জাদুই চেরাগ by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া

রাজধানীতে যেদিন মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝাপটা মেরে গেল, সেদিনই ঘটে গেল আজব ঘটনা। কবিরউদ্দিন তখন ফুটপাতে দমকা বাতাসের তোড়ে পাক খেতে থাকে ধুলোর ভেতর। খুক খুক করে কাশতে কাশতে শক্ত কিছু একটার সঙ্গে হোঁচট খেল সে। জুতোর সঙ্গে লেগে ঠং করে একটা আওয়াজ।


তারপর ধাতব কিছু একটা গড়িয়ে গেল ফুটপাতের ওপর। বিজলির আলোতে দেখে লম্বাটে কী একটা জিনিস। জিনিসটা কুড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে ভরল সে। তারপর আবার ছুটতে লাগল কুঁজো হয়ে।
কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরল কবির। বিদ্যুৎ নেই। অবশ্য তার বাসা এমনিতেই কয়েক দিন ধরে অন্ধকার। বউ রাগ করে চলে গেছে ভাইয়ের বাড়ি।
একটা সওদাগরি অফিসে হিসাব বিভাগে আছে কবির। শেয়ারবাজারে বউয়ের জমানো টাকা খাটিয়ে এখন বিপদে পড়েছে। এর জের ধরে বউয়ের সঙ্গে প্রায়ই বেধে যায় গোল।
মোম জ্বেলে রান্নাঘরে ঢোকে কবির। বৃষ্টিতে ভিজে গাটা কেমন শিরশির করছে। এক কাপ চা না খেলেই নয়। কিন্তু চুলোর গ্যাসে দম নেই। চায়ের পানি ফুটতে এক ঘণ্টা লেগে যাবে।
মন খারাপ করে ব্যাগ খোলে কবির। বের করে ধাতব জিনিসটা। মোমের আলোয় ধরে দেখে সেকেলে একটা চেরাগ। পিতলের হতে পারে। অ্যান্টিক হিসেবে দামটা কম হবে না। কে ফেলে গেছে কে জানে?
রাজ্যের ময়লা জমে আছে চেরাগে। একটা নেকড়া ভিজিয়ে জোরে ঘষা লাগায় কবির। কিন্তু ময়লা যেন উঠতেই চায় না। কবিরও ছাড়ার পাত্র নয়। ঘষতেই থাকে।
আচানক ঘটে যায় আজব ঘটনা। বুনো জন্তুর মতো একটা গর্জন শোনা যায়। আঁতকে উঠে চেরাগটা মেঝেতে রেখে হাত খানেক তফাতে দাঁড়ায় কবির। চেরাগের মুখ থেকে পাক খেয়ে বেরোচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। নিমেষে কুণ্ডলী হয়ে গেল বিকট এক কায়া। তার ভীষণ চেহারা দেখে দাঁত কপাটি কবিরের।
চোখেমুখে পানির ঝাপটায় জ্ঞান ফিরে পেল কবির। সেই বিকট কায়া ঘর কাঁপিয়ে কাশছে। কাশির দমক সামলে সে বলল, ‘ভয় পাবেন না, মালিক। আমি এই প্রদীপের জিন। প্রদীপ যার, আমি তার। হুকুম করুন কী করতে হবে।’
জিন-ভূত বিশ্বাস করে কবির। রেডিওর ভূতের অনুষ্ঠানের নিয়মিত শ্রোতা সে। ফাঁক পেলেই সিডি এনে হরর ছবি দেখে। কাজেই প্রদীপের জিনের কথা বিশ্বাস করল সে। বিকট কায়ার বিনয়ী ভাব দেখে সাহসও ফিরে পেল।
জিন বহু কষ্টে দম নিয়ে বলল, ‘হুকুম যা করার তাড়াতাড়ি করেন, মালিক। আলাদিনের আমলে টাটকা বাতাসে দম নিতাম। ঢাকার বাতাস বড় দূষিত। এখানে দম নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
জিনকে ডালপুরি আর চা আনার হুকুম দিল কবির। চোখের পলকে গরমাগরম ডালপুরি আর ভাপ ওঠা চা হাজির। পটাপট চারটা ডালপুরি মেরে দিল কবির। এর পরও কয়েকটা পড়ে রইল।
কিন্তু জিন বেশ কুণ্ঠিত। কারণ জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ‘আলাদিনের আমলে অনেক বড় বড় অর্ডার পাইতাম, মালিক। গরিব মেরে বড়লোক হওয়া মানুষের ধনরত্ন এনে দিতাম। কাজেই অনুশোচনা হতো না। আর এখন যে ডালপুরি-চা আনলাম, তা মোড়ের কলিম মিয়ার। গরিব বেচারার পেটে লাথি মারা হয়ে গেল, মালিক।’
জিনের কথায় নাশতার মজা পানসে হয়ে গেল। গোলাম হয়ে এত বড় বেয়াদবি! কবির চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ওই বেটা, গরিবের পেটে তোরে লাথি মারতে বলছে কে? এই পুরি খাওয়াইয়া আমারে তো গুনাহগার বানাইলি। তোরও এর ভাগীদার হইতে হইব। বাকি পুরি তুই খা।’
জিন বেচারা পড়ে গেল বেকায়দায়। আজ পর্যন্ত কোনো মনিব তাকে এমন আজব সাজা দেননি। সে বেজার মুখে পুরি খেতে খেতে বিদায় নিল।
কিন্তু এ কী করল কবির! জিনকে দিয়ে তো পাঁচতারকা হোটেলের দামি খাবারই আনাতে পারত। পুরি খেয়ে পেট ফুলে গেছে। শুরু হয়েছে ভুটুর ভুটুর। এখন জিনকে ডেকে আবার খাবার আনানোর কোনো মানে হয় না।
তবে কবিরকে এখন আর পায় কে? কোটিপতি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার আগে রাগ করে চলে যাওয়া বউকে একহাত দেখাতে হবে।
মোবাইল ফোনে বউকে ফিরে আসতে অনুনয় করল কবির। বউ ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল, ‘ঝাঁটা মারি ওই সংসারে!’
কবির হে-হে করে হেসে বলল, ‘এখন তো ঝাঁটা মারতাছ, পরে কিন্তু পস্তাইবা। এই কবির আর সেই কবির নাই। বদলাইয়া গেছে।’
ওপাশে বউ রুশনি বেগমের থতমত খেয়ে যাওয়া টের পেল কবির। সুর নরম হয়ে গেল তার। বলল, ‘কী ব্যাপার, শিয়ারবাজার ঘুরছেনি?’
কবির বলল, ‘শিয়ারবাজার না ঘুরলেও ভাইগ্যের চাকা ঘুরছে। আইলে টের পাইবা।’
‘ঠিক আছে, কাইল সকালে আইতাছি।’
পরদিন সকাল। সিটি করপোরেশনের বিভাজন অনুযায়ী কবির এখন ঢাকার উত্তরে অবস্থান করছে। বউ দক্ষিণে। কাজেই তার জন্য একটা ট্যাক্সি ক্যাব হলে ভালো হয়। জিনকে দিয়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। চেরাগে জোরসে ঘষা লাগাল কবির। কিন্তু জিন এল না। একবার, দুবার, তিনবার...বারবার ঘষা দিল সে। জিনের খবর নেই।
কপালে ঘাম জমতে লাগল কবিরের। ঘণ্টা দুয়েক পর যানজট ঠেলে পেরেসান হয়ে ফিরল রুশনি। এসেই বাড়ি মাথায় তুলল।
‘ওমা, ঘরবাড়ি যে একেবারে ডাস্টবিন বানাইয়া রাখছ! সিংকে এত্তো থালাবাসন জমাইলা কেমনে? এইগুলা ঠেলার জন্যই নিয়া আসছ—না?’
কবির আমতা আমতা করে বলে, ‘না না, তা কেন? সত্যিই চমক আছে।’
‘থাকলে দেখাও।’
‘একটু ওয়েট করো। এত অধৈর্য হইলে চলে!’
‘ঠিক আছে, আমি কাপড় পাল্টাইয়া আইতাছি। এর মধ্যে চমক না দেখাইতে পারলে খবর আছে!’
রুশনি চোখের আড়াল হতেই শেষ চেষ্টা হিসেবে মরিয়া হয়ে চেরাগে ঘষা দিল কবির। চেরাগের মুখ থেকে ফিকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। হাজির হলো জিন। কিন্তু এ কী চেহারা তার! বিশাল ধড় শুকিয়ে এইটুকুন। কবিরের চেয়েও ইঞ্চি তিনেক খাটো। সেই ভয়াল চেহারা নেই। হাবাগোবা ভাব।
কবিরের খুব মায়া হলো। জানতে চাইল, ‘এই দুর্গতি কেন তোমার?’
জিন মিনমিনে গলায় বলল, ‘ওই যে ভাজা তেলে ভাজা পুরি খাওয়াইলেন, ওতে এই পরিণতি। একদম ডাইরেক্ট হইয়া গেছিল, মালিক। কঠিন ডাইরেক্ট!’
তখন জিন হাজির না হওয়ার কারণটা টের পেল কবির। আহা, বেচারার শরীরের রসপানি সব বেরিয়ে গেছে। ‘হুকুম করেন মালিক, কী করতে হবে।’
কবির বলল, ‘তুমি এই দুর্বল শরীর নিয়া আর কী করবা। যাও, ওই থালাবাসন মাজো।’
রুশনি ফিরে এসে খুশিতে আটখানা। মিছেই স্বামীর ওপর রাগ ঝেড়েছে। সাচ্চা বউ-অন্তঃপ্রাণ স্বামী না হলে এই দুর্মূল্যের বাজারে এমন কাজের লোক জোগাড় করে?
বউয়ের বাহবা পেয়ে জাদুই চেরাগ পাওয়ার কথা ফাঁস করল না কবির। এতে বরং হিতে বিপরীত হলো। সেদিন কবির বাসায় নেই। পুরোনো জিনিস খুঁজতে আসা এক লোকের কাছে চেরাগটা মাত্র ৫০ টাকায় বেচে দিল রুশনি।

No comments

Powered by Blogger.