মুক্তিযুদ্ধ-অক্সফাম কেন ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ প্রকাশ করেছিল by জুলিয়ান ফ্রান্সিস
১৯৭১ সালে আমার বয়স ২৬। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান অক্সফামের ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, বারাসাত ও বনগাঁয়ে অবস্থিত বিভিন্ন শিবিরে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশিকে আমরা সহায়তা দিই, তাদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করি।
আমরা আগামী কয়েক মাসের হিসাব, আমাদের কতটা অর্থের প্রয়োজন হবে, তা আমরা আগেই ঠিক করে রাখতাম। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা হিসাব কষছিলাম, আগামী মাসগুলোতে শরণার্থীদের সহায়তায় আমাদের কতটা অর্থ ব্যয় হতে পারে। কারণ, এর পরের মাসগুলো ছিল শীতের সময়। আমরা জানতাম, কিছু কিছু এলাকায় শীত খুব তীব্র হতে পারে। এই সময়ে প্রতি মাসেই আমাদের বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন ছিল।
এটা ছিল ১৯৬৯ সালে বায়াফ্রার পরে সবচেয়ে বড় ত্রাণ কার্যক্রম। তার অর্থ হচ্ছে, অক্সফামের তহবিল গঠনের প্রচেষ্টা ও প্রচার হতে হবে সবচেয়ে সেরা, যার সঙ্গে আর কোনো প্রতিষ্ঠান পারবে না। আর সেটা ছিল এমন একটা সংকট, মনে হচ্ছিল যা কখনো শেষ হওয়ার নয়। এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় তহবিল গঠনের জন্য প্রয়োজন একটি টেকসই তহবিল গঠন কৌশল। তহবিল গঠনের জন্য বিজ্ঞাপনের বার্তাগুলো এমন হতে হবে, যা মানুষের অনুভূতিতে নাড়া দেবে এবং তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। যেহেতু ১৯৭১-এ শীত তখন আসি আসি করছে, আমাদের প্রয়োজন ছিল কম্বল ও গরম কাপড়, অক্সফাম তখন ব্যাপকভাবে তহবিল গঠনের জন্য প্রচার শুরু করল। ‘আপনার বিছানা থেকে একটি কম্বল আমাদের দিন, এই ক্রিসমাসে নতুন একটি সোয়েটার কিনুন, আর পুরোনোটি অক্সফামকে দিন।’ ব্রিটিশ ডাক বিভাগ কম্বল ও গরম কাপড়গুলো পার্সেল পোস্টে পাঠানোর জন্য কোনো ফি নেয়নি। অক্সফামের পক্ষ থেকে বলা হলে রয়েল এয়ারফোর্সও বিনা মাশুলে কম্বলগুলো কলকাতায় পৌঁছে দিয়েছে।
আমাদের মধ্যে যাঁরা এখনো তরুণ, তাঁরা স্মরণ করতে পারেন, ১৯৭১ সালে প্রায় ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশি ভারতের ৯০০টি শরণার্থী শিবিরে ছিল। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো, তাদের তত্ত্বাবধান করা, আজ এত বছর পরও কত কঠিন একটি কাজ মনে হয়। তাহলে কীভাবে এটা করা হয়েছিল? অসংখ্য মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, নায়কোচিত অটুল মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। যাঁরা এ কাজগুলো করেছেন, তাঁরা কোনো খ্যাতি বা স্বীকৃতির জন্য এটা করেননি। সময়ের প্রয়োজনে কাজটি করা দরকার ছিল বলেই তাঁরা করেছেন।
অক্সফামের তহবিল গঠন প্রচেষ্টা মাঝেমধ্যে কঠিন হয়ে পড়ত, যখন বিশ্বের বড় দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় শরণার্থীদের সংকট নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হতো। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর, মে-জুন মাসে শরণার্থী শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় শিরোনামে ছাপানো হয়। এরপর বর্ষাকালে শরণার্থী শিবিরগুলো ডুবে গেলে আবার প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয়। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো শিরোনাম করে, ‘মৃত্যুর মিছিল’, ‘শরণার্থীরা কখনো বাড়ি যেতে পারবে?’ ‘বায়াফ্রা থেকে পাকিস্তানি দুর্ভিক্ষ শোচনীয়’।
