ভিন্নমত-সর্বত্রই ভেজাল, কোথায় পাব শুদ্ধ খাবার! by আবু আহমেদ
আসফাক সাহেব এখন আর পাকা পেঁপে খান না, তাঁর কথা হলো পাকা পেঁপেতে ওষুধ দেওয়া। তবে তিনি পেঁপের গুণাগুণ সম্বন্ধে সজাগ। তিনি কাঁচা পেঁপে খান। তাঁর কথা হলো কাঁচা পেঁপে অন্তত ওষুধমুক্ত। আসফাক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম আপেল এবং আঙুর খান কি না। তিনি বললেন, ওই দুটো ফল তিনি অনেক আগেই ত্যাগ করছেন।
আপেল ও আঙুরকে মুখের কাছে নিলেই তিনি ওষুধের গন্ধ পান। তিনি বললেন দেখুন, আপেল-আঙুর এক সপ্তাহ রেখে দিলেও পচে না কেন? ওষুধ দেওয়া বলেই পচে না। ওষুধ দেওয়া ফল আসফাক সাহেবের কাছে বিষ। তাই তাঁর কথা হলো এসব ফল বিনা পয়সাও খাওয়া উচিত নয়। আমি বললাম, তাহলে কোন ফল খাব। সবাই যে ফল আর সবজি খেতে বলে। তিনি বললেন, আসলে বাঙাল যেখানে হাত দিতে সক্ষম হয়েছে, সেগুলোকেই নষ্ট করে ফেলেছে। কচি নারিকেল সেটাকে ডাব বলা হয়, যা খাওয়া যেতে পারে। সদ্য গাছ থেকে নামানো কলা-আম- এসব একটু কাঁচা হলেও কয়েক দিন রেখে খাওয়া যেতে পারে। সিজনাল ফল যেমন তরমুজ-ভাঙ্গি- এ সব ক্ষেত থেকে উঠানোর পর ওষুধ ছিটানোর আগেই যদি কেনা যায়, তাহলে ভালো হবে। আমি বললাম, ক্ষেত থেকে আনার সঙ্গে সঙ্গে ফল কেনা তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে তারা কী করবে? তাঁর উত্তর হলো, তারা তো ভেজাল খাচ্ছে, ভেজালে অভ্যস্তও হচ্ছে এবং কখনো কখনো আসক্তও হচ্ছে। ভেজাল খাদ্যে যে কত ভয়াবহ খারাপ হতে পারে তার তো প্রতিফলন আমাদের দেশের লোকজনের সাধারণ স্বাস্থ্য দেখলেই বুঝতে পারেন। এই জাতি স্বাস্থ্য রক্ষায় ও স্বাস্থ্যসেবার নামে হাসপাতাল, ডাক্তার ওষুধের পেছনে যত অর্থ ব্যয় করছে, তার যদি ৯০ শতাংশ অর্থও শুধু খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ব্যবহার করত, তাহলে জাতির লোকদের স্বাস্থ্য অনেক উন্নত থাকত। তাঁর কথা হলো, সারা বাংলাদেশই রোগী উৎপাদনের কারখানা। হাসপাতাল, ডাক্তার ও ওষুধ কম্পানি- এরাও লেগে গেছে লোকজনকে রোগী বানানোর কাজে। তবে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রোগীদের ৮০ শতাংশই হচ্ছে শুধু বছরের পর বছর ভেজাল খাদ্য খাওয়ার কারণে। কারো হার্টের অসুখ, কারো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, কারো লিভার অকেজো- এ সবই অতি দ্রুত এবং এত ব্যাপকহারে ঘটছে শুধু ভেজাল খাওয়ার কারণে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় লোকে টাকা দিয়ে খাদ্য খাচ্ছে। কিন্তু এসব খাদ্যকে আপনি খাদ্য বলবেন? শাক-সবজি এবং মাছ একদিন এই দেশে পরিশুদ্ধ ছিল। এখন মাছে বিষ মেশানো হচ্ছে। সস্তায় সেই মাছ লোকজনের কাছে অতি খোলাখুলিভাবে বিক্রি হচ্ছে। তাই আসফাক সাহেব তিনি মাছ-মাংস কিনতে মাছি বসলে মনে করেন ওগুলোতে ওষুধ মেশানো হয়নি। শেষ পর্যন্ত আসফাক সাহেব ভেজাল আর