সপ্তাহের হালচাল-কালোটাকায় পদ্মা সেতু করেন না কেন? by আব্দুল কাইয়ুম

সরকার তো কতভাবেই দুর্নাম কুড়াচ্ছে। এই যেমন, বিএনপির মূল নেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠাল। ইলিয়াস আলীর সন্ধান তো দিলই না, উপরন্তু গভীর রাতে তাঁর বাসায় ডিবির পরিচয়ে পুলিশ গেল। কেন গেল তার কোনো সদুত্তর সরকার দিল না। হরতাল ডাকলে কর্মীদের মাঠে নামতে দেয় না, আবার অনশন করতে চাইলে জায়গা দিতে চায় না, অনুমতির জন্য ঘুরায়, হয়রানি করে।


বোঝা যাচ্ছে, দুর্নামে সরকারের কিছু যায়-আসে না। তাহলে আরও কিছু দুর্নাম কুড়াতে দোষ কী? যেমন, একটু সাহস করে কি কালোটাকায় পদ্মা সেতু বানানোর উদ্যোগ নেওয়া যায় না? হয়তো সবাই ছি ছি করবে, কিন্তু একটা কাজের কাজ তো হবে; দেশ পাবে এমন একটা সেতু, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যার খুব দরকার।
নৈতিকতার বিচারে কালোটাকা সমর্থন করা যায় না। কালোটাকা মানে লুটপাটের টাকা। সেই টাকা এভাবে বিনিয়োগ করতে দিলে অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এ জন্যই এবার বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী বারবার কালোটাকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আগে যখন নামমাত্র কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, প্রতিবারই প্রতিবাদ করেছে মানুষ। কারণ, ১০ শতাংশ কর দিয়ে যদি বারবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সৎ করদাতারা কেন ২৫-৩০ শতাংশ হারে কর দেবেন? তাঁরা তো কর ফাঁকি দিয়ে কালোটাকা বানাতে উৎসাহিত হবেন। এভাবে দেশে কালোটাকার ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠছে। সুতরাং, কালোটাকার সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
তবে কালোটাকা আবার দুই রকম। একটা তো একেবারে বেআইনি। যেমন, ঘুষ, কালোবাজারি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, মাদকের ব্যবসা প্রভৃতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদ। আরেকটা হলো, বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ, কিন্তু অপ্রদর্শিত। কেউ হয়তো জমি বা সহায়সম্পদ বিক্রি করেছেন বেশি টাকায়, দলিলে দেখিয়েছেন কম। এই ‘অপ্রদর্শিত’ আয় কালোটাকা হলেও তাকে ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ আছে। এই টাকা যদি বিনিয়োগে আসতে দেওয়া হয়, এবং যদি সেখানে কিছু প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো খুব বেশি দোষের হবে না।
কিন্তু এতে কতটা সাড়া পাওয়া যাবে, সেটাই প্রশ্ন। যেহেতু দেশে কালোটাকা নিয়ে চলা যায়, তাই অনেকে আইনের পথে আসতে চায় না। অনেক সময় দেশে বিনিয়োগ না করে কালোটাকা দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে টাকা পাচার বা ‘মানি লন্ডারিং’ বন্ধে আইন আছে, কঠোর শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না। ফলে দেশের কালোটাকা বাইরে যায় ও পরে ‘বৈধ’ টাকা হিসেবে দেশে ফেরত আনা হয়, বা দেশের বাইরেই থেকে যায়।
এখন সরকার বলছে, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিলে মালয়েশিয়া, চীন বা অন্য যে দেশ বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে, তার সঙ্গে চুক্তি করে পদ্মা সেতু বানাবে। দরকার হলে দেশের টাকায় বানানো হবে। যদি মালয়েশিয়া বানায়, ওরা প্রথমে তহবিল জোগাড় করবে। তারা প্রযুক্তি ধার করবে। পরামর্শক লাগাবে। তহবিল পাওয়াই মুশকিল। বিশ্বব্যাংক যেহেতু দিচ্ছে না, তাই অন্য কেউ সহজে এগিয়ে আসবে না। ধরা যাক, অন্য কোনো দেশ থেকে তারা তহবিল সংগ্রহ করল। সেই তহবিলের জন্য সুদ তো কম হবে না। ব্যয় বাড়বে। বাইরে থেকে সংগৃহীত তহবিলের কিছু অংশ হয়তো বাংলাদেশের ভেতর থেকেই পাচার হয়ে যাবে বিদেশে। সেখান থেকে হাত বদল হয়ে অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে দেশে আসবে। বাংলাদেশের কালোটাকা বাংলাদেশেই ফিরে আসবে, মাঝখান থেকে কয়েক হাত বদল হয়ে তার দাম বাড়বে।
কিছুদিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষায় জানা গেছে, দেশে এখন কালোটাকার হার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৬ থেকে ৮১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদ ফ্রেডারিক স্নাইডার ২০ বছর ধরে বিশ্বের কালোটাকা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে কালোটাকার হার মোট দেশজ উৎপাদনের ৩৭ শতাংশ। এই কমের দিকটা ধরলেও বলতে হয়, বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা (সূত্র, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল, ২০১২)। আর পদ্মা সেতু বানাতে লাগবে ২৩-২৪ হাজার কোটি টাকা মাত্র!
অন্তত ছয়-সাতটা পদ্মা সেতু বানানোর টাকা দেশের মানুষের হাতেই রয়েছে। তাহলে কেন বিশ্বব্যাংকের কাছে হাত পাততে যাই? যাই এ কারণে যে উন্নয়নের জন্য আরও অনেক সহায়তা দরকার। আর বিশ্বব্যাংক ছাড়া আমাদের মতো দেশের বিকল্প খুব বেশি নেই। পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের দেওয়ার কথা প্রায় নয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদের মধ্যে এডিবির প্রায় চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা, জাইকার প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রায় এক হাজার ১২০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা। বিশ্বব্যাংক না দিলে অন্যরাও দিতে ইতস্তত করবে। ধরে নিতে হবে যে পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে সরকার যদি পদ্মা সেতু বানাতেই চায়, তাহলে নিজের ব্যবস্থা নিজেরই করতে হবে।
সরকার দেখুক, মালয়েশিয়া কী প্রস্তাব দেয়। দেখা যাক, ওদের শর্ত বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কত বেশি কঠোর। বাংলাদেশ তা সইতে পারবে কি না। অন্য কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান সুবিধাজনক শর্তে প্রস্তাব দেয় কি না, দেখা যাক। যদি জাতীয় স্বার্থে ও সুবিধাজনক শর্তে বাইরের সাহায্য পাওয়া যায়, ভালো। যদি না পাওয়া যায়?
তখন সরকার বলতে পারে, শুধু এবারের জন্য, এবং এটাই শেষ সুযোগ, ১৫ বা এমনকি ১০ শতাংশ কর দিয়ে পদ্মা সেতুতে কালোটাকা ঢালা যাবে! বিদেশ ঘুরে দেশে আসার চেয়ে সরাসরি দেশেই বিনিয়োগ হোক। আমাদের একটা স্বপ্ন পূরণ হোক!
কিন্তু কালোটাকা সহজে সাদা হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার এ পর্যন্ত ১৬ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু কমই সাদা হয়েছে। ৪০ বছরে সাদা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। কর পাওয়া গেছে এক হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা মাত্র। অর্থাৎ, বেশির ভাগ কালোটাকা কালোই রয়ে গেছে। তাহলে পদ্মা সেতুর জন্য সুযোগ দিলেই যে টাকা আসবে, তার নিশ্চয়তা কী?
এখানে সরকারকে কঠোর হতে হবে। ভালোভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে এটা শেষ সুযোগ। যদি পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করো, ভালো। যদি না করো, তাহলে এরপর আর সুযোগ থাকবে না। কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ধরা যাক, কালোটাকাওয়ালারা সুবোধ বালকের মতো ২৩-২৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করল। তার পরও কিন্তু সমস্যা থেকে যাবে। কারণ, এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হবে ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুকে আছে এখন এক হাজার কোটি ডলারের সামান্য কম। সেখান থেকে ২৫০ কোটি ডলার চলে গেলে তিন মাসের আমদানি-ব্যয়ও হাতে থাকবে না।
কিন্তু এখানেও একটা সম্ভাবনা থাকবে। বিশ্বব্যাংক কেন পদ্মা সেতুতে টাকা দিতে চায়নি? কারণ দুর্নীতির অভিযোগ। ওরা বলছে, দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে। কথা তো সত্য। দুর্নীতি না থাকলে লাখ লাখ কোটির কালোটাকা কোথা থেকে আসে? এখন যদি সরকার সেই দুর্নীতির টাকা গর্ত থেকে টেনে বের করে পদ্মা সেতুতে লাগাতে পারে, তাহলে অন্তত বলতে পারবে, দেখো তোমরা, দুর্নীতি হলেও সেটা দেশের একটা কাজে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেছি। তখন বিশ্বব্যাংকসহ অন্য বিশ্ব সংস্থাগুলোর আস্থা ফিরে পাওয়ার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। দাতাদের কিছু ডলার হয়তো অন্যান্য খাতে আসবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারে এমনকি দেড়-দুই হাজার কোটি ডলার জমতে পারে।
অবশ্য এমন সম্ভাবনা তখনই দেখা দেবে, যদি এখন থেকেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া না হয়।
এটা কি সরকার পারবে? প্রশ্নটা কঠিন। উত্তর সহজ নয়। সরকার কী বলে?
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.