অক্সফোর্ডে অক্সফামের প্রধান কার্যালয় সিদ্ধান্ত নিল, পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক বিপর্যয় ও সংকট সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের জানাতে হবে। খুলে দিতে হবে তাদের চোখ। জাগাতে হবে তাদের! বিস্ময়করভাবে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও বিবৃতি সংগ্রহ করা হলো। সেগুলো প্রকাশিত হলো ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ বা বাঙালি মানুষের সংকটে ৬০ জনের সাক্ষ্য। সেটা ওই সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বিবৃতি ও লেখা নিয়ে একটি ভিন্ন রকম দলিল। এতে ছিল মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, প্রখ্যাত সাংবাদিক জন পিলজার, নিকোলাস টোমালিন এবং ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের মতো মানুষের বিবৃতি। এই মি. হোলিংওয়ার্থের বয়স এখন ৯৯, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিবেদক হিসেবে যিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমি নিজে কলকাতার অনেক লোকের বিবৃতি সংগ্রহ করেছিলাম। আমি স্মরণ করতে পারি, একদিন কয়েকজনের বিবৃতি নিয়ে একটি টেলেক্স আমি অক্সফামের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম, যাতে সময় লেগেছিল ৭৫ মিনিট। টেস্টিমনি অব সিক্সটি সে বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সব রাষ্ট্রদূতের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছেও এটি ডাকে পাঠানো হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর, যেদিন এই টেস্টিমনি অব সিক্সটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশের দিন, তার আগের দিন অক্সফাম একটি অন্য রকম কাজ করেছিল। ব্রিটিশ ডাক বিভাগের কাছ থেকে তারা অসংখ্য টেলিফোন ডিরেক্টরি সংগ্রহ করেছিল, যার মাধ্যমে অক্সফাম সারা যুক্তরাজ্যের ৪৯ মিলিয়ন মানুষের নাম জড়ো করেছিল। এবং এই টেলিফোন ডিরেক্টরিগুলো রাখা হয়েছিল লন্ডনে অক্সফামের একটি প্রতিষ্ঠানে, যেটি অবস্থিত লন্ডনের ৪৯ পার্লামেন্ট স্ট্রিটে অবস্থিত। ওই সময় নয় মিলিয়ন বাংলাদেশি শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন শিবিরে ছিল, আর অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল আরও ৪০ মিলিয়ন বাংলাদেশি, যারা প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করছিল তীব্র ক্ষুধা।
‘টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ বা ‘ষাটজনের সাক্ষ্য’ এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যখন ভারত কূটনৈতিকসহ অন্যান্য উপায়ে বিশ্বব্যাপী সমর্থন আদায়ের জন্য জোর চেষ্টা করছিল। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ সফর করেন। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েকটি দেশ সফর করেন। এর বাইরে বিশেষ দূত হিসেবে প্রখ্যাত গান্ধীবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে অসংখ্য দেশ ভ্রমণ করেন। টুকে রাখার মতো মজার তথ্য হলো, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি টেস্টিমনি অব সিক্সটি মার্কিন সিনেটের নজরে আনেন। ২৮ অক্টোবর ‘কংগ্রেশনাল রেকর্ডে’ এটি প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যে এটি প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর প্রচেষ্টায় এটি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে প্রকাশ করা সম্ভব হয়। অনেকেই জানেন, এডওয়ার্ড কেনেডি মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন।
মার্কিন সিনেটে টেস্টিমনি অব সিক্সটি তুলে ধরে সিনেটর কেনেডি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তার বক্তব্যটি ছিল এ রকম:
‘মি. প্রেসিডেন্ট, পূর্ববাংলার সংকট এমন এক অবর্ণনীয় মানবিক দুর্দশার কাহিনি, যা এই আধুনিক সময়ে কোনো মানদণ্ডেই পরিমাপ করা যায় না। এটা নিয়মবদ্ধ সন্ত্রাস ও সামরিক আগ্রাসনের করুণ এক কাহিনি। এটা এমন এক কাহিনি, যা কেবল নজিরবিহীন হত্যা এবং লাখো মানুষের হত্যা ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার। এটা মৃত্যু ও জীবনঘাতী রোগের কাহিনি, যেখানে খাদ্য-পানি নেই বললেই চলে, যেখানে শরণার্থী শিবিরগুলো পূতিগন্ধময়, যেখানে কোনো আশা নেই, যেখানে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কেবল দুর্ভিক্ষ এবং তার পরও বিশ্বের কোনো দেশ টুঁ-শব্দটি করছে না।
