যুক্তি তর্ক গল্প-ইউনূস-বিরোধিতায় লাভ কার, খেসারত দেবে কে? by আবুল মোমেন
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের করা দুটি রিট হাইকোর্টে খারিজ হওয়ার পর এখন সুপ্রিম কোর্টে বিবেচনাধীন। না, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, নোবেলজয়ী হলেও নন। আমরাও সে রকম কোনো পক্ষপাত প্রত্যাশা করি না।
রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার জন্যই আইন প্রণীত হলেও রাজনৈতিক সরকার সব সময় আইনের সংকীর্ণ ও যান্ত্রিক ব্যাখ্যা এবং গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময়ই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইনের প্রসারিত ও নমনীয় রূপ দাঁড় করিয়ে তারই আওতায় কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু সরকারের এই আইনি ঔদার্যের সুযোগ কেবল রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক মামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে, নাকি খুনের আসামি পর্যন্ত প্রসারিত হচ্ছে, তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঠিকই বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করেনি, এ মামলায় ড. ইউনূসই বাদী। তবে তিনি কেন আইনের আশ্রয় নিলেন, সেটাও বুঝতে হবে। ব্যাংকের এমডির বয়স-সম্পর্কিত একটি বিধানের প্রয়োগে সরকার ১২ বছর নিষ্ক্রিয় থেকে হঠাৎ করে তড়িঘড়ি প্রয়োগ করতে চাইলে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের দিক থেকে দুটি সমস্যা দেখা দেয়—প্রথমত, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, রূপকার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ইউনূসকে মসৃণ ও আনন্দময় পরিবেশে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় ও সুযোগটুকু দেওয়া হবে না, আর তাতে ব্যাংকের আশি লাখ সদস্যের আস্থা নষ্টসহ অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে। দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি সরকারের এতকালের উদার সহযোগী মনোভাবের অবসান শুধু নয়, একটি বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত হবে, যার জের ধরে নেতিবাচক ফল আসতে পারে।
ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে সরকারের মনোভাব যে ভয়ানক কঠোর, তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেকের মন্তব্যে বোঝা যায়, এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সরকারের পক্ষে (তাঁর ভাষায়) যে খোলা চিঠি ছেড়েছেন, তাতে কঠোরতার মাত্রা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি অনিশ্চিত বাস্তবতা তৈরি হলে জনকের পক্ষে হাল ছেড়ে দেওয়া তো সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ পরিচালনায় যাতে ধারাবাহিকতা থাকে, পরিবর্তনটি যাতে মসৃণ, ইতিবাচক ও আনন্দময় হয়, ড. ইউনূস সে কারণে নির্দিষ্ট সময় নিয়ে একটি প্রক্রিয়া চালু করার সুযোগ চেয়েছিলেন। সে সুযোগ সরকার তাঁকে দিতে রাজি হয়নি। আর তাই আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিকল্পটি তাঁকে নিতে হয়েছে।
বাজারে একটা কানাঘুষা ছিল যে, সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেকেই ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নোবেল পাওয়া উচিত বলে মনে করেন এবং এ জন্য কিছু লবিও করা হয়েছিল। এর সত্যমিথ্যা জানি না। তবে রায়ের পরে দেশের প্রধান আইনি কর্মকর্তা এ ধরনেরই মনোভাব ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হননি। তিনি বলেছেন, দেশে শান্তির জন্য কেউ যদি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য হয়ে থাকেন, তিনি শেখ হাসিনা এবং তাঁর সঙ্গে সন্তু লারমা তা পেতে পারেন। তাঁরা দুজনে নোবেল পুরস্কার পেলে সে তো অবশ্যই আনন্দের কথা, এ দুঃখী দেশ আরেকবার আনন্দে ভাসার উপলক্ষ পেত। তবে প্রবীণ আইনজীবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, চুক্তির পর থেকে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্তু লারমা ও পার্বত্যবাসীর হতাশা কেবল দিন দিন বেড়েছে, এ জন্য আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারকে দায়ী করে লারমার বক্তব্য দিন দিন জোরালোও হচ্ছে। যে শান্তিচুক্তিকে যথাযথ মর্যাদা আওয়ামী লীগের সরকারই দিল না, চুক্তির অপরপক্ষের নেতা স্বয়ং বারবার এ নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন, তখন এটির ভিত্তিতে পুরস্কার, স্বীকৃতির প্রত্যাশা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তাঁরাই ভালো বুঝবেন।
তবে আবারও বলব, যদি শেখ হাসিনা ও লারমা নোবেল পুরস্কার পেতেন, তাতে আমরা সবাই খুশিই হতাম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পাওয়ার অন্যায্যতার প্রসঙ্গ টানা কি ন্যায্য? একটি পেলে অপরটি পাওয়া উচিত নয়—তাঁর বিচারবোধ এ রকম হলো কেন?
