ধর্ম-দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় মহানবী (সা.) by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করার আজীবন সংগ্রামে অনেক মহৎপ্রাণ ব্যক্তি তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে স্বতন্ত্র আবাসভূমি নির্মাণের প্রয়াস পান। ইসলামের ইতিহাসে এমনি একজন মহামানব ছিলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), যিনি আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে মদিনা নগরে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
নবী করিম (সা.) শত্রুদের অত্যাচারে যখন প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যাওয়ার সময় তিনি বারবার মাতৃভূমি মক্কা ও কাবা শরিফের দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি! আমার গোত্রীয় লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না!’
মহানবী (সা.) একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য অনেক ত্যাগ-সাধনা করেছেন। এমনকি সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে হিজরত করে মদিনাকে একটি স্বাধীন ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠন করেন। এ স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি তাঁর দাওয়াতি মিশনকে আরও তীব্র গতিতে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে মক্কার বিজয় সূচিত হয়। তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করার নিমিত্তে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। একটি স্বাধীন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এ সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।
এ ছাড়া জনগণের চিন্তা ও মতামত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করে মহানবী (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র মদিনায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সবার ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল। ফলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয়। মদিনা রাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো সময়ের, যেকোনো কালের জন্য শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবতা ও উদারতার প্রতীক হয়ে থাকবে। নবী করিম (সা.) মদিনার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করেছেন, এমনকি অনেক আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করাকে নবীজি উৎসাহিত করেছেন। তিনি স্বাধীনতার প্রতি শুধু উদ্বুদ্ধই করেননি, সার্বভৌমত্ব অর্জন ও রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘শহীদের রুহগুলো চির শান্তির স্থান জান্নাতে ভ্রমণ করতে থাকে এবং সেখানকার ফল ও নিয়ামতগুলো আহার করে থাকে।’
অবশেষে জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও আক্রমণ প্রতিহত করে অষ্টম হিজরি মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মহানবী (সা.) জালিম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকতার পঞ্জিকা থেকে মক্কাকে স্বাধীন করলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারা গৌরবের বিষয়। নবী করিম (সা.) এ শিক্ষাই মানব জাতিকে দিয়ে গেছেন।
তিনি যখন বিজয়ীবেশে জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর স্বগোত্রীয় লোকেরা অপরাধী হিসেবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। এমনি মুহূর্তে স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার অনুপম আদর্শ স্থাপন করেন।
স্বাধীন দেশে বহিঃশত্রুর আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য মহানবী (সা.) সুসংগঠিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ঈমানের বলে বলীয়ান এমন একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন, যারা স্বদেশের মাটির জন্য, মানুষের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সদা প্রস্তুত থাকত। সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত নৌবাহিনীর মর্যাদা প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় এক রাত সমুদ্রতীরে যাপন করা ঘরে অবস্থান করে এক হাজার রাকাত নফল নামাজ আদায়ের চেয়ে উত্তম।’
হাদিস শরিফে আরও বর্ণিত আছে, ‘যারা দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে তাদের জন্য জান্নাত।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, দুই প্রকারের সেই চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।
প্রথমত, সেই চক্ষু, যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে; দ্বিতীয়ত, যে চক্ষু আল্লাহর পথে (সীমান্ত) পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তার আমল বৃদ্ধি পেতে পারে না। তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে ব্যক্তি কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তার আমল কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং কবরের প্রশ্নোত্তর থেকেও সে বেঁচে থাকবে।’ (তিরমিযি ও আবু দাউদ)
নবী করিম (সা.)-এর সুমহান আদর্শকে অনুসরণ করে বীর বাঙালিরাও বহু রক্ত, জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে শত শত বছরের অধীনতা আর গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার লাল সূর্য। যাঁদের মহান ত্যাগ ও প্রাণদানের বিনিময়ে আমরা আমাদের মহান স্বাধীনতা লাভ করেছি, যাঁদের অবদানে এ জাতি গৌরব অনুভব করে আমরা তাঁদের ভুলব না। যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আমরা সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং দেশের জাতীয় দিবসগুলোতে তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষভাবে দোয়া করি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
মহানবী (সা.) একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য অনেক ত্যাগ-সাধনা করেছেন। এমনকি সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে হিজরত করে মদিনাকে একটি স্বাধীন ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠন করেন। এ স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি তাঁর দাওয়াতি মিশনকে আরও তীব্র গতিতে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে মক্কার বিজয় সূচিত হয়। তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করার নিমিত্তে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। একটি স্বাধীন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এ সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।
এ ছাড়া জনগণের চিন্তা ও মতামত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করে মহানবী (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র মদিনায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সবার ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল। ফলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয়। মদিনা রাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো সময়ের, যেকোনো কালের জন্য শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবতা ও উদারতার প্রতীক হয়ে থাকবে। নবী করিম (সা.) মদিনার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করেছেন, এমনকি অনেক আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করাকে নবীজি উৎসাহিত করেছেন। তিনি স্বাধীনতার প্রতি শুধু উদ্বুদ্ধই করেননি, সার্বভৌমত্ব অর্জন ও রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘শহীদের রুহগুলো চির শান্তির স্থান জান্নাতে ভ্রমণ করতে থাকে এবং সেখানকার ফল ও নিয়ামতগুলো আহার করে থাকে।’
অবশেষে জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও আক্রমণ প্রতিহত করে অষ্টম হিজরি মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মহানবী (সা.) জালিম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকতার পঞ্জিকা থেকে মক্কাকে স্বাধীন করলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারা গৌরবের বিষয়। নবী করিম (সা.) এ শিক্ষাই মানব জাতিকে দিয়ে গেছেন।
তিনি যখন বিজয়ীবেশে জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর স্বগোত্রীয় লোকেরা অপরাধী হিসেবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। এমনি মুহূর্তে স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার অনুপম আদর্শ স্থাপন করেন।
স্বাধীন দেশে বহিঃশত্রুর আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য মহানবী (সা.) সুসংগঠিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ঈমানের বলে বলীয়ান এমন একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন, যারা স্বদেশের মাটির জন্য, মানুষের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সদা প্রস্তুত থাকত। সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত নৌবাহিনীর মর্যাদা প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় এক রাত সমুদ্রতীরে যাপন করা ঘরে অবস্থান করে এক হাজার রাকাত নফল নামাজ আদায়ের চেয়ে উত্তম।’
হাদিস শরিফে আরও বর্ণিত আছে, ‘যারা দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে তাদের জন্য জান্নাত।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, দুই প্রকারের সেই চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।
প্রথমত, সেই চক্ষু, যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে; দ্বিতীয়ত, যে চক্ষু আল্লাহর পথে (সীমান্ত) পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তার আমল বৃদ্ধি পেতে পারে না। তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে ব্যক্তি কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তার আমল কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং কবরের প্রশ্নোত্তর থেকেও সে বেঁচে থাকবে।’ (তিরমিযি ও আবু দাউদ)
নবী করিম (সা.)-এর সুমহান আদর্শকে অনুসরণ করে বীর বাঙালিরাও বহু রক্ত, জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে শত শত বছরের অধীনতা আর গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার লাল সূর্য। যাঁদের মহান ত্যাগ ও প্রাণদানের বিনিময়ে আমরা আমাদের মহান স্বাধীনতা লাভ করেছি, যাঁদের অবদানে এ জাতি গৌরব অনুভব করে আমরা তাঁদের ভুলব না। যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আমরা সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং দেশের জাতীয় দিবসগুলোতে তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষভাবে দোয়া করি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments