শুঁটকির বাজারে বিড়াল চৌকিদার by প্রভাষ আমিন

ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে। মেঘ থেকেই নাকি বজ্রপাত হয়। কিন্তু এ যে দেখি বাতাস ছাড়াই প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে গোটা দেশ। কোনো মেঘ ছাড়াই বজ্রের হুঙ্কারে চমকিত সবাই। তবে মেঘ যে একেবারে ছিল না, তা বলা যাবে না।


নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষবাণিজ্যের কালো মেঘ অনেকদিন ধরেই জমাট হচ্ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের আকাশে। পত্রিকা পড়ে জেনেছি, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলওয়ের ঢাকা অঞ্চলের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে রাত সাড়ে ১১টায় পিলখানা সদর দপ্তরে আটক করা হয়। তিনজনই আলাদাভাবে বলেছেন, তাঁরা রেলমন্ত্রীর জিগাতলার বাসায় যাচ্ছিলেন। মধ্যরাতে একজন জিএমের মন্ত্রীর বাসায় যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। তবে আসল গোল বেধেছে তাঁদের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যাওয়ায়।
এখানে দুটি বিষয় খুব পরিষ্কার। তাঁরা মন্ত্রীর বাসায়ই যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল ৭০ লাখ টাকা। টাকাটা বৈধ, না অবৈধ, সেই বিবেচনা পরে। সাধারণ যুক্তি বলে, ৭০ লাখ টাকা হয় ব্যাংকে থাকবে, নয় অতি জরুরি প্রয়োজন হলে বাসায় থাকবে। কিন্তু ৭০ লাখ বৈধ টাকা নিয়েও কেউ-ই মধ্যরাতে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াবে না। আর ব্যাপারটা এমনও নয় যে, তিনি ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর বাসায় যাওয়ার সময় পাননি অথবা টাকা নিয়ে ব্যাংকে যাচ্ছিলেন জমা দিতে। ঘটনার সময় এই দুটির কোনোটিকেই বাস্তব বলবে না। খটকাটা এখানেই।
পুরো ঘটনায় অনেকগুলো প্রশ্ন, অনেকগুলো অসংগতি। প্রথম প্রশ্ন, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জিএম শায়েস্তাগঞ্জে ট্রেন থামবে কি থামবে না, এই অতি সামান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মধ্যরাতে মন্ত্রীর বাসায় যেতে পারেন কি না। তাঁর দাবি যদি সত্য হয়, তাহলে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করার দায়ে এক্ষুনি তাঁকে পদচ্যুত করা উচিত। দুর্জনরা বলছে, সম্প্রতি রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৪০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে নাকি গড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। সেই টাকার ভাগ নিয়ে তূর্ণা-নিশীথা ট্রেনে ঢাকায় এসেছেন মৃধা। এসেই তিনি এপিএসকে নিয়ে ছুটছিলেন মন্ত্রীর বাসায়।
তবে আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছে পরের টানা তিন দিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এলোমেলো, অসংলগ্ন বক্তব্যে। মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার পর আমার শুধু প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়েছে, ঠাকুরঘরে কে রে? এপিএস, জিএম- দুজনই বলেছেন, তাঁরা যে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছেন, এটা মন্ত্রী জানতেন। আটক হওয়ার পর এপিএস বলেছেন, তাঁরা যে আটক হয়েছেন, এটাও মন্ত্রীকে জানিয়েছেন। মন্ত্রী যে পরদিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এ ব্যাপারে বক্তব্য দেবেন, সেটাও এপিএস রাতেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। পত্রিকাগুলোতেও লেখা হয়েছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ফোনেই আটক তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘটনার তিন দিন পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, ঘটনার পর এপিএসের সঙ্গে দেখা বা টেলিফোনেও কথা হয়নি। ঘটনা পরম্পরায় ধারণা করা যায়, মাননীয় মন্ত্রী অসত্য কথা বলেছেন। প্রথম দিন মন্ত্রী তাঁর এপিএসের পক্ষে সাফাই গাইলেন। দ্বিতীয় দিন জানালেন, তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর তৃতীয় দিন বললেন, তাঁকে কড়াভাবে তাঁর সামনে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। যে ঘটনা এবং যে ব্যক্তি মন্ত্রীর ৫৫ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিচ্ছেন, তাঁর মুখ থেকে মন্ত্রী ঘটনাটি শুনতে চাইবেন না, এটা অস্বাভাবিক। মনে হচ্ছে, ডালের মধ্যে বড়সড় কালো কিছু আছে।
সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাবি করেছেন, ড্রাইভার তাঁর এপিএস এবং রেলওয়ের জিএমকে হাইজ্যাক ও ব্ল্যাকমেইল করেছে। কী আশ্চর্য! একজন ড্রাইভারের পক্ষে তিনজন লোককে কিভাবে হাইজ্যাক করা সম্ভব? আর কেউ কাউকে অপহরণ করে বিজিবির সদর দপ্তরে নিয়ে যাবে, এতটা বোকা কোনো মানুষ হতে পারে? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সব সময়ই নির্বিকার ভঙ্গিতে মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তাঁর আচরণে মনে হয়, তিনি ছাড়া পৃথিবীর আর সবাই বোকা। আমরা বোকা; কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী, এতটা বোকা নই যে, হাইজ্যাক করে বিজিবির সদর দপ্তরে ঢুকে যাওয়ার আষাঢ়ে গল্পও বিশ্বাস করব। সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, দেশে যে কারো নিজের সম্পদ নিয়ে চলাফেরা করার অধিকার আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি মধ্যরাতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে অধিকার চর্চাকে অ্যালাউ করে। মন্ত্রী বলেছেন, এপিএস আর সরকারি কর্মকর্তারা অফিস সময়ের পর কী করেন, কোথায় যান, তা তিনি জানেন না। জানার কথাও নয়। কিন্তু মন্ত্রীর রাজনৈতিক এপিএস কোথায় কী করছেন, সেটার একটু খোঁজ নেওয়া কি তাঁর উচিত নয়। মন্ত্রী বলেছেন, টাকা তাঁর আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তা তদন্ত হবে। আর এটা এনবিআরের এখতিয়ারভুক্ত; রেল মন্ত্রণালয়ের নয়। আইনের লোক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আইনের কথাই বলেছেন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী, আইন ছাড়াও নৈতিকতা বলে একটা কথা আছে। আপনি তিন মাস হয় রেলমন্ত্রী হয়েছেন। আপনি যদি সারা জীবন রেলমন্ত্রী থাকেন, আর ফারুক যদি সারা জীবন আপনার এপিএস থাকেন, তাহলেও কি তাঁর পক্ষে বৈধভাবে ৭০ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব? এটা আইনের নয়, কমন সেন্সের ব্যাপার। মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা তাঁর বাসায় আসছিলেন না, তাঁরা এপিএসের মোহাম্মদপুরের বাসায় যাচ্ছিলেন। মন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, ঘটনার পর তাঁদের কারো সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। তাহলে তাঁরা কোথায় যাচ্ছিলেন, সেটা তিনি কিভাবে জানলেন? তিনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন, তাঁরা তাঁর বাসায় আসছিলেন না, মোহাম্মদপুরে যাচ্ছিলেন! তবে ঘটনা পরম্পরা নিশ্চিত করে, তাঁরা মন্ত্রীর বাসায়ই যাচ্ছিলেন। সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় বিজিবি কর্তৃপক্ষ আটককৃতদের থানায় হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু ১২ ঘণ্টা পর ড্রাইভার ছাড়া বাকিদের গাড়ি এবং টাকাসহ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি জীবনের বেশিরভাগ সময় বাম রাজনীতি করেছেন। আপনার কাছে আইনের চেয়েও নৈতিকতাটাই বড় হবে বলে আশা করেছিলাম। আশা করেছিলাম, আপনি সত্য, তা যত কঠিনই হোক, তার মুখোমুখি হবেন।
মন্ত্রী হতে না পারায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনেক আক্ষেপ ছিল। আওয়ামী লীগের আগের আমলে মন্ত্রী হতে পারেননি, এবারও প্রথম দফায় পারেননি। শেষ পর্যন্ত সাঁঝের বেলায় মন্ত্রী হয়েছেন। আমরা ভেবেছিলাম, এবার দাদা দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু যা দেখালেন, তা আমরা কেউ দেখতে চাইনি। মন্ত্রী হয়েই সুরঞ্জিত বলেছিলেন, রেলের কালো বিড়াল খুঁজে বের করবেন। কিন্তু সেই কালো বিড়াল যে তাঁর আস্তিনের নিচে লুকিয়ে ছিল, সেটা এখন দিবালোকের মতোই পরিষ্কার।
পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সব সময় আশপাশের সবাইকে জ্ঞান দেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। ধমক দিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ রাখতে চান। তাঁর ভাবে মনে হয়, তিনিই একমাত্র পণ্ডিত, বাকি সবাই মূর্খ। মন্ত্রী হওয়ার আগে সালমান এফ রহমান প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত বলেছিলেন, শুঁটকির বাজারে বিড়াল চৌকিদার। এখন রেলওয়ে যদি শুঁটকির বাজার হয়, তাহলে বিড়াল চৌকিদারকে চিনতে মানুষের আশা করি সমস্যা হবে না। দূর দেশের কথা বাদ, পাশের দেশ ভারতে হলেও এতক্ষণে পুরো ঘটনার দায় নিয়ে মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হতো। কিন্তু ঘটনার তিন দিন পরও মাননীয় মন্ত্রী বলছেন, অবস্থা সেদিকে নিয়ে গেলে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না। অবস্থা আর কোনদিকে যাবে, মাননীয় মন্ত্রী? রাজার গায়ে যে পোশাক নেই, সেটা কে তাঁকে বলে দেবে।
ঘটনার পরদিনই মন্ত্রী ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করেছেন। জিএমের বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন তাঁরই সমান পদমর্যাদার একজন যুগ্ম সচিব। আর এপিএসের বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন মন্ত্রীর পিএস। শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার উদাহরণ হয়ে থাকবে এই তদন্ত কমিটি। অত তদন্ত দরকার নেই। চট্টগ্রাম থেকে নিয়োগবাণিজ্যের ৭০ লাখ টাকা নিয়ে জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ঢাকায় এসে এপিএসকে নিয়ে রাত ১২টায় আপনার বাসায় যাচ্ছিলেন কেন? এই ছোট্ট সহজ প্রশ্নের সত্য উত্তরটা কি জানাবেন, মাননীয় মন্ত্রী?

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.