শুরুতে যে জনমনের কথা বলেছিলাম, এই সামষ্টিক মনটি কিন্তু বোঝা সহজ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি যেদিন প্রকাশিত হয়, ফাইল থেকে সেদিনের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো দেখলাম। সব কাগজেই আট কলাম ব্যানার হেডলাইন, ড. ইউনূসের হাস্যোজ্জ্বল বড় ছবি এবং উচ্ছ্বাসপূর্ণ একাধিক সংবাদ ও সম্পাদকীয়। পরের কয়েক দিনও এই আনন্দের জোয়ারে দেশ ভেসেছে। এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত এবং প্রত্যাশার প্রতিফলনই ঘটেছিল মানুষের প্রতিক্রিয়ায়।
সরকারি মহলে কেউ কি এখন ভাবছেন যে নোবেল কমিটি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ড. ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠানকে সম্মান জানিয়ে ভুল করেছে? তাঁরা আইনের মাধ্যমে এবং প্রচারণার মাধ্যমে এটা প্রমাণ করে ছাড়বেন? অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামত অনুযায়ী, তারা যে প্রধানমন্ত্রী ও সন্তু লারমাকে নোবেল না দিয়ে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়ে ভুল কাজ করেছে, তা প্রমাণের দায় যদি সরকার বা সরকার-অনুগত কেউ নিয়ে থাকেন, তার ফলটা কিছুতেই ভালো হতে পারে না। না সরকার, না গ্রামীণ—কারও জন্যই নয়। আর যেহেতু উভয়ের সঙ্গে জনগণের স্বার্থ জড়িত, তাই এ রকম ভুলের খেসারত—হয়তো সেই সঙ্গে প্রতিদান—দেবে জনগণ।
যদি সত্যিই কেউ এ রকম দায়িত্ব নিয়ে থাকেন, তাঁদের প্রমাণ করতে হবে ড. ইউনূস একজন খলনায়ক, গ্রামীণ ব্যাংক একটি গণবিরোধী প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ এই মহলকে আরও নোংরা খুঁজতে ও ঘাঁটতে হবে। মানুষ ধৈর্যের সঙ্গে রাজনীতির এই নোংরা খেলা দেখে যাবে, নাকি তার মতো করে এর প্রতিকারের কথা ভাববে, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। দূর থেকে সাদা চোখে দেখতে পাই, ড. ইউনূসের ওপর আস্থা ও তাঁর অর্জিত ভাবমূর্তি দেশের গণ্ডিতে সীমিত নয়, তা বিশ্বব্যাপী ছড়ানো। সেটা যে কেবল পুঁজিবাদী বিশ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নয়, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশেও এর বিস্তার রয়েছে। গণতন্ত্রী-সমাজতন্ত্রী দেশ এবং এশিয়া ছাড়িয়ে আমেরিকা-আফ্রিকাতেও তা ছড়িয়েছে। সেদিক থেকে আজকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানিত ও স্বীকৃত প্রতিনিধির নাম কিন্তু ড. ইউনূস।
নোবেল বিজয়ের অনেক আগে থেকেই তাঁর এই ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে, তা ধারাবাহিকভাবে উত্তরোত্তর উজ্জ্বল ও বিস্তৃততর হয়েছে। আমরা গর্বের সঙ্গে লক্ষ করেছি, বার্লিন প্রাচীর ভাঙার কুড়ি বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একমাত্র বক্তা ছিলেন ড. ইউনূস, পেছনে সার ধরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রপতিরা। আমরা দেখি, বিশ্বের বড় বড় পুরস্কার ও স্বীকৃতি এই একজন ব্যক্তি জয় করে এনেছেন। সারা বিশ্বের শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রনেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ৯০তম জন্মদিনের একমাত্র বক্তা ছিলেন ইউনূস, ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় সভার যৌথ অধিবেশনে ইউনূস দিয়েছিলেন হীরেন মুখার্জি স্মারক বক্তৃতা। এ রকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে।
মানুষ এই বিজয়, গৌরব ও আনন্দের ভাগীদার থাকতে চায়। বিদেশ ঘুরে আসা অনেকের কাছেই শুনেছি, বিদেশিরা তাঁদেরকে অভিযোগ করে বলেছে, বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় নেতাকে কীভাবে আমরা হত্যা করলাম। আজ সম্ভবত তারা আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবে, কীভাবে আমরা জাতির একজন নায়ককে অপমান করতে পারছি। ফলে ড. ইউনূসের নেতিকরণের দায় গ্রহণ করলে সরকার জনমানুষের ইচ্ছার বিপরীতে যাবে বলেই আমার মনে হয়।
