স্মরণ-শওকত ওসমানের স্বপ্ন ও জননী by সোহরাব হাসান

পাকিস্তান আমলে ঢাকা কলেজের নামকরা অধ্যক্ষ ছিলেন জালালউদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন কঠোর নিয়মের মানুষ। শিক্ষক বা শিক্ষার্থী—কেউ তাঁকে ফাঁকি দিতে পারতেন না। ছাত্ররা একদিন দল বেঁধে তাঁর কাছে গিয়ে নালিশ করল, বাংলার শিক্ষক ক্লাসে পড়ান না, কেবল গল্প করেন।


অধ্যক্ষ শিক্ষকের নাম জানতে চাইলেন।
ছাত্ররা বলল, শওকত ওসমান।
তখন তিনি কণ্ঠে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বললেন, ‘শওকত ওসমানকে পড়ানোর জন্য রাখা হয়নি। তিনি ঢাকা কলেজে আছেন—এটাই আমাদের জন্য গর্বের। পড়ানোর জন্য তো আরও শিক্ষক আছেন।’
এই ছিলেন শওকত ওসমান। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী। জননী ও ক্রীতদাসের হাসিসহ বহু কালজয়ী গ্রন্থের লেখক।
শওকত ওসমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে। তিনি পড়াশোনা করেছেন নিজ গ্রামের মক্তব, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর কলকাতাতেই কর্মজীবনের শুরু। শিক্ষকতা তাঁর পেশা হলেও নেশা ছিল লেখালেখি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, আত্মজীবনী, স্মৃতিখণ্ড, শিশুতোষ মিলে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। কলকাতায় থাকতেই তাঁর বনি আদম, ওটেন সাহেবের বাংলো, তস্কর লস্কর পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর শওকত ওসমান চলে আসেন পূর্ববঙ্গে। প্রথমে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে, পরে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করেন। দ্রোহী লেখক হুমায়ুন আজাদের চোখে তিনি ছিলেন আমাদের সমাজের ‘অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ’। ছাত্রদের তিনি ‘স্যার’ ও ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। সাতসকালে প্রিয় ছাত্রদের কাছে টেলিফোন করে জানতে চাইতেন, ‘স্যার, কেমন আছেন?’ ছাত্র নয় এমন ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন, ‘ভ্রাত, প্রাতঃস্মরণীয় হও’।
বৃদ্ধ বয়সেও শওকত ওসমান সবার খোঁজখবর নিতেন। কারও বিপদের কথা শুনলে ছুটে যেতেন। নিজের বয়স নিয়ে কিছুটা গর্বও ছিল তাঁর। শেষ দিকে দেখা হলে তিনি বলতেন, ‘আমি সত্তরের কোঠা পেরিয়ে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বেঁচে ছিলেন।’ বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে ৮১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী ছিলেন শওকত ওসমান। পাকিস্তান যে টিকবে না, তিনি অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানে কেন এলেন? এ প্রশ্নের জবাবে শওকত ওসমান বলেছিলেন, ‘বন্ধুরা সবাই এপারে চলে এলেন। আমি থাকি কী করে?’
শওকত ওসমান শিল্পের জন্য শিল্পের চর্চা করেননি। গল্প-উপন্যাস-নাটকে তিনি জীবন ও সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। জীবনের দাবি মেটাতে গিয়ে কখনো কখনো শিল্পের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। ছোটদের জন্য ‘প্রাইজ’ নামে তাঁর একটি গল্প আছে। গল্পের নায়ক অত্যন্ত গরিবঘরের সন্তান। সে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। কোনো দিন স্কুলে যায়নি, কিন্তু স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যেমন খুশি সাজোতে সে ভিক্ষুকের অভিনয় করে প্রথম প্রাইজটি জিতে নেয়।
এ গল্পে সামাজিক বৈষম্যের যে চিত্র রয়েছে, তা পাঠকের মনকে স্পর্শ করে। আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যখন কেউ টুঁ শব্দটি করেননি, তখনই তিনি লিখলেন ক্রীতদাসের হাসি। এবং আদমজী পুরস্কারও পান। শওকত ওসমান ছিলেন বরাবর স্পষ্টভাষী। বনগাঁয়ে এক সাহিত্যসভায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলতে শুরু করলে ২৩ বছরের তরুণ শওকত ওসমান দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ‘সাহিত্যের কথা বলুন। আমরা ধর্মের কথা শুনতে আসিনি।’
শওকত ওসমান মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদ চিন্তাচেতনার কঠোর সমালোচক ছিলেন। কিন্তু সমাজটিকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, কখনো ত্যাগ করেননি। তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন, যারা একটি আলপিন তৈরি করতে পারে না, তারা কীভাবে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে?
মুসলিম বিশ্বের দুজন নেতাকে শওকত ওসমান অতি উচ্চ মূল্য দিতেন। একজন তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক পাশা, অন্যজন বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান। দুজনই ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি দেশান্তরি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এ দেশে আর থাকা যাবে না। ফিরে আসেন ১৯৮১ সালে। তাঁর সেই নির্বাসিত জীবন-কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে মুজিবনগর: উত্তর পর্বে। তার আগে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লিখেছিলেন জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য, রাজসাক্ষী।
শওকত ওসমান ধর্মান্ধতাকে অপছন্দ করতেন। হুজি, জেএমবি গঠনের বহু আগেই তিনি মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
শওকত ওসমানের জননী ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। অনুবাদেও তিনি ‘জননী’ নামটি অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা তো বাংলায় কত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। বাংলা ভাষার অন্তত একটি শব্দকে ইংরেজিতে রপ্তানি করা গেছে।’
জননী নিয়ে তাঁর আরও একটি স্বপ্ন ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর কাহিনি নিয়ে ছবি হোক। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছবিটি করতে অনুদানও দেওয়া হয়েছিল। পরিচালক হিসেবে তাঁর নাম থাকলেও কাজটি করছিলেন তাঁর ছোট ছেলে জাঁনেসার ওসমান। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কাজটিও বন্ধ হয়ে যায়। আমরা জানি না, ছবিটি কোন অবস্থায় আছে? এখন ফের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে জননী চলচ্চিত্রায়ণের কাজটি শেষ হোক—তাঁর দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে এটাই প্রার্থনা।

No comments

Powered by Blogger.