যুদ্ধবিরোধী ওবামার লিবিয়া সংকট by গাজীউল হাসান খান
একজন যুদ্ধবিরোধী প্রার্থী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বারাক ওবামা। রিপাবলিকান-দলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ কিংবা তাঁর অনুসারী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইন ছিলেন ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের পক্ষে।
জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই একতরফা ইরাকে সাদ্দামবিরোধী যুদ্ধে গিয়ে 'যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট' হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছিলেন জর্জ বুশ। মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে লিবিয়া থেকে সেভাবে উচ্ছেদ করে তাঁর পূর্বসূরির মতো যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্টের অপবাদটুকু নিতে চাননি বারাক ওবামা। তাই তাঁকে নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কি তিনি পেরেছেন 'আক্রমণকারীর' অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে? লিবিয়ার, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় নিরস্ত্র অথচ বিক্ষুব্ধ জনগণের ওপর জঙ্গিবিমান থেকে হামলা চালাতে গিয়ে ৪১ বছরের স্বৈরশাসক গাদ্দাফি শান্তিকামী বিশ্ববাসীর নিন্দা কুড়িয়েছেন। একবাক্যে সবাই অভিযোগ করেছে, দেশ শাসনের সব বৈধতা হারিয়েছেন গাদ্দাফি। একই অভিযোগ আরো বলিষ্ঠ এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চারিত হয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসি প্রশাসন থেকে। প্রেসিডেন্ট ওবামা থেকে শুরু করে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর নেতারা বলেছিলেন_সে অবস্থায় তাঁরা অলসভাবে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। তাই তাঁরা প্রেসিডেন্ট ওবামার সমর্থনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গিয়েছিলেন গাদ্দাফির অমানবিক অভিযানের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে। নিরাপত্তা পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এবং ত্রিপোলি ও বেনগাজির মধ্যে 'উড্ডয়নমুক্ত এলাকা' কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই 'অতি-উৎসাহী' ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া গাদ্দাফির বাহিনী ও তাদের সামরিক স্থাপনার ওপর জঙ্গিবিমান থেকে উপর্যুপরি হামলা চালায়।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সদর দপ্তরে পেঁৗছানোর আগেই লিবিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সামরিক স্থাপনার ওপর বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় সব কিছু অকার্যকর করে দেওয়া হয়। সে অপারেশনে ফরাসি জঙ্গিবিমান থেকে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চালানো হয় টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বেনগাজি অভিমুখে আজদাবিয়া এবং ত্রিপোলির দিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মিসরাতায় ফরাসি জঙ্গিবিমান থেকে গাদ্দাফি বাহিনী ও তাদের স্থাপনার ওপর উপর্যুপরি হামলা চালানো হয় ২৮ মার্চ অপরাহ্ন পর্যন্ত। ওই বিমান হামলার সহায়তায় গাদ্দাফিবিরোধীরা তাদের প্রতিপক্ষকে হটিয়ে ক্রমশ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। তাই এখানে প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কারা বাস্তবায়ন করেছে এবং কারা করেনি। বারবার বলা হয়েছে, গাদ্দাফি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কার্যকর করেননি। তাই নিরস্ত্র পূর্বাঞ্চলবাসীর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই বারবার হামলা চালাতে হয়েছে। কিন্তু ২৯ মার্চ যখন গাদ্দাফির জন্মস্থান বা নিজ শহর সার্তের দখল নেওয়ার জন্য তাঁর বিরোধী শক্তি অগ্রসর হচ্ছিল, তখন ফরাসি জঙ্গিবিমান সে অঞ্চলের আকাশে উড়তে দেখা যায়নি। ফলে গাদ্দাফিবিরোধীদের যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পিছু হটতে হয়েছে। লন্ডনে তখন বসেছিল জাতিসংঘ, ন্যাটো, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) মহাসচিবরাসহ সাতটি আরব রাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ সভা। মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পরিচালনায় কিভাবে মিত্রশক্তির পরিবর্তে ন্যাটো বাহিনীর ওপর লিবিয়ায় যুদ্ধবিরতি সুনিশ্চিত ও জনগণের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি হস্তান্তর করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তা ছাড়া যুদ্ধ শেষে কিভাবে মানবিক সাহায্য প্রদান ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। ইতিমধ্যে আরো দুটি বিষয় আলোচনার প্রধান দিক হিসেবে উঠে আসে_তা হচ্ছে গাদ্দাফির বিদায় ও লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতৃত্বে যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। তাদের অভিযোগ, গাদ্দাফি দেশ শাসনের সব নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব স্বীকার করেও তা বাস্তবায়ন না করে এবং নিজ দেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর হামলা চালিয়ে তিনি 'যুদ্ধাপরাধ' করেছেন। সুতরাং তাঁর শাস্তি হতে হবে, নতুবা তাঁকে সপরিবারে চিরদিনের জন্য লিবিয়া ত্যাগ করতে হবে।
ফ্রান্স ও কাতারসহ কয়েকটি রাষ্ট্র ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলে গঠিত মোস্তফা আবদেল জলিলের নেতৃত্বাধীন ৩১ সদস্যবিশিষ্ট লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল ইতিমধ্যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সরকারের একটি আট দফা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাতে রয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী লিবিয়ার জন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন ও তা লিবিয়ার জনগণের অনুমোদনের জন্য গণভোটে দেওয়া এবং সেই ভিত্তিতে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। ফ্রান্স, ব্রিটেন ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো সে সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতেও সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং ট্রেড ইউনিয়ন চালু করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফিবিরোধী শক্তি ২৭ ফেব্রুয়ারি বেনগাজিতে লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল এবং তারই ভিত্তিতে ২৩ মার্চ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছিল। এ সরকারের সামরিক শক্তি হচ্ছে গাদ্দাফির প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে আসা অফিসার ও সদস্যরা। তা ছাড়া, দেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং যুবসমাজও গাদ্দাফিবিরোধী কাউন্সিলের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে বলে জানা গেছে। লিবিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী মহল ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও ক্রমশ উলি্লখিত কাউন্সিলে যোগ দিয়ে এর শক্তি বৃদ্ধি করছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে ত্রিপোলি, মিসরাতা ও সার্তসহ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং জনগোষ্ঠীও গাদ্দাফির পতন আসন্ন দেখে ক্রমশ বিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছে। সে অবস্থায় লিবিয়া ত্যাগ করা ছাড়া গাদ্দাফির সামনে এখন আর কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। ইরাক ও আফগানিস্তানের পর যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ কিংবা যুদ্ধ পরিচালনা করেনি। ইরাক কিংবা আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য ওবামা সব সময়ই তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে দায়ী করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি নিজেকে একজন যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি আরো বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে কোথাও যুক্তরাষ্ট্র কোনো আক্রমণকারীর ভূমিকা পালন করবে না।
প্রেসিডেন্ট ওবামার সেসব কথার জবাব দিয়েছেন তাঁর প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান-দলীয় নেতারা। তাঁরা ওবামাকে 'দ্বিমুখী ভূমিকার' জন্য দায়ী করে বলেছেন, লিবিয়ায় টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তা ছাড়া লিবিয়ার গাদ্দাফি বাহিনীকে ঠেকাতে ফ্রান্স যে বিমান হামলা চালিয়েছে, এর খরচ বহন করবে কে? রিপাবলিকান দলীয় নেতা জন ম্যাককেইন ও আগামীতে সম্ভাব্য রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য হচ্ছে ইউরোপের দুটি পরাশক্তি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের পাশ্চাত্য শক্তির নেতা। সুতরাং যুদ্ধবিরোধী বলে ওবামা নিজেকে যতই চিহ্নিত করতে চান না কেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেন এবং সুবিধামতো ন্যাটোর ওপর চাপাতে পারেন না। তাতে বিশ্ব রাজনীতি এবং কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকবে না। তা ছাড়া অনেকে অভিযোগ করছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার জন্য ততই জটিলতর ভূমিকা পালন করছেন। তাতে দেখা গেছে, লিবিয়ার স্বৈরশাসক গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তিনি যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্ডান কিংবা সিরিয়াসহ অন্যান্য স্বৈরশাসকের বেলায় প্রযোজ্য হচ্ছে না। ইসরায়েলের ইহুদিবাদী নেতা নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে আবাসন নির্মাণ কিংবা গাজা অবরোধ ও হামলার বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী অন্তত ৪৬ শতাংশ মানুষ মনে করে, জাতির উদ্দেশে ভাষণের অন্তত এক মাস আগে প্রেসিডেন্ট ওবামার উচিত ছিল লিবিয়ার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা এবং জাতিসংঘের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দাবি করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। ইতালি, স্পেন ও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর জ্বালানি সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেখতে গিয়ে ওবামা কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেননি। ফলে লিবিয়ার পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ গাদ্দাফি বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে।
