একাত্তরের এই দিনে-পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক সিভিল ম্যারেজের মতো by আইয়ুব খান

একাত্তরের মার্চে যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত সমগ্র দেশ, ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে’ পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি বাঙালি, তখন এক হাজার ২০০ মাইল দূরে বসে সাবেক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কীভাবে সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক কিংবা ভুট্টোর আস্ফাালন—সেসব বিবৃত হয়েছে তাঁর রোজনামচায়।


মাত্র দুই বছর আগে গণ-অভ্যুত্থানে পদচ্যুত, প্রচণ্ড বাঙালিবিদ্বেষী এই শাসক ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদকে অবশ্যম্ভাবী’ বলে মনে করেছিলেন। ক্রেইগ ব্যাক্সটার সম্পাদিত আইয়ুব খানের রোজনামচা ১৯৬৬-১৯৭২ বইয়ের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন এম এ মোমেন

২৪ মার্চ ১৯৭১, বুধবার
জাহাজভর্তি যেসব মানুষ সেদিন চট্টগ্রাম থেকে করাচি এসে পৌঁছেছে, আমার ধারণা তাদের প্রায় সবাই দাঙ্গায় আহত, জখম নিয়ে এসেছে। তারা অনেক ভুগেছে এবং সর্বস্ব হারিয়েছে। জাহাজে ওঠার সময়ও তাদের তল্লাশি করা হয়েছে, যাতে মূল্যবান কিছু সঙ্গে না নিয়ে যেতে পারে।
সরকার বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই খবরটি চেপে গেছে, কারণ জানাজানি হলে পশ্চিম পাকিস্তানেও প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হয়ে যেত। এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিরা স্নায়বিক চাপে ভুগছে। তারা আকাশপথে পালানোর চেষ্টা করছে। ইসলামাবাদে বসবাসকারী বাঙালি অজ্ঞাতনামা পত্রে ও টেলিফোনে জীবনের হুমকি পাচ্ছে, ফলে এমনিতেই তারা সন্ত্রস্ত। বাড়ির বাইরে যাওয়াটা তারা এড়িয়ে চলছে।
আর একটি খবর হচ্ছে, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ছোট ঘাঁটিটি নকশালবাদী ধরনের মানুষের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে—৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ ঘাঁটি আক্রমণ করলে সেনাবাহিনীর একটি দলের তাৎক্ষণিক উপস্থিতি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়, নতুবা ঘাঁটিটি লন্ডভন্ড হয়ে যেত এবং এখানকার লোকজন নিহত হতো। তার পরও কজনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রমণকারী জনতা প্রতিহত করতে গিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালালে কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ারই কথা—কারণ দৃঢ়ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে তাদের দেওয়া হয়নি। সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক মূলত স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের অপ্রপচারের কারণে খুবই উত্তেজনাপূর্ণ—পত্রিকাগুলো অবিরাম সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বানোয়াট কাহিনি ছাপছে এবং বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ভুট্টো এখনো ঢাকায় রয়েই গেছেন, কারণ তিনি যা আশা করেছিলেন, তা এখনো পাননি। তিনি এবং উপদেষ্টারা প্রেসিডেন্টের সহযোগীদের সঙ্গে মোলাকাত করেছেন। মুজিবুর রহমানের উপদেষ্টারাও তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন। ভুট্টো চাইছেন, মুজিবুর রহমান ও তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। তাঁদের আলাপ এ পর্যন্ত যা হয়েছে, পরোক্ষভাবে, প্রেসিডেন্টের সহযোগীদের মাধ্যমে। আমার মনে হয়, ভুট্টো এখনো রয়ে গেছেন মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করতে—যাতে তিনি নিজের জন্য একটা ভালো কিছু পান।
