এমন হরতাল আর নয়

আরো একটি হরতাল হয়ে গেল। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ডাকা হরতালের নামে আরো একটি কর্মহীন দিবস চলে গেল। শুধু কর্মহীনতার ভেতর দিয়ে গেলে কথা ছিল না। দেশের বিভিন্ন স্থানে এই হরতালের নামে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। হরতালের আগের দিন যশোরে একজনের মৃত্যু হয়েছে।


হরতাল সমর্থনকারীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। হামলা চালিয়েছে গাড়িতে। ফরিদপুরে গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। চট্টগ্রামে ভাঙচুর মামলায় আসামি তিন হাজার। হরতালের সময় নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে হরতালসমর্থকরা। ইসলামী ঐক্যজোট নেতা জানিয়েছেন, এটা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে সফল হরতাল।
কেন এই হরতাল? হরতালের ডাক যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁরা হরতালের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছিলেন। তাঁদের এই হরতাল নাকি ছিল সরকারের নারীনীতি, শিক্ষানীতি বাতিল করার দাবিতে। তাঁদের মতে, এই নারীনীতি ও শিক্ষানীতি কোরআনবিরোধী। একই সঙ্গে হরতালের মধ্য দিয়ে হরতাল আহ্বানকারীরা চেয়েছেন হাইকোর্টের দেওয়া ফতোয়াবিরোধী রায় বাতিল করার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে। সে রকমই বলেছেন তাঁরা, হরতালের আগে। এখানেই বিষয়টি স্পষ্ট। সোমবারের হরতাল যাঁরা ডেকেছিলেন, তাঁরা সরকারকে বাধ্য করতে চান সহিংসতা দিয়ে। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার ব্যাপারে তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই। ওই বাধ্য করার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই দেখা যাবে, তাঁরা আইন মানতে নারাজ। আদালতের রায় মানতে চান না তাঁরা। নিজেদের রাখতে চান আইনের উর্ধ্বে। আর সে কারণেই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনায় রাজি ছিলেন না। এই হরতালের পেছনে যে অন্য কারো উস্কানি থাকতে পারে_এমন সন্দেহ এখন অমূলক নয়। কারণ অনেকেরই নৈতিক সমর্থন ছিল এ হরতালে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারটা এই হরতালের ভেতর দিয়ে আরো স্পষ্ট হলো।
যে বিষয়টি নিয়ে 'ধর্ম গেল' বলে ধুয়া তোলা হয়েছে, সে বিষয়টি নারীনীতিতে নেই। নারীর সমানাধিকারের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা তার কর্মক্ষেত্র। সেটা নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত। এ বিষয়টি নিয়ে এভাবে রাজনীতি না করলেও চলত। কিন্তু অন্ধ ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে অগ্রসর সমাজব্যবস্থা কাম্য নয়। এই ধর্মব্যবসায়ীরা সবসময় চেয়েছে সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে। সমাজ অন্ধকারে থাকলে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটা সহজ হয়। মঙ্গলবারের হরতালের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও ছবি এবং টিভিতে প্রচারিত তথ্যচিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে হরতালকারীরা সরকারকে সত্যিকার অর্থেই বাধ্য করতে চেয়েছে। আইনের প্রতি তাদের সম্মান নেই। হরতালের পিকেটিংয়ে যাদের দেখা গেছে, তাদের অনেকেই যে মারপিটে পারদর্শী সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। হরতালের সময় রাস্তায় পিকেটিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে শিশুদের। এটা তো অবশ্যই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কোনো বিবেকবান মানুষ শিশুদের এভাবে রাস্তায় ঠেলে দিতে পারে না। নিজেদের আকৃতির চেয়েও বড় লাঠি হাতে রাস্তায় শিশুদের নামতে যে বাধ্য করা হয়েছিল, সেটা বলাই বাহুল্য।
আমরা জানি, হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার প্রয়োগের একটি নিয়ম আছে। অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে হরতাল হচ্ছে শেষ অস্ত্র। কিন্তু সে হরতাল হতে হবে নিয়মসিদ্ধ। হরতালের ডাক দেওয়ার অধিকার যেমন আছে, তেমনি হরতালে সাড়া না দেওয়ার অধিকারও আছে। কেউ হরতালে সাড়া না দিলে তাকে বাধ্য করা যাবে না। কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। হরতাল স্বতঃস্ফূর্ত হলে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এমন বাধ্য করার হরতাল কারো কাম্য নয়।

No comments

Powered by Blogger.