটেন যাওয়ার পর কিশোর বয়সে আর রুশনারার দেশে আসা হয়নি। বড় হওয়ার পর আসা-যাওয়া হয়েছে সাতবার। সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মাসে দেশে এলে রুশনারার রাজনৈতিক আদর্শ আর ভোটের বিষয়টি জানা হয় সবার। আবদুর রউফ বলেন, ‘ভাগ্নি আমার সেবার কথায় কথায় দোয়া চেয়েছে। সবাই প্রাণভরে দোয়া করছেও।’
বাড়ির আঙিনায় পুকুর আর পাশে বিদ্যালয়-মক্তব ছিল বলে রুশনারার তাই শৈশবের বেশির ভাগ কেটেছে নানাবাড়ি। গ্রামে ফিরলেও প্রথমে নানাবাড়ি। নানি গোলেস্তা বিবির সঙ্গে ছিল বেশি সখ্য। সে স্মৃতি বহন করছে নানাবাড়িতে বাঁধাই করে রাখা রুশনারার শৈশবকালীন একটি ছবি। বছর দুয়েক হয় তাঁর নানি মারা গেছেন।
‘গাঁওয়ের মানুষ এত খুশি যে কোটি টেখা দিলেও এমন খুশি অইত নায়। মনে থাকি সব খুশি। আর আমারে পাইলেই মানুষ ঘিরে ধরে বলে, কিতা বা টের পাইছ নি ভাগ্নি কই উঠছে, টের পাইরায় নি?’ বলেন মামা আবদুর রউফ।
গর্ব, প্রত্যাশায়...
রুশনারা যখন সর্বশেষ গিয়েছিলেন গ্রামে, তখন ভোটের রাজনীতি প্রসঙ্গ তুলে ধরে দোয়া চাইতেই গ্রামবাসী কয়েকজন উল্লাসে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে গিয়ে বলছিলেন, ‘এমপি অইলে লামাকাজি গ্রামের ব্রিজটা আগে করি দিবায় নি কও আগে...’ নির্বাচনের তথ্য দেন প্রথম আলোর বিশ্বনাথ প্রতিনিধি প্রনঞ্জয় বৈদ্য।
সিলেট—সুনামগঞ্জ সড়ক। যেতে যেতে একটি সরু রাস্তার মিলনমুখ। ধানখেতের মেঠোপথের মতো এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়েছে দূরের শান্তশ্রী ভূরকি গ্রামে। রাস্তার মুখে রঙিন তোরণ। তাতে অভিনন্দন জানিয়ে গ্রামবাসী তোরণ বানিয়েছে, ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিশ্বনাথের ভূরকি গ্রামের রুশনারা আলী ইতিহাসের প্রথম বাঙালি এমপি নির্বাচিত হওয়ায় প্রাণঢালা অভিনন্দন’। এ যেন রুশনারার নাম দিয়ে অচেনা ভূরকি গ্রাম চেনা।
দুই হাজার জন-অধ্যুষিত ভূরকি গ্রামের মানুষের অধিকাংশের পেশা কৃষিকাজ। তার পরও কৃষি-গৃহস্থ পরিবার থেকে এ বাড়ি, ও বাড়ি করে যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর নানা দেশে প্রবাসী রয়েছেন অনেকে। গ্রামের একমাত্র বিদ্যাপীঠ ভূরকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অবকাঠামো আগে ছিল চৌচালা। এখন দালান। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয় রুশনারার প্রথম পাঠশালা।
বিদ্যালয়ের ঠিক পেছনেই রুশনারার নানাবাড়ি। নানাবাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে রুশনারাদের বাড়ি। বাঁশ-বন-বেতের ঝোপঝাড়ের আড়ালে ওই বসতঘরগুলো এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মানুষ আসছে, যাচ্ছে। ভিড় করছে। বাড়িতে থাকা একমাত্র চাচা হাজি আছদ্দর আলী জানান, মানুষ নিজে নিজেই বলাবলি করে এই বলে যে ‘বিলাত গিয়া ভোটে জেতা স্বপ্নে নি দেখছে কেউ?... আমরারে স্বপ্ন দেখাইল স্বপ্না।’
ভূরকি থেকে অক্সফোর্ড
রুশনারা গ্রামের বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় যুক্তরাজ্য পাড়ি দিয়েছিলেন। এ বিদ্যালয়ে তাঁর মা রানু বেগমকে পড়িয়েছেন যিনি, বর্তমানে অবসরে যাওয়া সেই শিক্ষক মো. হবিবুর রহমান রুশনারার প্রথম শিক্ষক। শৈশবের খোঁজে শুরুতে ওই শিক্ষাগুরুর মুখোমুখি হওয়া। বয়স তাঁর ৮০ ছাড়িয়ে গেলেও এখনো চশমা ছাড়াই বই পড়তে পারেন। দুপুরবেলায় বাড়ির বারান্দায় সাক্ষাৎ মিলল। শিক্ষক হবিবুর বলেন, ‘এই যে, আপনারা যে রাস্তা দিয়া বাড়ি এলেন, আগে এ রাস্তা ছিল গোপাট। শুধুই গরুর চলাচল। এখন মানুষ শুধু হাঁটে না, গাড়ি হাঁকায়। সেই সময় আমরা তো কল্পনাও করতে পারিনি সেই গোপাটে একদিন গাড়ি চলাচল করবে। সামান্য ওই বিষয়টি যদি কল্পনায় না থাকে, তাহলে আপনারাই বলুন, অজপাড়াগাঁ ভূরকি গ্রামের এক মেয়ে, তাও আবার আমার সেই ছাত্রীর এমন বিজয়ে; আমি খুশি, এত খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করার অবস্থা আমার নেই।’
নির্বাচনের আগে গত বছরের ডিসেম্বরে রুশনারা যখন সর্বশেষ গ্রামে এসেছিলেন, তখন শিক্ষক হবিবুরের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে শিক্ষক বলেন, ‘আমারই এক ছাত্রী ভূরকি থেকে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছে, সেটাই জেনে ছিলাম গর্বিত। আজ বিলেতে ভোটের রাজনীতিতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী—আমার শিক্ষকজীবন এতটা পূর্ণ হবে, ভাবতেও পারিনি।’
শৈশব মানে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি
স্মৃতি হাতড়ে রুশনারার বাবার বিলেত যাওয়ার প্রসঙ্গে প্রতিবেশী আত্মীয় ষাটোর্ধ্ব মাহমুদ আলী বলেন, ‘আইয়ুব সরকারের মার্শাল ল-এর সমে মেয়ের বাপ বিলেত যাওয়ার ভাউচার এক হাজার টেখা দি পাইছিলা। হেইসমে গিছিলা...।’ এ রকম ভাসা ভাসা বর্ণনা শুনে দেশে থাকা রুশনারার একমাত্র মামা আবদুর রউফ জানান, রুশনারার বয়স যখন সাত, তখন সপরিবারে যুক্তরাজ্য যাওয়া হয়। রুশনারা আলীর জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ। ব্রিটেন যাওয়ার পর কিশোর বয়সে আর রুশনারার দেশে আসা হয়নি। বড় হওয়ার পর আসা-যাওয়া হয়েছে সাতবার। সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মাসে দেশে এলে রুশনারার রাজনৈতিক আদর্শ আর ভোটের বিষয়টি জানা হয় সবার। আবদুর রউফ বলেন, ‘ভাগ্নি আমার সেবার কথায় কথায় দোয়া চেয়েছে। সবাই প্রাণভরে দোয়া করছেও।’
বাড়ির আঙিনায় পুকুর আর পাশে বিদ্যালয়-মক্তব ছিল বলে রুশনারার তাই শৈশবের বেশির ভাগ কেটেছে নানাবাড়ি। গ্রামে ফিরলেও প্রথমে নানাবাড়ি। নানি গোলেস্তা বিবির সঙ্গে ছিল বেশি সখ্য। সে স্মৃতি বহন করছে নানাবাড়িতে বাঁধাই করে রাখা রুশনারার শৈশবকালীন একটি ছবি। বছর দুয়েক হয় তাঁর নানি মারা গেছেন।
‘গাঁওয়ের মানুষ এত খুশি যে কোটি টেখা দিলেও এমন খুশি অইত নায়। মনে থাকি সব খুশি। আর আমারে পাইলেই মানুষ ঘিরে ধরে বলে, কিতা বা টের পাইছ নি ভাগ্নি কই উঠছে, টের পাইরায় নি?’ বলেন মামা আবদুর রউফ।
গর্ব, প্রত্যাশায়...
রুশনারা যখন সর্বশেষ গিয়েছিলেন গ্রামে, তখন ভোটের রাজনীতি প্রসঙ্গ তুলে ধরে দোয়া চাইতেই গ্রামবাসী কয়েকজন উল্লাসে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে গিয়ে বলছিলেন, ‘এমপি অইলে লামাকাজি গ্রামের ব্রিজটা আগে করি দিবায় নি কও আগে...’ নির্বাচনের তথ্য দেন প্রথম আলোর বিশ্বনাথ প্রতিনিধি প্রনঞ্জয় বৈদ্য।
No comments