দেশের দুটি অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই বিষিয়ে উঠেছে যে সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ নিশ্চিত করতে পারবে না—ঢাকা থেকেই হোক কি ইসলামাবাদ থেকে, পরিষদ নির্বিবাদে চলবে। অধিকন্তু, কোনো বাঙালির মুরোদ আছে ইসলামাবাদ থেকে চালাবে, কিংবা কোনো পশ্চিম পাকিস্তানি ঢাকা থেকে? এই পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের সমন্বয়ে একটি যৌথ সরকার গঠনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত এবং তা মূলত দুজনের ভিন্নমুখীনতা এবং সম্পর্কের বিষাক্ততার কারণে। ইয়াহিয়ার সমঝোতা প্রচেষ্টা যত প্রশংসাযোগ্যই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবিকই নিষ্ফল কসরতে পরিণত হয়ে যেতে পারে।
এটা খুবই বেদনার যে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে ঢাকায় মাত্র তিনটি জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা ওঠানো হয়েছে। এই তিনটি জায়গা হচ্ছে: প্রেসিডেন্টস হাউস, গভর্নমেন্ট হাউস এবং ক্যান্টনমেন্ট আর সর্বত্র উঠেছে বাংলাদেশের পতাকা—দিনটি উদ্যাপিত হয়েছে ১৯৪০ সালের প্রস্তাব দিবস বা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। কোথাও কোথাও বলপূর্বক পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়েছে। এটা তো স্পষ্ট নিদর্শন যে বাঙালিরা একটি পৃথক রাষ্ট্র চালাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর আমরা একই রাষ্ট্রের ভেতর তাদের চালানোর স্বপ্ন দেখছি। সমস্যা হচ্ছে, কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ মনে করছেন পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী, বাঙালিরা তা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছে কিন্তু এই সত্যটি জনসমক্ষে স্বীকার করার মতো সাহস পশ্চিম পাকিস্তানিদের কারও নেই। এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে, পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং জনগণের মনোভাবের দিকে লক্ষ রেখে জীবনের বাস্তবতাকে গ্রহণ করে নেওয়া। দলিল-দস্তাবেজ, অতীত ইতিহাস এবং প্রস্তাবসমূহ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া সময় নষ্ট করারই নামমাত্র। এসবে আর বরফ গলবে না। এটাই হচ্ছে দুঃখজনক কিন্তু সাদামাটা সত্য।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের বিশাল সমস্যায় ডুবে ছিল এই দেশ। যত তাড়াতাড়ি, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষকে, রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল থেকে রক্ষা করে এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। কৃত্রিম বিশ্বাস সৃষ্টি করিয়ে ঝুলিয়ে রাখার দিন শেষ হয়ে গেছে। মানুষ বুঝতে পারে না যে কৃত্রিম অংশীদারি কখনো তৃপ্তিকর ও টেকসই হয় না। যদি দেশের দুটি অংশ একই ভূখণ্ডে অবস্থিত হতো এখনকার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাটি লাঘব করা, হয়তো প্রতিহতও করা যেত। কিন্তু যেহেতু হাজার মাইল দূরে অবস্থিত দুটি অংশের মাঝখানে শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের অবস্থান, বল প্রয়োগ তাই কোনো সমাধান নয়। কাজেই জনগণের ইচ্ছেকে অনুসরণ করা ছাড়া কিংবা তাঁরা যাঁদের প্রতিনিধি মনে করেন, তাঁদের ইচ্ছেমতো ঘটতে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এটা অনেকটা সিভিল ম্যারেজের মতো—যেকোনো পক্ষই নোটিশ দিয়ে ভেঙে দিতে পারে, বিয়ের সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে পারে।
আমাদের রেডিও কিছু না বললেও বিবিসি রেডিও জানিয়েছে, সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে চট্টগ্রাম, রংপুর এবং আরও দু-একটি জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছে এবং শতাধিক আহত। চট্টগ্রামে সংঘর্ষের কারণ জনতা চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ থেকে গোলাবারুদ নামাতে বাধা দিয়েছে। মুজিবুর রহমান শনিবার পূর্ণ হরতালের আহ্বান জানিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, এখন থেকে আরও সমস্যার সৃষ্টি হবে। তিনি যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছিলেন, যা সার্বভৌমত্বেরই অনুরূপ, আরও উচ্চকিত হয়ে উঠবে। চরমপন্থীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

No comments

Powered by Blogger.