অর্থনীতি-সরকার, রাজস্ব বিভাগ ও করদাতা by সাজ্জাদ জহির
রাষ্ট্রের চরিত্র যা-ই হোক না কেন, তার ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ প্রয়োজন। হীরকের খনি বাইরে বিক্রি করে অথবা অন্য কোনো লাভজনক সম্পদ নিজের ব্যবস্থাপনায় রেখে, অথবা প্রজাদের (বা নাগরিকদের) ওপর করারোপ করে সে অর্থের জোগান হতে পারে। মানবসমাজে আদিকাল থেকেই এসব ব্যবস্থার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই পদস্খলনের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। হীরকের রাজা প্রশাসনের প্রতি অবহেলা করে ব্যক্তি ভোগবিলাসে অধিক মনোযোগী ছিলেন। তেমনই, তুঘলকি আমলে জমির খাজনা ফসলের অর্ধেক থেকে বৃদ্ধি করে দুই-তৃতীয়াংশ করলে প্রজাদের জঙ্গলে পালাতে হয়েছিল। ফলে কোষাগার শূন্য হতে বসেছিল। অপরদিকে, দিল্লির সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে খাজনা তুলতে এসে অনেকেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বতন্ত্র রাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সেই খাজনার ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিল।
এসব কাহিনি ও ঘটনা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে সুষ্ঠু নাগরিক-জীবন নিশ্চিত করতে প্রশাসন আবশ্যিক এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই জনসাধারণকেই অর্থ সরবরাহ করতে হবে। আর এই অর্থ সরবরাহটি হয় মূলত কর আদায়-প্রদানের মাধ্যমে।
কর আদায় প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে সরকারের হাতে সম্পদের স্থানান্তর ঘটে, যা বরাবরই প্রশাসনের ব্যয়ভার নির্বাহে ও বিনিয়োগে যৌক্তিকতা পায়। তবে নীতিনির্ধারকেরা কর কাঠামোকে হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করেন; বিশেষত, বাজারের ব্যর্থতার কারণে সৃষ্ট অদক্ষতা দূর করতে অথবা সার্বিক রাজস্ব নীতির আলোকে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে। অনেক সময় সেই হাতিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যা সরকারি বণ্টন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এসবের বাইরেও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সমাজে কর-সংক্রান্ত তথ্যের অপব্যবহার হতে দেখা গেছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব।
কর-সংগ্রহ বনাম করজালের আওতা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপক ও জনসাধারণের মাঝে যে প্রয়োগকারী সংস্থা রয়েছে, তাদের উদ্যোগী করতে অনেক সময় লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার রীতি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ করতে হয়; ট্রাফিক পুলিশকে ফি আদায় করতে হয় ইত্যাদি। কর কর্মকর্তাদের ন্যূনতম পরিমাণ কর আদায়ের মাত্রা বেঁধে দেওয়া ও সেই পরিমাণের অধিক কর সংগ্রহ হলে তার ওপর প্রণোদনা দেওয়ার চল শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ জাতীয় পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো কর সংগ্রহের পরিমাণ সর্বাধিক করা। কিন্তু একটি কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের জন্য এ জাতীয় লক্ষ্য থাকা কাম্য কি?
বস্তুত কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হওয়া উচিত, প্রচলিত কর কাঠামোতে যাঁদের প্রত্যক্ষ কর দেওয়ার কথা, তাঁরা সেটা দিচ্ছেন কি না। সেটা করতে গিয়ে একদিকে যেমন সৎ ও আগ্রহী করদাতাদের হয়রানি না হয়, তেমনি অসৎভাবে যাঁরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কর কর্মকর্তাদের যেন অনাকাঙ্ক্ষিত যোগসাজশ না ঘটে। যদি কর কর্মকর্তাদের অসাধুতার কারণে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ কম হয়, উল্লিখিত ধরনের প্রণোদনা দিয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বরং, কর্মকর্তা প্রতি কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিলে তার অপপ্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নানা অজুহাতে সৎ করদাতাদের হয়রানি করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে করজালে নিবন্ধন করার লক্ষ্যমাত্রা (সম্ভাব্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাদের আইনানুগভাবে কর দেওয়া উচিত) নির্ধারণই অধিক কাম্য।
ব্যক্তি বনাম প্রতিষ্ঠান: এটা অনস্বীকার্য যে আমাদের সমাজের অনেকেই প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আয় উপার্জন করেন না। তার পরও করদাতাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মালিক বা বেতনভোগী হিসেবে কর্মরত আছেন। এসব ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে করজালে নিয়ে আসা এবং পরবর্তীকালে নিয়মিত কর প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন।
কেননা, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন ব্যক্তি করদাতার তুলনায় সাধারণত একজন কর কর্মকর্তা অধিক ক্ষমতাবান হওয়ায় স্বেচ্ছাচারিতার সম্ভাবনা অধিক। এবং অনস্বীকার্য যে ব্যক্তিপর্যায়ে অবৈধ লেনদেনের সুযোগ বেশি। সেই তুলনায় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হলে, নির্দিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার আশ্রয় এবং অন্যান্য সহকর্মীর সহায়তা নিতে হবে।
