শহরবিলাস by রয়েল পাল

আজও বৃষ্টিতে ভিজে গেল শহর। দিগন্তরাঙা আলোয় তাকিয়ে চৌরাস্তায়। আমার শহর আমার আষ্টেপৃষ্ঠে, মানুষগুলো আমার ভেতর প্রিয় গানের মতো বেজে ওঠে। একবার দেখা সেসব হাসি, আহা কী দারুণ! আমার সোনাঝরা দুপুর, উদাস উদাস খয়েরি বিকেল, কত রাত হয়ে গেছে গভীর।


এ শহরে প্রতিটি রাস্তার মোড়, চায়ের দোকান, গাছপালা, পথ, ভোরের শিউলির ঘ্রাণ, রাজা ম্যানশনের কালচে দালান, আড্ডা, মাঝরাতে কোনো অচেনা বাউলের গলা ছেড়ে গান—সব, সব আমার মনের স্মৃতির ঝোপঝাড়ে আতশবাজি হয়ে জ্বলে। শহরের বুকের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নীল পানির খাল—লালাখাল, যেখানে পূর্ণিমা রাতে সোনালি মাছেরা জ্যোৎস্নার সঙ্গে খেলা করে। অবেলায় আলী আমজাদের ঘড়ির ওপর সময় দাঁড়িয়ে থাকে, ল্যাম্পপোস্টের নিচে খুব শীতকাতরে হলদে পাখির মতো।
তো, যেভাবে আমি শহর দেখেছি, ক্বিনব্রিজ দেখেছি, সুরমা দেখেছি, ঠিক সেভাবে একদিন দেখলাম আমার বাসার শেওলামাখা ছাদের ওপর দিয়ে আকাশ ভেঙে শঙ্খচিল উড়ে যায়। ভোকাট্টা ঘুড়ি হয়ে লাপাত্তা।
এ শহরে আমার বন্ধুরা প্রত্যেকে একেকটা জাদু জানা রংধনু। তাদের সাত রঙের আবেগ আমাকে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে শেখায়। সার্কাসের দল, লম্বা চুলের বাউল, একঝাঁক জালালি কবুতর ও পাঁচ টাকার বেহালাবাদক।
এক থলে অবাক বেহালা নিয়ে চেনা মাটির সুরে বেহালা বাজিয়ে সারা শহরে হেঁটে বেড়াত। প্রতি বেহালা পাঁচ টাকা। তার বেহালার লাল, নীল মায়ার বাঁধনে আমার উড়াল মন দলছুট। পাঁচ দিনের সম্পদ পাঁচ টাকার বিস্ময়। সে এক জাদুকরি টান, সে এক অদ্ভুত জাদুকর, সে এক কোনো স্কুলপালানো কিশোরের হারিয়ে যাওয়া সুখ! এখন আর তাকে দেখা যায় না এ শহরে, হয়তো অন্য কোনো শহরে অন্য কোনোখানে, অন্য কাউকে সে টানছে অদ্ভুত সুরের টানে।
এ শহরেই আমার স্বপ্ন দেখা। অলিতে-গলিতে ছোটাছুটি। এখান থেকেই প্রথম প্রেম, ভালোবাসার হাত ধরে হাঁটা। বর্ষায় একমুঠো কদম, একপুকুর শাপলা। শরতে কাশফুল, ঘাসফড়িংয়ের গল্পকথা।
এ শহর ছেড়ে আমি যত দূর যাই না কেন, আমার মাঝে সে জড়িয়ে থাকে দারুণ মায়ার মতো। যতই থাকুক কংক্রিট, রাতের নিয়ন আলো, রিকশার টুংটাং শব্দ, মানুষ, কোলাহল, আকাশছোঁয়া দালান, তবু কোথায় জানি ভালো লাগারা ঘর বেঁধে আছে, কোথা থেকে জানি ভালোবাসার ডাক আসে— গোটা শহরের ভেতর থেকে। শহীদ মিনারের গা ঘেঁষে রাঙা কৃষ্ণচূড়ার গান, শাবির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মতো মেঠোপথ, এমসি কলেজের লাল-সাদার মুখরিত বর্ষবরণ। সাশ্রয়ী চাঁদ। সারা শহর জোছনায় ভেসে যায়। মাঘের রাতে দুধের সরের মতো কালো রাস্তায় কুয়াশা পড়ে। এক মাঠ সোনালি ধানের মতো যখন শহরের মাথার ওপর তারা জ্বলে ওঠে, তখন মনে হয় এ শহর ছেড়ে আমি যাব কোথায়! পালাব কোথায়! এই ল্যাম্পপোস্ট, জিন্দাবাজার মোড়, আম্বরখানা, উপশহর, টিলাগড়, শিবগঞ্জ—আরও কত কত নাম!
এ শহরেই আমি যন্ত্রণা ভুলতে শিখেছি। ঝাপসা চোখে আনমনে গাইতে শিখেছি। আমার চার লাইনের দুঃখকথা, হঠাৎ করে কুড়িয়ে পাওয়া গান। রাতের নিয়ন আলোয় এক শ কবিতার কবি হয়ে ওঠা।
আমার বাড়ি, আমার নদী, আমার মায়ের ভেজা আঁচলের গন্ধ, শহুরে রাস্তা, অজগরের লেজ নিয়ে রাতের বুকের ভেতর দিয়ে দারুণ হুইসেলে ট্রেন চলে যাওয়া এ আমার শহর।
(পাঠক আপনিও লিখুন আপনার শহর নিয়ে)

No comments

Powered by Blogger.