‘সম্ভবত এটা এ কারণে যে, যে দুনিয়া আমরা তৈরি করেছি, তাতে আমরা এ রকম দুঃখ-কষ্ট ও অন্যায্যতা মেনে নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের যে দুর্দশা ও মানবিক বিপর্যয় চলছে, বাঙালিদের এই দুর্ভোগ তারই একটি অংশ মাত্র।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, সম্ভবত মানুষ নীরব রয়েছে, কারণ তারা জানে না।
‘জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান অক্সফাম সম্প্র্রতি তথ্য সহকারে দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ নামে একটি দলিল প্রকাশ করেছে। যারা এই দলিলটি পড়বে, তারা জানতে পারবে বাঙালিদের দুঃখগাথা, যারা এটি পড়বে, তারা কেউ চুপ থাকতে পারবে না।
‘এই দলিলটি সিনেটের সব সদস্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে আমি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে এটি প্রকাশের জন্য সর্বসম্মতক্রমে সম্মতি প্রার্থনা করছি।’
সিনেটের কোনো সদস্যের কাছ থেকে আপত্তি না আসায় টেস্টিমনি অব সিক্সটি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে ছাপানোর আদেশ দিয়ে বলা হয়, যদিও মার্কিন সরকার এই সময়ে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে, তারপরও এটি রেকর্ড করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ যুদ্ধে তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনায় মার্কিন জনগণ তাদের সহূদয়তার প্রকাশ ঘটিয়েছে। তা ছাড়া মার্কিন জনগণের দান করা বিপুলসংখ্যক ওষুধ শরণার্থী শিবিরে ব্যবহারের জন্য অক্সফামকে দেওয়া হয়েছে।
২০০৬ সালের অক্টোবরে আমি টেস্টিমনি অব সিক্সটির একটি মূল কপি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে তুলে দিই। এই দেশটি কীভাবে গঠিত হলো, কী যন্ত্রণা, কী কষ্ট এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, তা যেন সবাই জানতে পারে, সে জন্য পরের বছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর আরেকটি অবিকল প্রতিরূপ প্রকাশ করে। ২০০৯ সালে বাংলা দৈনিক প্রথম আলোও বাংলায় এটি প্রকাশ করে।
টেস্টিমনি অব সিক্সটি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এবং কেন প্রকাশিত হয়েছিল, এই হলো সেই কাহিনি।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: চর জীবিকায়ন কর্মসূচির (সিএলপি) কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন উপদেষ্টা। ১৯৭১ সালে অক্সফামের ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়ক, যে কার্যক্রমের আওতায় ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছিল।
এটা ছিল ১৯৬৯ সালে বায়াফ্রার পরে সবচেয়ে বড় ত্রাণ কার্যক্রম। তার অর্থ হচ্ছে, অক্সফামের তহবিল গঠনের প্রচেষ্টা ও প্রচার হতে হবে সবচেয়ে সেরা, যার সঙ্গে আর কোনো প্রতিষ্ঠান পারবে না। আর সেটা ছিল এমন একটা সংকট, মনে হচ্ছিল যা কখনো শেষ হওয়ার নয়। এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় তহবিল গঠনের জন্য প্রয়োজন একটি টেকসই তহবিল গঠন কৌশল। তহবিল গঠনের জন্য বিজ্ঞাপনের বার্তাগুলো এমন হতে হবে, যা মানুষের অনুভূতিতে নাড়া দেবে এবং তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। যেহেতু ১৯৭১-এ শীত তখন আসি আসি করছে, আমাদের প্রয়োজন ছিল কম্বল ও গরম কাপড়, অক্সফাম তখন ব্যাপকভাবে তহবিল গঠনের জন্য প্রচার শুরু করল। ‘আপনার বিছানা থেকে একটি কম্বল আমাদের দিন, এই ক্রিসমাসে নতুন একটি সোয়েটার কিনুন, আর পুরোনোটি অক্সফামকে দিন।’ ব্রিটিশ ডাক বিভাগ কম্বল ও গরম কাপড়গুলো পার্সেল পোস্টে পাঠানোর জন্য কোনো ফি নেয়নি। অক্সফামের পক্ষ থেকে বলা হলে রয়েল এয়ারফোর্সও বিনা মাশুলে কম্বলগুলো কলকাতায় পৌঁছে দিয়েছে।
আমাদের মধ্যে যাঁরা এখনো তরুণ, তাঁরা স্মরণ করতে পারেন, ১৯৭১ সালে প্রায় ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশি ভারতের ৯০০টি শরণার্থী শিবিরে ছিল। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো, তাদের তত্ত্বাবধান করা, আজ এত বছর পরও কত কঠিন একটি কাজ মনে হয়। তাহলে কীভাবে এটা করা হয়েছিল? অসংখ্য মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, নায়কোচিত অটুল মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। যাঁরা এ কাজগুলো করেছেন, তাঁরা কোনো খ্যাতি বা স্বীকৃতির জন্য এটা করেননি। সময়ের প্রয়োজনে কাজটি করা দরকার ছিল বলেই তাঁরা করেছেন।
অক্সফামের তহবিল গঠন প্রচেষ্টা মাঝেমধ্যে কঠিন হয়ে পড়ত, যখন বিশ্বের বড় দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় শরণার্থীদের সংকট নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হতো। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর, মে-জুন মাসে শরণার্থী শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় শিরোনামে ছাপানো হয়। এরপর বর্ষাকালে শরণার্থী শিবিরগুলো ডুবে গেলে আবার প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয়। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো শিরোনাম করে, ‘মৃত্যুর মিছিল’, ‘শরণার্থীরা কখনো বাড়ি যেতে পারবে?’ ‘বায়াফ্রা থেকে পাকিস্তানি দুর্ভিক্ষ শোচনীয়’।
অক্সফোর্ডে অক্সফামের প্রধান কার্যালয় সিদ্ধান্ত নিল, পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক বিপর্যয় ও সংকট সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের জানাতে হবে। খুলে দিতে হবে তাদের চোখ। জাগাতে হবে তাদের! বিস্ময়করভাবে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও বিবৃতি সংগ্রহ করা হলো। সেগুলো প্রকাশিত হলো ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ বা বাঙালি মানুষের সংকটে ৬০ জনের সাক্ষ্য। সেটা ওই সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বিবৃতি ও লেখা নিয়ে একটি ভিন্ন রকম দলিল। এতে ছিল মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, প্রখ্যাত সাংবাদিক জন পিলজার, নিকোলাস টোমালিন এবং ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের মতো মানুষের বিবৃতি। এই মি. হোলিংওয়ার্থের বয়স এখন ৯৯, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিবেদক হিসেবে যিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমি নিজে কলকাতার অনেক লোকের বিবৃতি সংগ্রহ করেছিলাম। আমি স্মরণ করতে পারি, একদিন কয়েকজনের বিবৃতি নিয়ে একটি টেলেক্স আমি অক্সফামের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম, যাতে সময় লেগেছিল ৭৫ মিনিট। টেস্টিমনি অব সিক্সটি সে বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সব রাষ্ট্রদূতের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছেও এটি ডাকে পাঠানো হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর, যেদিন এই টেস্টিমনি অব সিক্সটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশের দিন, তার আগের দিন অক্সফাম একটি অন্য রকম কাজ করেছিল। ব্রিটিশ ডাক বিভাগের কাছ থেকে তারা অসংখ্য টেলিফোন ডিরেক্টরি সংগ্রহ করেছিল, যার মাধ্যমে অক্সফাম সারা যুক্তরাজ্যের ৪৯ মিলিয়ন মানুষের নাম জড়ো করেছিল। এবং এই টেলিফোন ডিরেক্টরিগুলো রাখা হয়েছিল লন্ডনে অক্সফামের একটি প্রতিষ্ঠানে, যেটি অবস্থিত লন্ডনের ৪৯ পার্লামেন্ট স্ট্রিটে অবস্থিত। ওই সময় নয় মিলিয়ন বাংলাদেশি শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন শিবিরে ছিল, আর অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল আরও ৪০ মিলিয়ন বাংলাদেশি, যারা প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করছিল তীব্র ক্ষুধা।
‘টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ বা ‘ষাটজনের সাক্ষ্য’ এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যখন ভারত কূটনৈতিকসহ অন্যান্য উপায়ে বিশ্বব্যাপী সমর্থন আদায়ের জন্য জোর চেষ্টা করছিল। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ সফর করেন। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েকটি দেশ সফর করেন। এর বাইরে বিশেষ দূত হিসেবে প্রখ্যাত গান্ধীবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে অসংখ্য দেশ ভ্রমণ করেন। টুকে রাখার মতো মজার তথ্য হলো, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি টেস্টিমনি অব সিক্সটি মার্কিন সিনেটের নজরে আনেন। ২৮ অক্টোবর ‘কংগ্রেশনাল রেকর্ডে’ এটি প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যে এটি প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর প্রচেষ্টায় এটি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে প্রকাশ করা সম্ভব হয়। অনেকেই জানেন, এডওয়ার্ড কেনেডি মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন।
মার্কিন সিনেটে টেস্টিমনি অব সিক্সটি তুলে ধরে সিনেটর কেনেডি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তার বক্তব্যটি ছিল এ রকম:
‘মি. প্রেসিডেন্ট, পূর্ববাংলার সংকট এমন এক অবর্ণনীয় মানবিক দুর্দশার কাহিনি, যা এই আধুনিক সময়ে কোনো মানদণ্ডেই পরিমাপ করা যায় না। এটা নিয়মবদ্ধ সন্ত্রাস ও সামরিক আগ্রাসনের করুণ এক কাহিনি। এটা এমন এক কাহিনি, যা কেবল নজিরবিহীন হত্যা এবং লাখো মানুষের হত্যা ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার। এটা মৃত্যু ও জীবনঘাতী রোগের কাহিনি, যেখানে খাদ্য-পানি নেই বললেই চলে, যেখানে শরণার্থী শিবিরগুলো পূতিগন্ধময়, যেখানে কোনো আশা নেই, যেখানে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কেবল দুর্ভিক্ষ এবং তার পরও বিশ্বের কোনো দেশ টুঁ-শব্দটি করছে না।
‘সম্ভবত এটা এ কারণে যে, যে দুনিয়া আমরা তৈরি করেছি, তাতে আমরা এ রকম দুঃখ-কষ্ট ও অন্যায্যতা মেনে নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের যে দুর্দশা ও মানবিক বিপর্যয় চলছে, বাঙালিদের এই দুর্ভোগ তারই একটি অংশ মাত্র।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, সম্ভবত মানুষ নীরব রয়েছে, কারণ তারা জানে না।
‘জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান অক্সফাম সম্প্র্রতি তথ্য সহকারে দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ নামে একটি দলিল প্রকাশ করেছে। যারা এই দলিলটি পড়বে, তারা জানতে পারবে বাঙালিদের দুঃখগাথা, যারা এটি পড়বে, তারা কেউ চুপ থাকতে পারবে না।
‘এই দলিলটি সিনেটের সব সদস্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে আমি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে এটি প্রকাশের জন্য সর্বসম্মতক্রমে সম্মতি প্রার্থনা করছি।’
সিনেটের কোনো সদস্যের কাছ থেকে আপত্তি না আসায় টেস্টিমনি অব সিক্সটি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে ছাপানোর আদেশ দিয়ে বলা হয়, যদিও মার্কিন সরকার এই সময়ে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে, তারপরও এটি রেকর্ড করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ যুদ্ধে তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনায় মার্কিন জনগণ তাদের সহূদয়তার প্রকাশ ঘটিয়েছে। তা ছাড়া মার্কিন জনগণের দান করা বিপুলসংখ্যক ওষুধ শরণার্থী শিবিরে ব্যবহারের জন্য অক্সফামকে দেওয়া হয়েছে।
২০০৬ সালের অক্টোবরে আমি টেস্টিমনি অব সিক্সটির একটি মূল কপি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে তুলে দিই। এই দেশটি কীভাবে গঠিত হলো, কী যন্ত্রণা, কী কষ্ট এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, তা যেন সবাই জানতে পারে, সে জন্য পরের বছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর আরেকটি অবিকল প্রতিরূপ প্রকাশ করে। ২০০৯ সালে বাংলা দৈনিক প্রথম আলোও বাংলায় এটি প্রকাশ করে।
টেস্টিমনি অব সিক্সটি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এবং কেন প্রকাশিত হয়েছিল, এই হলো সেই কাহিনি।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: চর জীবিকায়ন কর্মসূচির (সিএলপি) কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন উপদেষ্টা। ১৯৭১ সালে অক্সফামের ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়ক, যে কার্যক্রমের আওতায় ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছিল।
No comments