পর্যায়ক্রমে প্রত্যক্ষ কর-সংক্রান্ত তথ্যাদি কম্পিউটারে মজুদ করতে হবে, যা প্রয়োজনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি যাচাইয়ের সুযোগ এনে দেবে। যত বেশি প্রতিষ্ঠান করজালে নিবন্ধিত হবে এবং তাদের দ্বারা ব্যক্তিদের সম্মানী/বেতনসংক্রান্ত তথ্যাদি পাওয়া যাবে, তত বেশি ব্যক্তিপর্যায়ে কর দাখিল নিশ্চিত সম্ভব হবে।
আবার প্রত্যেক ব্যক্তির পেছনে লেগে থাকতে যে লোকবল ও অর্থের প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক কম লোকবল ও অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে করজালে আনা সম্ভব। তাদের মাধ্যমে করযোগ্য ব্যক্তিদের অধিক সম্পদশালী অংশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
কর কর্মকর্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনাকে তাই কে কয়টি প্রতিষ্ঠান করজালে আবদ্ধ করল তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, কর্মকর্তাদের প্রণোদনাভিত্তিক আয় বৃদ্ধি পাবে, মোট রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি হবে এবং সর্বোপরি সৎ করদাতাদের হয়রানি কমে কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তিদের করজালে আবদ্ধ করা সহজ হবে। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা এটাই কি চান না?
কয়েকটি প্রস্তাব: ব্যক্তির ওপর সরাসরি আরোপিত কর আদায়ের ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যক্তিকে দেয় বেতন/সম্মানী সংশ্লিষ্ট সব তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার। উৎসে আগাম কর কর্তন সম্পর্কে বিধিমালা স্পষ্ট করা ও চালান জমা দেওয়ার ফরমে বেতন/সম্মানীপ্রাপ্তদের ওপরও সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি রাখা প্রয়োজন।
যেহেতু কর জালের আওতায় আনার অর্থ এই নয় যে একজনকে কর দিতেই হবে, সেহেতু কর বিবরণী দাখিলকারী প্রতিটি ব্যক্তির জন্য ন্যূনতম কর ধার্য করা অনুচিত। বিশেষত করযোগ্য আয়ের নিম্নসীমা যেখানে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ব্যক্তিপ্রতি কর ধার্য নিঃসন্দেহে অসংগতিপূর্ণ। এ জাতীয় ভাবনাহীন নীতি স্বল্প মেয়াদে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ক্ষতিকারক।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের সরকার ব্যক্তির অধিকারের প্রতি প্রায়শই শ্রদ্ধাশীল নয়। তাই কারও পক্ষে অতিরিক্ত কর জমা পড়লে তা ফেরত পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার। যাঁরা মাসিক ১৫ হাজার টাকা বা তার কম পাবেন তাঁদের ক্ষেত্রে কর্তন হবে না, যাঁরা মাসিক ১৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পাবেন তাঁদের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ; এবং যাঁরা ৩৫ হাজার টাকার পাবেন তাঁদের জন্য ১০ শতাংশ হারে আগাম উৎসে কর কর্তন করা যেতে পারে।
দেশি-বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য এ নিয়ম বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। দেশি, বিদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সব বিদেশি নাগরিক, যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানী/বেতন পেয়ে থাকেন, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বাছবিচার করতে গিয়ে করজালেই ফাঁক তৈরি হয়।
আবার আজকের যুগে যেখানে দাতা নামক প্রতিষ্ঠানও বাণিজ্যিক কর্মে লিপ্ত এবং সবাই যখন শেষ বিচারে বেতনভোগী, সেখানে বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে করমুক্ত রাখায় (সেবাধর্মী) শ্রমবাজারে বিকৃতি দেখা দিয়েছে, কর আদায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের (বহিঃসম্পদ বিভাগ) সঙ্গে ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর যে কর অবমুক্তির চুক্তি রয়েছে, তার পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।
সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তথ্য সবরাহ করে, এ জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে লিমিটেড কোম্পানির মুনাফার ওপর বড় অঙ্কের কর দেওয়ার কথা। এবং কর-পরবর্তী লভ্যাংশকে ব্যক্তি আয় গণ্য করে দ্বিতীয় দফায় কোম্পানির মালিকদের কর দেওয়ার কথা। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়, করের বোঝার কারণে অধিকাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবের মারপ্যাঁচে মুনাফা দেখান না। অনেক ক্ষেত্রে এমন অভিযোগও ওঠে যে এসব অনিয়মে কর প্রশাসন থেকেই সহায়তা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তথ্য প্রদানে উৎসাহিত করতে তাই করকাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।
সাজ্জাদ জহির: পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ।
sajjad@ergonline.org
এসব কাহিনি ও ঘটনা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে সুষ্ঠু নাগরিক-জীবন নিশ্চিত করতে প্রশাসন আবশ্যিক এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই জনসাধারণকেই অর্থ সরবরাহ করতে হবে। আর এই অর্থ সরবরাহটি হয় মূলত কর আদায়-প্রদানের মাধ্যমে।
কর আদায় প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে সরকারের হাতে সম্পদের স্থানান্তর ঘটে, যা বরাবরই প্রশাসনের ব্যয়ভার নির্বাহে ও বিনিয়োগে যৌক্তিকতা পায়। তবে নীতিনির্ধারকেরা কর কাঠামোকে হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করেন; বিশেষত, বাজারের ব্যর্থতার কারণে সৃষ্ট অদক্ষতা দূর করতে অথবা সার্বিক রাজস্ব নীতির আলোকে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে। অনেক সময় সেই হাতিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যা সরকারি বণ্টন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এসবের বাইরেও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সমাজে কর-সংক্রান্ত তথ্যের অপব্যবহার হতে দেখা গেছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব।
কর-সংগ্রহ বনাম করজালের আওতা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপক ও জনসাধারণের মাঝে যে প্রয়োগকারী সংস্থা রয়েছে, তাদের উদ্যোগী করতে অনেক সময় লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার রীতি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ করতে হয়; ট্রাফিক পুলিশকে ফি আদায় করতে হয় ইত্যাদি। কর কর্মকর্তাদের ন্যূনতম পরিমাণ কর আদায়ের মাত্রা বেঁধে দেওয়া ও সেই পরিমাণের অধিক কর সংগ্রহ হলে তার ওপর প্রণোদনা দেওয়ার চল শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ জাতীয় পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো কর সংগ্রহের পরিমাণ সর্বাধিক করা। কিন্তু একটি কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের জন্য এ জাতীয় লক্ষ্য থাকা কাম্য কি?
বস্তুত কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হওয়া উচিত, প্রচলিত কর কাঠামোতে যাঁদের প্রত্যক্ষ কর দেওয়ার কথা, তাঁরা সেটা দিচ্ছেন কি না। সেটা করতে গিয়ে একদিকে যেমন সৎ ও আগ্রহী করদাতাদের হয়রানি না হয়, তেমনি অসৎভাবে যাঁরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কর কর্মকর্তাদের যেন অনাকাঙ্ক্ষিত যোগসাজশ না ঘটে। যদি কর কর্মকর্তাদের অসাধুতার কারণে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ কম হয়, উল্লিখিত ধরনের প্রণোদনা দিয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বরং, কর্মকর্তা প্রতি কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিলে তার অপপ্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নানা অজুহাতে সৎ করদাতাদের হয়রানি করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে করজালে নিবন্ধন করার লক্ষ্যমাত্রা (সম্ভাব্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাদের আইনানুগভাবে কর দেওয়া উচিত) নির্ধারণই অধিক কাম্য।
ব্যক্তি বনাম প্রতিষ্ঠান: এটা অনস্বীকার্য যে আমাদের সমাজের অনেকেই প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আয় উপার্জন করেন না। তার পরও করদাতাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মালিক বা বেতনভোগী হিসেবে কর্মরত আছেন। এসব ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে করজালে নিয়ে আসা এবং পরবর্তীকালে নিয়মিত কর প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন।
কেননা, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন ব্যক্তি করদাতার তুলনায় সাধারণত একজন কর কর্মকর্তা অধিক ক্ষমতাবান হওয়ায় স্বেচ্ছাচারিতার সম্ভাবনা অধিক। এবং অনস্বীকার্য যে ব্যক্তিপর্যায়ে অবৈধ লেনদেনের সুযোগ বেশি। সেই তুলনায় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হলে, নির্দিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার আশ্রয় এবং অন্যান্য সহকর্মীর সহায়তা নিতে হবে।
পর্যায়ক্রমে প্রত্যক্ষ কর-সংক্রান্ত তথ্যাদি কম্পিউটারে মজুদ করতে হবে, যা প্রয়োজনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি যাচাইয়ের সুযোগ এনে দেবে। যত বেশি প্রতিষ্ঠান করজালে নিবন্ধিত হবে এবং তাদের দ্বারা ব্যক্তিদের সম্মানী/বেতনসংক্রান্ত তথ্যাদি পাওয়া যাবে, তত বেশি ব্যক্তিপর্যায়ে কর দাখিল নিশ্চিত সম্ভব হবে।
আবার প্রত্যেক ব্যক্তির পেছনে লেগে থাকতে যে লোকবল ও অর্থের প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক কম লোকবল ও অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে করজালে আনা সম্ভব। তাদের মাধ্যমে করযোগ্য ব্যক্তিদের অধিক সম্পদশালী অংশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
কর কর্মকর্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনাকে তাই কে কয়টি প্রতিষ্ঠান করজালে আবদ্ধ করল তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, কর্মকর্তাদের প্রণোদনাভিত্তিক আয় বৃদ্ধি পাবে, মোট রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি হবে এবং সর্বোপরি সৎ করদাতাদের হয়রানি কমে কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তিদের করজালে আবদ্ধ করা সহজ হবে। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা এটাই কি চান না?
কয়েকটি প্রস্তাব: ব্যক্তির ওপর সরাসরি আরোপিত কর আদায়ের ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যক্তিকে দেয় বেতন/সম্মানী সংশ্লিষ্ট সব তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার। উৎসে আগাম কর কর্তন সম্পর্কে বিধিমালা স্পষ্ট করা ও চালান জমা দেওয়ার ফরমে বেতন/সম্মানীপ্রাপ্তদের ওপরও সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি রাখা প্রয়োজন।
যেহেতু কর জালের আওতায় আনার অর্থ এই নয় যে একজনকে কর দিতেই হবে, সেহেতু কর বিবরণী দাখিলকারী প্রতিটি ব্যক্তির জন্য ন্যূনতম কর ধার্য করা অনুচিত। বিশেষত করযোগ্য আয়ের নিম্নসীমা যেখানে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ব্যক্তিপ্রতি কর ধার্য নিঃসন্দেহে অসংগতিপূর্ণ। এ জাতীয় ভাবনাহীন নীতি স্বল্প মেয়াদে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ক্ষতিকারক।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের সরকার ব্যক্তির অধিকারের প্রতি প্রায়শই শ্রদ্ধাশীল নয়। তাই কারও পক্ষে অতিরিক্ত কর জমা পড়লে তা ফেরত পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার। যাঁরা মাসিক ১৫ হাজার টাকা বা তার কম পাবেন তাঁদের ক্ষেত্রে কর্তন হবে না, যাঁরা মাসিক ১৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পাবেন তাঁদের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ; এবং যাঁরা ৩৫ হাজার টাকার পাবেন তাঁদের জন্য ১০ শতাংশ হারে আগাম উৎসে কর কর্তন করা যেতে পারে।
দেশি-বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য এ নিয়ম বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। দেশি, বিদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সব বিদেশি নাগরিক, যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানী/বেতন পেয়ে থাকেন, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বাছবিচার করতে গিয়ে করজালেই ফাঁক তৈরি হয়।
আবার আজকের যুগে যেখানে দাতা নামক প্রতিষ্ঠানও বাণিজ্যিক কর্মে লিপ্ত এবং সবাই যখন শেষ বিচারে বেতনভোগী, সেখানে বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে করমুক্ত রাখায় (সেবাধর্মী) শ্রমবাজারে বিকৃতি দেখা দিয়েছে, কর আদায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের (বহিঃসম্পদ বিভাগ) সঙ্গে ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর যে কর অবমুক্তির চুক্তি রয়েছে, তার পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।
সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তথ্য সবরাহ করে, এ জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে লিমিটেড কোম্পানির মুনাফার ওপর বড় অঙ্কের কর দেওয়ার কথা। এবং কর-পরবর্তী লভ্যাংশকে ব্যক্তি আয় গণ্য করে দ্বিতীয় দফায় কোম্পানির মালিকদের কর দেওয়ার কথা। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়, করের বোঝার কারণে অধিকাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবের মারপ্যাঁচে মুনাফা দেখান না। অনেক ক্ষেত্রে এমন অভিযোগও ওঠে যে এসব অনিয়মে কর প্রশাসন থেকেই সহায়তা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তথ্য প্রদানে উৎসাহিত করতে তাই করকাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।
সাজ্জাদ জহির: পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ।
sajjad@ergonline.org
No comments