আর সেখানেই আমার উৎকণ্ঠা ও হতাশার মূল কারণ। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে একাধিক লেখায় আমি লিখেছিলাম, কোনো উন্নয়নশীল দেশের, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে, জনকল্যাণকামী একটি সরকারের দীর্ঘস্থায়ী শাসনের মাধ্যমেই সে দেশে উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হয়। দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়লে সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। হাতের কাছেই উদাহরণ হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই জওহরলাল নেহরু শাসন করেছেন ষোলো বছর, আর তাঁর মৃত্যুর পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও কন্যা ইন্দিরা মিলে কংগ্রেসের শাসন চালিয়েছেন টানা ত্রিশ বছর। এভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে ভারত আজ একটি শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, আর বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ও মর্যাদাও বেড়েছে। বিপরীতে পাকিস্তান হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার বলি, অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি দেশটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অনেক পেছন থেকে এসে আমাদের বেশ পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। মূল কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, একেকটি সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার শত্রুরা ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এবং তাঁর প্রধান সহযোগীদের হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনাকেই নস্যাৎ করতে চেয়েছে। তারপরে আমরা সামরিক স্বৈরশাসনের নিচে পিষ্ট হলাম, এমনকি ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও আমরা ঠিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি করতে পারিনি। আশা করেছিলাম এবং সে আশার যথেষ্ট ভিত্তিও ছিল, যে এবারে স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশ বছর পরে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম ভাবার কারণ, আবার বহু বছর পরে দেশের বাম প্রগতিশীল অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে, আবার বহু বছর পরে তরুণ প্রজন্ম শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছে, দেশের নারী সমাজের মধ্যেও একই রকম পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়েছে। অর্থাৎ দেশব্যাপী একটা ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। এটা কেবল বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতা ছাড়া করার জন্যই হয়নি, তারা স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের আশাতেই মহাজোটের প্রতি আস্থা দেখিয়েছিল।
আমার আশঙ্কা, সরকার দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা একজন মানুষের প্রতি যে আচরণ করছে, তাতে সাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত আশা ঘা খাবে। সরকার ড. ইউনূসের সম্মান লাঘবের দায়িত্ব নিতে গিয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে সূচিত সম্ভাবনাটুকু বিনষ্ট করবে বলে আশঙ্কা হয়। ড. ইউনূসের সম্মান হরণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুরধার লেখনী ও বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন একদিকে দেশের বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর এবং অন্যদিকে বিরূপ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদী জঙ্গিশক্তি। আমাদের জানামতে, এরাই হলো আওয়ামী লীগের কট্টর বিরোধী শক্তি। আওয়ামী লীগ কি ইউনূস ও গ্রামীণ-বিরোধিতায় নেমে এবার পরীক্ষিত আওয়ামী-বিরোধীদের সঙ্গেও এক হবে?
তাহলে, যে বিপুল মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তাদের ভোট দিয়েছিল, তারা কী বারতা পাবে?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঠিকই বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করেনি, এ মামলায় ড. ইউনূসই বাদী। তবে তিনি কেন আইনের আশ্রয় নিলেন, সেটাও বুঝতে হবে। ব্যাংকের এমডির বয়স-সম্পর্কিত একটি বিধানের প্রয়োগে সরকার ১২ বছর নিষ্ক্রিয় থেকে হঠাৎ করে তড়িঘড়ি প্রয়োগ করতে চাইলে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের দিক থেকে দুটি সমস্যা দেখা দেয়—প্রথমত, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, রূপকার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ইউনূসকে মসৃণ ও আনন্দময় পরিবেশে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় ও সুযোগটুকু দেওয়া হবে না, আর তাতে ব্যাংকের আশি লাখ সদস্যের আস্থা নষ্টসহ অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে। দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি সরকারের এতকালের উদার সহযোগী মনোভাবের অবসান শুধু নয়, একটি বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত হবে, যার জের ধরে নেতিবাচক ফল আসতে পারে।
ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে সরকারের মনোভাব যে ভয়ানক কঠোর, তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেকের মন্তব্যে বোঝা যায়, এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সরকারের পক্ষে (তাঁর ভাষায়) যে খোলা চিঠি ছেড়েছেন, তাতে কঠোরতার মাত্রা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি অনিশ্চিত বাস্তবতা তৈরি হলে জনকের পক্ষে হাল ছেড়ে দেওয়া তো সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ পরিচালনায় যাতে ধারাবাহিকতা থাকে, পরিবর্তনটি যাতে মসৃণ, ইতিবাচক ও আনন্দময় হয়, ড. ইউনূস সে কারণে নির্দিষ্ট সময় নিয়ে একটি প্রক্রিয়া চালু করার সুযোগ চেয়েছিলেন। সে সুযোগ সরকার তাঁকে দিতে রাজি হয়নি। আর তাই আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিকল্পটি তাঁকে নিতে হয়েছে।
বাজারে একটা কানাঘুষা ছিল যে, সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেকেই ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নোবেল পাওয়া উচিত বলে মনে করেন এবং এ জন্য কিছু লবিও করা হয়েছিল। এর সত্যমিথ্যা জানি না। তবে রায়ের পরে দেশের প্রধান আইনি কর্মকর্তা এ ধরনেরই মনোভাব ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হননি। তিনি বলেছেন, দেশে শান্তির জন্য কেউ যদি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য হয়ে থাকেন, তিনি শেখ হাসিনা এবং তাঁর সঙ্গে সন্তু লারমা তা পেতে পারেন। তাঁরা দুজনে নোবেল পুরস্কার পেলে সে তো অবশ্যই আনন্দের কথা, এ দুঃখী দেশ আরেকবার আনন্দে ভাসার উপলক্ষ পেত। তবে প্রবীণ আইনজীবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, চুক্তির পর থেকে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্তু লারমা ও পার্বত্যবাসীর হতাশা কেবল দিন দিন বেড়েছে, এ জন্য আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারকে দায়ী করে লারমার বক্তব্য দিন দিন জোরালোও হচ্ছে। যে শান্তিচুক্তিকে যথাযথ মর্যাদা আওয়ামী লীগের সরকারই দিল না, চুক্তির অপরপক্ষের নেতা স্বয়ং বারবার এ নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন, তখন এটির ভিত্তিতে পুরস্কার, স্বীকৃতির প্রত্যাশা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তাঁরাই ভালো বুঝবেন।
তবে আবারও বলব, যদি শেখ হাসিনা ও লারমা নোবেল পুরস্কার পেতেন, তাতে আমরা সবাই খুশিই হতাম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পাওয়ার অন্যায্যতার প্রসঙ্গ টানা কি ন্যায্য? একটি পেলে অপরটি পাওয়া উচিত নয়—তাঁর বিচারবোধ এ রকম হলো কেন?
শুরুতে যে জনমনের কথা বলেছিলাম, এই সামষ্টিক মনটি কিন্তু বোঝা সহজ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি যেদিন প্রকাশিত হয়, ফাইল থেকে সেদিনের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো দেখলাম। সব কাগজেই আট কলাম ব্যানার হেডলাইন, ড. ইউনূসের হাস্যোজ্জ্বল বড় ছবি এবং উচ্ছ্বাসপূর্ণ একাধিক সংবাদ ও সম্পাদকীয়। পরের কয়েক দিনও এই আনন্দের জোয়ারে দেশ ভেসেছে। এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত এবং প্রত্যাশার প্রতিফলনই ঘটেছিল মানুষের প্রতিক্রিয়ায়।
সরকারি মহলে কেউ কি এখন ভাবছেন যে নোবেল কমিটি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ড. ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠানকে সম্মান জানিয়ে ভুল করেছে? তাঁরা আইনের মাধ্যমে এবং প্রচারণার মাধ্যমে এটা প্রমাণ করে ছাড়বেন? অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামত অনুযায়ী, তারা যে প্রধানমন্ত্রী ও সন্তু লারমাকে নোবেল না দিয়ে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়ে ভুল কাজ করেছে, তা প্রমাণের দায় যদি সরকার বা সরকার-অনুগত কেউ নিয়ে থাকেন, তার ফলটা কিছুতেই ভালো হতে পারে না। না সরকার, না গ্রামীণ—কারও জন্যই নয়। আর যেহেতু উভয়ের সঙ্গে জনগণের স্বার্থ জড়িত, তাই এ রকম ভুলের খেসারত—হয়তো সেই সঙ্গে প্রতিদান—দেবে জনগণ।
যদি সত্যিই কেউ এ রকম দায়িত্ব নিয়ে থাকেন, তাঁদের প্রমাণ করতে হবে ড. ইউনূস একজন খলনায়ক, গ্রামীণ ব্যাংক একটি গণবিরোধী প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ এই মহলকে আরও নোংরা খুঁজতে ও ঘাঁটতে হবে। মানুষ ধৈর্যের সঙ্গে রাজনীতির এই নোংরা খেলা দেখে যাবে, নাকি তার মতো করে এর প্রতিকারের কথা ভাববে, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। দূর থেকে সাদা চোখে দেখতে পাই, ড. ইউনূসের ওপর আস্থা ও তাঁর অর্জিত ভাবমূর্তি দেশের গণ্ডিতে সীমিত নয়, তা বিশ্বব্যাপী ছড়ানো। সেটা যে কেবল পুঁজিবাদী বিশ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নয়, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশেও এর বিস্তার রয়েছে। গণতন্ত্রী-সমাজতন্ত্রী দেশ এবং এশিয়া ছাড়িয়ে আমেরিকা-আফ্রিকাতেও তা ছড়িয়েছে। সেদিক থেকে আজকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানিত ও স্বীকৃত প্রতিনিধির নাম কিন্তু ড. ইউনূস।
নোবেল বিজয়ের অনেক আগে থেকেই তাঁর এই ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে, তা ধারাবাহিকভাবে উত্তরোত্তর উজ্জ্বল ও বিস্তৃততর হয়েছে। আমরা গর্বের সঙ্গে লক্ষ করেছি, বার্লিন প্রাচীর ভাঙার কুড়ি বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একমাত্র বক্তা ছিলেন ড. ইউনূস, পেছনে সার ধরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রপতিরা। আমরা দেখি, বিশ্বের বড় বড় পুরস্কার ও স্বীকৃতি এই একজন ব্যক্তি জয় করে এনেছেন। সারা বিশ্বের শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রনেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ৯০তম জন্মদিনের একমাত্র বক্তা ছিলেন ইউনূস, ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় সভার যৌথ অধিবেশনে ইউনূস দিয়েছিলেন হীরেন মুখার্জি স্মারক বক্তৃতা। এ রকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে।
মানুষ এই বিজয়, গৌরব ও আনন্দের ভাগীদার থাকতে চায়। বিদেশ ঘুরে আসা অনেকের কাছেই শুনেছি, বিদেশিরা তাঁদেরকে অভিযোগ করে বলেছে, বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় নেতাকে কীভাবে আমরা হত্যা করলাম। আজ সম্ভবত তারা আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবে, কীভাবে আমরা জাতির একজন নায়ককে অপমান করতে পারছি। ফলে ড. ইউনূসের নেতিকরণের দায় গ্রহণ করলে সরকার জনমানুষের ইচ্ছার বিপরীতে যাবে বলেই আমার মনে হয়।
আর সেখানেই আমার উৎকণ্ঠা ও হতাশার মূল কারণ। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে একাধিক লেখায় আমি লিখেছিলাম, কোনো উন্নয়নশীল দেশের, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে, জনকল্যাণকামী একটি সরকারের দীর্ঘস্থায়ী শাসনের মাধ্যমেই সে দেশে উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হয়। দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়লে সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। হাতের কাছেই উদাহরণ হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই জওহরলাল নেহরু শাসন করেছেন ষোলো বছর, আর তাঁর মৃত্যুর পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও কন্যা ইন্দিরা মিলে কংগ্রেসের শাসন চালিয়েছেন টানা ত্রিশ বছর। এভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে ভারত আজ একটি শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, আর বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ও মর্যাদাও বেড়েছে। বিপরীতে পাকিস্তান হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার বলি, অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি দেশটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অনেক পেছন থেকে এসে আমাদের বেশ পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। মূল কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, একেকটি সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার শত্রুরা ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এবং তাঁর প্রধান সহযোগীদের হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনাকেই নস্যাৎ করতে চেয়েছে। তারপরে আমরা সামরিক স্বৈরশাসনের নিচে পিষ্ট হলাম, এমনকি ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও আমরা ঠিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি করতে পারিনি। আশা করেছিলাম এবং সে আশার যথেষ্ট ভিত্তিও ছিল, যে এবারে স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশ বছর পরে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম ভাবার কারণ, আবার বহু বছর পরে দেশের বাম প্রগতিশীল অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে, আবার বহু বছর পরে তরুণ প্রজন্ম শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছে, দেশের নারী সমাজের মধ্যেও একই রকম পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়েছে। অর্থাৎ দেশব্যাপী একটা ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। এটা কেবল বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতা ছাড়া করার জন্যই হয়নি, তারা স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের আশাতেই মহাজোটের প্রতি আস্থা দেখিয়েছিল।
আমার আশঙ্কা, সরকার দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা একজন মানুষের প্রতি যে আচরণ করছে, তাতে সাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত আশা ঘা খাবে। সরকার ড. ইউনূসের সম্মান লাঘবের দায়িত্ব নিতে গিয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে সূচিত সম্ভাবনাটুকু বিনষ্ট করবে বলে আশঙ্কা হয়। ড. ইউনূসের সম্মান হরণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুরধার লেখনী ও বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন একদিকে দেশের বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর এবং অন্যদিকে বিরূপ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদী জঙ্গিশক্তি। আমাদের জানামতে, এরাই হলো আওয়ামী লীগের কট্টর বিরোধী শক্তি। আওয়ামী লীগ কি ইউনূস ও গ্রামীণ-বিরোধিতায় নেমে এবার পরীক্ষিত আওয়ামী-বিরোধীদের সঙ্গেও এক হবে?
তাহলে, যে বিপুল মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তাদের ভোট দিয়েছিল, তারা কী বারতা পাবে?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments