বাঘা তেঁতুল-আদমি ও মানুষ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আদমশুমারি হয়ে গেল। সব এলাকা থেকে প্রাপ্ত সংখ্যাগুলোর যোগফলে জানা যাবে, বর্তমানে বাংলাদেশে লোকসংখ্যা কত। আরও জানা যাবে দেশে অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের সংখ্যা কত। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মানুষ কত। চাকরিজীবী কত, ব্যবসায়ী কত, গৃহবধূ কত।
আদমশুমারিতে দেশের মানুষের মোট সংখ্যাটা জানা যাবে—মানুষের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে কোনো সংবাদ নয়।
লোকগণনার প্রচলিত যে পদ্ধতি তাতে ব্যক্তির সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়—মানুষের জীবন সম্পর্কে কিছু জানার ব্যবস্থা নেই। ব্যক্তিটি আদৌ লেখাপড়া করেছে কি না বা বিএ-এমএ পাস কি না, সে সংবাদ সংগ্রহ করা হয়। মানুষটির চরিত্র সম্পর্কে কোনো কিছু জানা যায় না। জানার উপায় নেই দেশে বিচার-বিবেচনাশীল মানুষের সংখ্যা কত। করুণাময় মানুষের সংখ্যা কত। নির্দয় মানুষের সংখ্যা কত। অন্যের দুঃখ-কষ্টের সময় সাহায্যে এগিয়ে যায় এমন মানুষের সংখ্যা কত। নির্মল মনের অধিকারী মানুষের সংখ্যা কত। কলুষিত মনের মানুষের সংখ্যা কত। মোট জনসংখ্যার কত ভাগ সৎ আর কত ভাগ অসৎ। নীতিবান ও দুর্নীতিপরায়ণ লোকের হারই বা কত।
প্রত্যেক মানুষের যেমন নিজস্ব চরিত্র আছে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর একটি অভিন্ন সামাজিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যেকোনো ব্যাপারে মাত্রার তারতম্য অবশ্য থাকে, কিন্তু মূল জায়গাটিতে একটি জনগোষ্ঠীর সবাই মোটের ওপর এক। জাতির সামগ্রিক স্বভাব ও চরিত্রটি তৈরি হয় শত শত বছরে—৪০ বছরেও নয়, ৬৪ বছরেও নয়।
দেশ মানেই সে দেশের মানুষ। জনমানবহীন অঞ্চল অথবা মরুভূমি স্রেফ ভূখণ্ড মাত্র। মানুষশূন্য সমুদ্রবেষ্টিত ভূখণ্ডকে আমরা দ্বীপ বলি—দেশ বলি না। জাপান ও কোরিয়ার দ্বীপগুলো আর দ্বীপ নেই—মানুষের কারণে সেগুলো দেশ হয়ে গেছে। দেশের মানুষ যেমন, দেশও তেমনি। তারা তাদের দেশের প্রাচীন ধর্মগুরু ও দার্শনিকদের উপদেশ ও শিক্ষা অনুসরণ করে একটি জাতীয় চরিত্র গঠন করেছে। সাংঘাতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগের মধ্যেও তারা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখে।
যে দেশের জনগোষ্ঠীর অন্তরে দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধেছে, সে সমাজে দুর্নীতি করতে উপায়ের অভাব হয় না। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে বড় বড়রা ভাগবাটোয়ারা করবেন, তা স্বাভাবিক। তা না করলে সামান্য গুটিকয় মাইনের টাকায় তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে না। কিন্তু উপরি টাকার দরকার, সরকারে যাঁরা যেখানে আছেন তাঁদের সবারই। সামান্য বয়স্ক ভাতা হোক, কাজের বিনিময়ে খাদ্যের গম বা টাকা হোক, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হোক তা থেকেও একটি অংশ দায়িপ্তপ্রাপ্তদের পকেটে পোরা চাই।
আমাদের শিক্ষিত বেকারের দেশ। সরকারি কাজের বিভিন্ন উপলক্ষে কখনো বহু মানুষের কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা হয়। আদমশুমারির সময় গণনাকারীরা কয়েক দিনে সামান্য রোজগার করেন। খবরের কাগজে দেখলাম, গণনাকারীদের প্রশিক্ষণ ভাতা আত্মসাতের অভিযোগ। ‘আমতলী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নসহ পৌরসভার ১১টি কেন্দ্রে ৫ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২৭ জন গণনাকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ চলাকালে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে মাথাপিছু প্রতিদিন ২০০ টাকা করে ভাতা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু তিন দিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাদের ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।’ [প্রথম আলো] খুব বেশি নয়, মোটের ওপর লাখ খানেক টাকা এধার-ওধার হয়েছে বলে মনে হয়। তবে এ রকম ঘটনা যে শুধু একটিমাত্র উপজেলায় ঘটেছে তা নয়।
এবারই সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ ছিল আদমশুমারির জন্য। ২৫২ কোটি টাকা। তিন লাখ ১০ হাজার গণনাকারী কয়েক দিনে যে সামান্য টাকা পেয়েছেন, তা তাঁদের পরিশ্রমের বিনিময়ে। তাঁদের বাইরে যাঁরা বরাদ্দের টাকা থেকে কিঞ্চিৎ রোজগার করে নিয়েছেন, তা ফাঁকতালে। তবে যদি ধরে নিই, আড়াই শ কোটি টাকা অতি সুষ্ঠুভাবে খরচ হয়েছে, দুর্নীতির লেশমাত্র ছিল না, তা হলেও বলতে হবে, দেড় শ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে দায়সারা গোছের আদমশুমারি হয়ে গেল। ভারতে দীর্ঘ সময় নিয়ে লোকগণনার কাজ শেষ হয়েছে। আমাদের চার-পাঁচ দিনেই খতম। মনে হচ্ছে, কাজটা ঘরে বসেও করা যেত। মোট যোগফল একটা ঘোষণা দিয়ে দিলেই হতো, ১৫ কোটি ৮২ লাখ। কে তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই করতে যাবে? অথচ লোকগণনা আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য।
ব্রিটিশ আমলে আধুনিক সেনসাস প্রথার প্রবর্তন হয়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা উপমহাদেশের মানুষকে মানুষ মনে করত না। তাই সেনসাস বা সরকারি লোকগণনাকে নেটিভ ভাষায় নামকরণ করেছিল আদমশুমারি। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর একবার আধখানা স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়বার পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়ার পরও আমরা যেন আদমিই রয়ে গেছি—জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠিনি।
রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান তখন পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটি। ৭০ বছরে বেড়েছে চার গুণের বেশি। দেশের একটা ভূগোল বা শরীর আছে বটে, কিন্তু হাত-পা-মাথা নেই। দেশের মানুষেরাই দেশ। আশাবাদী, উদ্যোগী ও উন্নত চরিত্রের মানুষেরাই গঠন করেন উন্নত দেশ। অলস, অকর্মণ্য, অসৎ, হতাশ ও স্বপ্নহীন মানুষ কোনো রকমে বেঁচে থাকে বটে—কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। আমাদের মুগ্ধ জননী জন্মভূমি তার ১৫-১৬ কোটি সন্তানকে ‘বাঙালি’ করে রাখলেও ক্ষতি নেই, মানুষের মতো মানুষ করে না তুললে তা দুঃখের কথা। সুন্দর পৃথিবীর জন্য আদমি নয়, মানুষ চাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
লোকগণনার প্রচলিত যে পদ্ধতি তাতে ব্যক্তির সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়—মানুষের জীবন সম্পর্কে কিছু জানার ব্যবস্থা নেই। ব্যক্তিটি আদৌ লেখাপড়া করেছে কি না বা বিএ-এমএ পাস কি না, সে সংবাদ সংগ্রহ করা হয়। মানুষটির চরিত্র সম্পর্কে কোনো কিছু জানা যায় না। জানার উপায় নেই দেশে বিচার-বিবেচনাশীল মানুষের সংখ্যা কত। করুণাময় মানুষের সংখ্যা কত। নির্দয় মানুষের সংখ্যা কত। অন্যের দুঃখ-কষ্টের সময় সাহায্যে এগিয়ে যায় এমন মানুষের সংখ্যা কত। নির্মল মনের অধিকারী মানুষের সংখ্যা কত। কলুষিত মনের মানুষের সংখ্যা কত। মোট জনসংখ্যার কত ভাগ সৎ আর কত ভাগ অসৎ। নীতিবান ও দুর্নীতিপরায়ণ লোকের হারই বা কত।
প্রত্যেক মানুষের যেমন নিজস্ব চরিত্র আছে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর একটি অভিন্ন সামাজিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যেকোনো ব্যাপারে মাত্রার তারতম্য অবশ্য থাকে, কিন্তু মূল জায়গাটিতে একটি জনগোষ্ঠীর সবাই মোটের ওপর এক। জাতির সামগ্রিক স্বভাব ও চরিত্রটি তৈরি হয় শত শত বছরে—৪০ বছরেও নয়, ৬৪ বছরেও নয়।
দেশ মানেই সে দেশের মানুষ। জনমানবহীন অঞ্চল অথবা মরুভূমি স্রেফ ভূখণ্ড মাত্র। মানুষশূন্য সমুদ্রবেষ্টিত ভূখণ্ডকে আমরা দ্বীপ বলি—দেশ বলি না। জাপান ও কোরিয়ার দ্বীপগুলো আর দ্বীপ নেই—মানুষের কারণে সেগুলো দেশ হয়ে গেছে। দেশের মানুষ যেমন, দেশও তেমনি। তারা তাদের দেশের প্রাচীন ধর্মগুরু ও দার্শনিকদের উপদেশ ও শিক্ষা অনুসরণ করে একটি জাতীয় চরিত্র গঠন করেছে। সাংঘাতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগের মধ্যেও তারা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখে।
যে দেশের জনগোষ্ঠীর অন্তরে দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধেছে, সে সমাজে দুর্নীতি করতে উপায়ের অভাব হয় না। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে বড় বড়রা ভাগবাটোয়ারা করবেন, তা স্বাভাবিক। তা না করলে সামান্য গুটিকয় মাইনের টাকায় তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে না। কিন্তু উপরি টাকার দরকার, সরকারে যাঁরা যেখানে আছেন তাঁদের সবারই। সামান্য বয়স্ক ভাতা হোক, কাজের বিনিময়ে খাদ্যের গম বা টাকা হোক, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হোক তা থেকেও একটি অংশ দায়িপ্তপ্রাপ্তদের পকেটে পোরা চাই।
আমাদের শিক্ষিত বেকারের দেশ। সরকারি কাজের বিভিন্ন উপলক্ষে কখনো বহু মানুষের কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা হয়। আদমশুমারির সময় গণনাকারীরা কয়েক দিনে সামান্য রোজগার করেন। খবরের কাগজে দেখলাম, গণনাকারীদের প্রশিক্ষণ ভাতা আত্মসাতের অভিযোগ। ‘আমতলী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নসহ পৌরসভার ১১টি কেন্দ্রে ৫ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২৭ জন গণনাকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ চলাকালে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে মাথাপিছু প্রতিদিন ২০০ টাকা করে ভাতা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু তিন দিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাদের ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।’ [প্রথম আলো] খুব বেশি নয়, মোটের ওপর লাখ খানেক টাকা এধার-ওধার হয়েছে বলে মনে হয়। তবে এ রকম ঘটনা যে শুধু একটিমাত্র উপজেলায় ঘটেছে তা নয়।
এবারই সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ ছিল আদমশুমারির জন্য। ২৫২ কোটি টাকা। তিন লাখ ১০ হাজার গণনাকারী কয়েক দিনে যে সামান্য টাকা পেয়েছেন, তা তাঁদের পরিশ্রমের বিনিময়ে। তাঁদের বাইরে যাঁরা বরাদ্দের টাকা থেকে কিঞ্চিৎ রোজগার করে নিয়েছেন, তা ফাঁকতালে। তবে যদি ধরে নিই, আড়াই শ কোটি টাকা অতি সুষ্ঠুভাবে খরচ হয়েছে, দুর্নীতির লেশমাত্র ছিল না, তা হলেও বলতে হবে, দেড় শ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে দায়সারা গোছের আদমশুমারি হয়ে গেল। ভারতে দীর্ঘ সময় নিয়ে লোকগণনার কাজ শেষ হয়েছে। আমাদের চার-পাঁচ দিনেই খতম। মনে হচ্ছে, কাজটা ঘরে বসেও করা যেত। মোট যোগফল একটা ঘোষণা দিয়ে দিলেই হতো, ১৫ কোটি ৮২ লাখ। কে তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই করতে যাবে? অথচ লোকগণনা আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য।
ব্রিটিশ আমলে আধুনিক সেনসাস প্রথার প্রবর্তন হয়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা উপমহাদেশের মানুষকে মানুষ মনে করত না। তাই সেনসাস বা সরকারি লোকগণনাকে নেটিভ ভাষায় নামকরণ করেছিল আদমশুমারি। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর একবার আধখানা স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়বার পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়ার পরও আমরা যেন আদমিই রয়ে গেছি—জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠিনি।
রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান তখন পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটি। ৭০ বছরে বেড়েছে চার গুণের বেশি। দেশের একটা ভূগোল বা শরীর আছে বটে, কিন্তু হাত-পা-মাথা নেই। দেশের মানুষেরাই দেশ। আশাবাদী, উদ্যোগী ও উন্নত চরিত্রের মানুষেরাই গঠন করেন উন্নত দেশ। অলস, অকর্মণ্য, অসৎ, হতাশ ও স্বপ্নহীন মানুষ কোনো রকমে বেঁচে থাকে বটে—কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। আমাদের মুগ্ধ জননী জন্মভূমি তার ১৫-১৬ কোটি সন্তানকে ‘বাঙালি’ করে রাখলেও ক্ষতি নেই, মানুষের মতো মানুষ করে না তুললে তা দুঃখের কথা। সুন্দর পৃথিবীর জন্য আদমি নয়, মানুষ চাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments