চারদিক-আমার দেখা বিশ্বকাপ by নিবেদিতা হাসমিন

কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। যেন হঠাৎ করেই জড়িয়ে পড়লাম সবকিছুতে। ঝোঁকের বশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার দরখাস্ত করলাম, সাক্ষাৎকারে ডাকও পেয়ে গেলাম। দুদিন পর দেখি প্রথম আলোতে আমার ছবি!
বিশ্বাস হচ্ছিল না আমিও এখন আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর একজন! আমার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রামের জহুর


আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারে। সম্পূর্ণ এক নতুন পৃথিবী অপেক্ষা করছিল আমার জন্য! চেনা মানুষ, চেনা জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একটু ভয়ও করছিল। আমি কি পারব সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে? দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করতে? নিজেকে নিজে সাহস দিলাম—আমাকে পারতেই হবে। যখন অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড হাতে পেলাম, সে যে কী অসাধারণ অনুভূতি, তা বলে বোঝাতে পারব না। স্বপ্নের খেলোয়াড়দের নিজের চোখে দেখব! টিভিতে নয়, স্বপ্নেও নয়—নিজের চোখে দেখতে পাব লাল-সবুজ বাংলাদেশের বিশ্বকাপ! আমিও নিজের অজান্তেই নিজেকে বাংলাদেশ দলের একজন মনে করতে শুরু করলাম। মিশে গেলাম নতুন একটা জগতের সঙ্গে। যাদের কোনো দিন চিনতাম না, যারা কিছুদিন আগেও ছিল একেবারে অজানা, হঠাৎ করেই তারা হয়ে গেল অনেক আপন।
বিশ্বকাপ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আরও অনেকেই কাজ করেছে। যেকোনো সমস্যায় তাদেরই পেতাম সবার আগে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সবাই একসঙ্গে কাজ করতাম। মাঠে খেলা শুরুর আগেও যে এত প্রস্তুতি নিতে হয়, সেটা আগে জানা ছিল না। আমরা টেলিভিশনে শুধু খেলাই দেখি, এর পেছনে যে কত মানুষের, কত দিনের নিরলস প্রচেষ্টা থাকে, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। মাঠের ছোট একজন কর্মচারী থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় কর্মকর্তা—কে জড়িয়ে নেই এই মহাযজ্ঞে!
আমাদের কাজের পরিবেশটা এত চমৎকার ছিল যে কাজকে কাজ মনে হতো না। সবাই একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। মিডিয়া সেন্টারে কাজ করেন দেশ-বিদেশের বড় বড় সব সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল তাঁদের বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করা। কাজের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতিকে ভিনদেশি মানুষের কাছে উপস্থাপন করার ব্যাপারও আছে। জানি না, এই গুরু দায়িত্ব পালনে কতটা সফল হতে পেরেছি। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিতে চেয়েছি। প্রতিটা দিনই ছিল আমাদের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে অতিক্রম করাই ছিল সবার লক্ষ্য।
চট্টগ্রামে বাংলাদেশ দলের দুটি ম্যাচ ছিল এবং দুটিতেই আমরা জয় ছিনিয়ে আনলাম। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে আমরাও ছিলাম, এ দুটি জয় যেন আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিল। দেখলাম গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে মানুষের আবেগাপ্লুত অনুভূতি। আনন্দের কান্না। এই দৃশ্য কখনো ভোলার নয়।
কাজের চাপে মাঝেমধ্যে মনে হতো কবে এটা শেষ হবে। কিন্তু চট্টগ্রামে যেদিন হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ হলো, সেদিন ছিল আমাদের কাজের শেষ দিন। সেদিন বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, আমার এই বন্ধুদের সঙ্গে কাল থেকে আর দেখা হবে না। যাদের সঙ্গে এই কয় দিন-রাত কাজ করলাম, যারা ছিল আমার আপনের চেয়েও আপন, তাদের আর দেখব না! ভেবেছিলাম শুধু আমারই বোধহয় এমন লাগছিল। পরে দেখলাম সবার চোখই ভেজা।
বিদায় কতটা নির্মম, কতটা বেদনার সেই সত্য আরও একবার বুঝলাম। বিশ্বকাপ আমাকে দিয়ে গেল কত না অসংখ্য সুখময় স্মৃতি! বাংলাদেশ দল কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারল না। তাতে কী হয়েছে? একদিন নিশ্চয়ই আমরা বিশ্বকাপ চাম্পিয়ন হব। আপাতত এটুকুই বলি, বিশ্বকাপের স্মৃতি কখনো ভোলার নয়।

No comments

Powered by Blogger.