লিবিয়ায় সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে আরব বিশ্বের অন্যান্য স্বৈরশাসক শিক্ষা না নিয়ে যদি বিভিন্ন কৌশলে তাঁদের অপশাসনকে আবার পোক্ত করার চেষ্টা করেন, তাহলে বলতে হবে তাঁরা আরো এক ভয়ংকর দুর্দিনের অপেক্ষা করছেন। সর্বক্ষেত্রে এখন প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক এবং প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। নতুবা শুধু দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধ কিংবা ক্ষমতার লড়াই নয়, নতুন আদলে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং আগ্রাসনে আরব বিশ্বের মানুষ আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। এখন আরব বিশ্বের পুনর্জাগরণের সময় এসেছে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gayiulhkhan@gmail.com
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সদর দপ্তরে পেঁৗছানোর আগেই লিবিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সামরিক স্থাপনার ওপর বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় সব কিছু অকার্যকর করে দেওয়া হয়। সে অপারেশনে ফরাসি জঙ্গিবিমান থেকে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চালানো হয় টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বেনগাজি অভিমুখে আজদাবিয়া এবং ত্রিপোলির দিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মিসরাতায় ফরাসি জঙ্গিবিমান থেকে গাদ্দাফি বাহিনী ও তাদের স্থাপনার ওপর উপর্যুপরি হামলা চালানো হয় ২৮ মার্চ অপরাহ্ন পর্যন্ত। ওই বিমান হামলার সহায়তায় গাদ্দাফিবিরোধীরা তাদের প্রতিপক্ষকে হটিয়ে ক্রমশ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। তাই এখানে প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কারা বাস্তবায়ন করেছে এবং কারা করেনি। বারবার বলা হয়েছে, গাদ্দাফি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কার্যকর করেননি। তাই নিরস্ত্র পূর্বাঞ্চলবাসীর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই বারবার হামলা চালাতে হয়েছে। কিন্তু ২৯ মার্চ যখন গাদ্দাফির জন্মস্থান বা নিজ শহর সার্তের দখল নেওয়ার জন্য তাঁর বিরোধী শক্তি অগ্রসর হচ্ছিল, তখন ফরাসি জঙ্গিবিমান সে অঞ্চলের আকাশে উড়তে দেখা যায়নি। ফলে গাদ্দাফিবিরোধীদের যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পিছু হটতে হয়েছে। লন্ডনে তখন বসেছিল জাতিসংঘ, ন্যাটো, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) মহাসচিবরাসহ সাতটি আরব রাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ সভা। মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পরিচালনায় কিভাবে মিত্রশক্তির পরিবর্তে ন্যাটো বাহিনীর ওপর লিবিয়ায় যুদ্ধবিরতি সুনিশ্চিত ও জনগণের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি হস্তান্তর করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তা ছাড়া যুদ্ধ শেষে কিভাবে মানবিক সাহায্য প্রদান ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। ইতিমধ্যে আরো দুটি বিষয় আলোচনার প্রধান দিক হিসেবে উঠে আসে_তা হচ্ছে গাদ্দাফির বিদায় ও লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতৃত্বে যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। তাদের অভিযোগ, গাদ্দাফি দেশ শাসনের সব নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব স্বীকার করেও তা বাস্তবায়ন না করে এবং নিজ দেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর হামলা চালিয়ে তিনি 'যুদ্ধাপরাধ' করেছেন। সুতরাং তাঁর শাস্তি হতে হবে, নতুবা তাঁকে সপরিবারে চিরদিনের জন্য লিবিয়া ত্যাগ করতে হবে।
ফ্রান্স ও কাতারসহ কয়েকটি রাষ্ট্র ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলে গঠিত মোস্তফা আবদেল জলিলের নেতৃত্বাধীন ৩১ সদস্যবিশিষ্ট লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল ইতিমধ্যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সরকারের একটি আট দফা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাতে রয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী লিবিয়ার জন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন ও তা লিবিয়ার জনগণের অনুমোদনের জন্য গণভোটে দেওয়া এবং সেই ভিত্তিতে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। ফ্রান্স, ব্রিটেন ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো সে সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতেও সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং ট্রেড ইউনিয়ন চালু করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফিবিরোধী শক্তি ২৭ ফেব্রুয়ারি বেনগাজিতে লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল এবং তারই ভিত্তিতে ২৩ মার্চ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছিল। এ সরকারের সামরিক শক্তি হচ্ছে গাদ্দাফির প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে আসা অফিসার ও সদস্যরা। তা ছাড়া, দেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং যুবসমাজও গাদ্দাফিবিরোধী কাউন্সিলের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে বলে জানা গেছে। লিবিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী মহল ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও ক্রমশ উলি্লখিত কাউন্সিলে যোগ দিয়ে এর শক্তি বৃদ্ধি করছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে ত্রিপোলি, মিসরাতা ও সার্তসহ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং জনগোষ্ঠীও গাদ্দাফির পতন আসন্ন দেখে ক্রমশ বিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছে। সে অবস্থায় লিবিয়া ত্যাগ করা ছাড়া গাদ্দাফির সামনে এখন আর কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। ইরাক ও আফগানিস্তানের পর যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ কিংবা যুদ্ধ পরিচালনা করেনি। ইরাক কিংবা আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য ওবামা সব সময়ই তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে দায়ী করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি নিজেকে একজন যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি আরো বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে কোথাও যুক্তরাষ্ট্র কোনো আক্রমণকারীর ভূমিকা পালন করবে না।
প্রেসিডেন্ট ওবামার সেসব কথার জবাব দিয়েছেন তাঁর প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান-দলীয় নেতারা। তাঁরা ওবামাকে 'দ্বিমুখী ভূমিকার' জন্য দায়ী করে বলেছেন, লিবিয়ায় টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তা ছাড়া লিবিয়ার গাদ্দাফি বাহিনীকে ঠেকাতে ফ্রান্স যে বিমান হামলা চালিয়েছে, এর খরচ বহন করবে কে? রিপাবলিকান দলীয় নেতা জন ম্যাককেইন ও আগামীতে সম্ভাব্য রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য হচ্ছে ইউরোপের দুটি পরাশক্তি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের পাশ্চাত্য শক্তির নেতা। সুতরাং যুদ্ধবিরোধী বলে ওবামা নিজেকে যতই চিহ্নিত করতে চান না কেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেন এবং সুবিধামতো ন্যাটোর ওপর চাপাতে পারেন না। তাতে বিশ্ব রাজনীতি এবং কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকবে না। তা ছাড়া অনেকে অভিযোগ করছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার জন্য ততই জটিলতর ভূমিকা পালন করছেন। তাতে দেখা গেছে, লিবিয়ার স্বৈরশাসক গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তিনি যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্ডান কিংবা সিরিয়াসহ অন্যান্য স্বৈরশাসকের বেলায় প্রযোজ্য হচ্ছে না। ইসরায়েলের ইহুদিবাদী নেতা নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে আবাসন নির্মাণ কিংবা গাজা অবরোধ ও হামলার বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী অন্তত ৪৬ শতাংশ মানুষ মনে করে, জাতির উদ্দেশে ভাষণের অন্তত এক মাস আগে প্রেসিডেন্ট ওবামার উচিত ছিল লিবিয়ার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা এবং জাতিসংঘের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দাবি করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। ইতালি, স্পেন ও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর জ্বালানি সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেখতে গিয়ে ওবামা কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেননি। ফলে লিবিয়ার পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ গাদ্দাফি বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে।
লিবিয়ায় সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে আরব বিশ্বের অন্যান্য স্বৈরশাসক শিক্ষা না নিয়ে যদি বিভিন্ন কৌশলে তাঁদের অপশাসনকে আবার পোক্ত করার চেষ্টা করেন, তাহলে বলতে হবে তাঁরা আরো এক ভয়ংকর দুর্দিনের অপেক্ষা করছেন। সর্বক্ষেত্রে এখন প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক এবং প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। নতুবা শুধু দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধ কিংবা ক্ষমতার লড়াই নয়, নতুন আদলে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং আগ্রাসনে আরব বিশ্বের মানুষ আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। এখন আরব বিশ্বের পুনর্জাগরণের সময় এসেছে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gayiulhkhan@gmail.com
No comments