অভেজালের মধ্যে পার্থক্য করতে মাছির সাহায্য নিলেন! তিনি বলতে থাকলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গোশত দোকানে টাঙানো আছে। অথচ মাছি বসছে না। তাহলে ওই গোশত ওষুধবিহীন, সেটা আপনি কিভাবে বুঝলেন! আসফাক সাহেবের বয়স ৫৫ বা এর কমবেশি হবে। সরকারি চাকরি করেন। তবে কাজের ফাঁকে যতটা সময় পান ভালো ফল, ভালো সবজি এবং ভালো মাছ কিনতে সচেষ্ট থাকেন। তিনি আরো বললেন, গত এক দশকে একগ্লাস সফট ড্রিংক বা কথিত কোমলপানীয় পান করেননি। তাঁর আফসোস হলো, এ দেশে এত সেমিনার এবং ডায়ালক হয় কিন্তু খাদ্যে ভেজাল এবং কোমলপানীয়র খারাপ দিক নিয়ে কোনো সেমিনার-ডায়ালক হয় না। অথচ এগুলোর সঙ্গে জনস্বার্থ জড়িত। আসফাক সাহেবকে বললাম, ভেজালবিরোধী এবং কোমলপানীয়র খারাপ দিকগুলো নিয়ে ব্যাপক প্রচার হয় না, এই জন্যই যে ওই সবের পেছনে কারো বাণিজ্যিক স্বার্থ নেই। আজকাল বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো সেমিনারও করে না, নিজ পকেটের অর্থ ব্যয় করে ওই সব কেউ করতেও চায় না। এসব ক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ভেজাল রোধের জন্য তাদের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এফডিএ আছে। আপনার দেশে ওই ধরনের কোনো সংস্থা নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় অন্য কিছু খারাপ থাকলেও থাকতে পারে, তবে আপনি ফুড বা খাদ্য খাঁটি পাবেন। আমাদের দেশে চালেও ভেজাল দেওয়া হয়। কিছু লোক দেখবেন লাল চালকে ঢেঁকি ছাঁটা চাল বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। আসলে ওই সব চালকে কেমিক্যাল মিশিয়ে লাল করা হয়েছে। আপনি যদি দোকানদারকে অন্তরঙ্গতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, সে বলবে, স্যার ঢেঁকি কি কোথায়ও আছে। লোকে খাঁটি চাল খেতে চেয়ে লাল চাল চায়। তাই আমরা লাল চাল রেখেছি! আসলে বাংলাদেশে এখন নৈতিকতার চরম দুর্দিন যাচ্ছে। জানি না, কোনো সমাজ সম্পূর্ণভাবে যদি নীতিনৈতিকতা হারিয়ে ফেলে, তাহলে ওই সমাজ চলে কি না। ধনী লোকেরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রাইভেট স্কুল বেছে নিচ্ছেন, চিকিৎসার জন্য তাঁরা যান বিদেশে। কিন্তু যে কয়টা দিন বাংলাদেশে থাকেন তখন কোন ধরনের খাদ্য খান জানি না। একদিন হয়তো আসবে, তাঁদের জন্য বিশুদ্ধ খাদ্যের আলাদা বাজার হয়ে গেছে। তাঁরা হবেন গ্লোবাল সিটিজেন। খাদ্যসামগ্রীর উৎস হবে গ্লোবাল। তবে সমস্যায় থাকবে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষ। তারা বিশুদ্ধ খাবার খাওয়ার জন্য কোথাও যেতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকার যদি জনস্বার্থে কিছু করতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি তদারকি সংস্থা- এফডিএ গঠন করতে পারে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments