চরাচর-রাজপথের সেই কিশোরী by শারমিন শানু

মাঝদুপুর। প্রচণ্ড জ্যাম। সেই সঙ্গে চড়া রোদ। সিএনজি অটোরিকশার মধ্যে বসে আছি পান্থপথ মোড়ে। গাড়িগুলো যেন নড়ার কোনো লক্ষণ নেই। বসে আছি চুপচাপ। রোদ এবং জ্যামে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত মুহূর্তে ঝলমলে দুপুরটিকে বড়ই বিরক্তিকর ও ঝিমানো মনে হচ্ছিল। পাশেই বসে আছেন মা। তাঁকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। গন্তব্য সেনানিবাস এলাকা।


অটোরিকশাটির দুপাশ দিয়ে দুহাত পেতে মাঝেমধ্যে করুণার্থীদের ভিড়। এর মাঝে ছোট্ট একটি মেয়ে। বয়স আনুমানিক ৯-১০ হবে। গায়ের রং বাংলার মাটির মতো। গায়ে ঢিলেঢালা আধ ময়লা সালোয়ার-কামিজ। দুই হাতে অনেকগুলো 'পপকর্ন'-এর প্যাকেট। একে একে প্রতিটি গাড়ির সামনেই দাঁড়াচ্ছে অতি দ্রুততায় প্যাকেটগুলো বিক্রি করার আশায়। অটোরিকশার শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে ১০টি টাকা বাড়িয়ে দিলাম। টাকাটি নিয়ে একটি প্যাকেট মেলে ধরল আমাকে দেওয়ার জন্য। আমার পাশে বসে থাকা মা তাকে ইশারা করলেন_লাগবে না। পায়ে যেন তার অতি দ্রুততার ছোঁয়া, সময় চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্যাকেটটি না দিয়ে যাবে কিভাবে! অটোরিকশার ভেতর থেকে মা আবার মুখ বাড়িয়ে বললেন, ওটা লাগবে না; যাও অন্যখানে গিয়ে বিক্রি করো। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে সে বলল, না খালাম্মা, নিন। দরজাটা খট করে খুলে একটি প্যাকেট ছুড়ে দিয়ে বলল, 'খান খালাম্মা, গরম আছে।' ততক্ষণে ট্রাফিক সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। গাড়িগুলোও চলতে শুরু করছে। প্রচণ্ড জ্যাম আর ভিড়ে কখন যে সূর্যটা তার উত্তাপ ছড়ানো শেষে পশ্চিম আকাশে প্রায় ডুবতে বসেছে, বুঝতেই পারিনি। আমাদের অটোরিকশাটিও চলতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি উঁকি দিয়ে পপকর্নওয়ালা মেয়েটিকে আবার ডাকতে চাইলাম। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে ততক্ষণে সে মিশে গেছে। কী যেন কথা বলার ছিল_ধন্যবাদ, নাকি কৃতজ্ঞতা! কিছু একটা জানতে চেয়েছিলাম হয়তো! কিন্তু তা আর হলো না। সে যেন এই দেওয়াটুকুর মধ্য দিয়ে অনেক কিছু বলে গেল...। এ দেশে ওদের সংখ্যা কত? না, এর নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। ওদের জন্য মাঝেমধ্যে সেমিনারে কারো কারো সহানুভূতি প্রকাশ পায়। কিন্তু এসবে তো ওদের জীবনচিত্র পাল্টায় না। ওরা ঘুরে পথ থেকে পথে। এই মেয়েটি যাওয়ার আগে যেন বলে গেল, এ দেশে দারিদ্র্য আছে, ক্ষুধা আছে, আছে দুঃখ। কিন্তু আমরা এখনো নিঃশেষ হয়ে যাইনি, ঘুমিয়ে যাইনি; জেগে আছি। আমরা ভালোবাসতে পারি ও জানি। আমাদের জন্যও অনেকের ভালোবাসা আছে হয়তো; কিন্তু সে ভালোবাসার স্পর্শ আমরা পাই না বলেই আমাদের জীবনচিত্রও বদলায় না। আসুন, আমরা সত্যি ওদের জন্য কিছু একটা করি।
শারমিন শানু

No comments

Powered by Blogger.