অন্যদের শাস্তি, নিজের বেলায় চুপ সুরঞ্জিত by পার্থ সারথি দাস
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার গত সোমবার রাতে বিজিবি সদর দপ্তরে টাকার বস্তাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় তুমুল বিতর্কের মুখে রেলমন্ত্রী অবশেষে অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। গত বুধবার এপিএস ফারুককে সাময়িক বরখাস্ত করার পর গতকাল রবিবার তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছেন
রেলমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি ওই দিন টাকার বস্তাবাহী ফারুকের গাড়িতে থাকা পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করেছেন। পাশাপাশি রেলে নিয়োগ আপাতত স্থগিত করেছেন। কিন্তু অন্যদের এই শাস্তি দেওয়ার কথা জানানোর পর সাংবাদিকরা যখন তাঁর নিজের পদত্যাগের কথা জানতে চান, তখন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রশ্নটি এড়িয়ে যান এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
এদিকে রেলমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো সুরঞ্জিতের বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া নিজ দলের একাধিক নেতাও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা জানতে পেরেছেন, গতকাল সকাল ১১টার দিকে সুরঞ্জিতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
গতকাল অবশ্য বেশির ভাগ সময় মন্ত্রীকে রেল ভবনে উদ্বিগ্ন সময় কাটাতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী তলব করেছেন কি না কিংবা তিনি কী বলেছেন, এসব বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে রেলমন্ত্রীর কাছে ফোন দেওয়া হয় কালের কণ্ঠ থেকে। তিনি প্রথমে ফোনটি রেখে দেন। এর পর আবার ফোন করা হলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে আপনিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে জেনে আসুন।'
অবস্থা সে রকম হলে পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার- গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এমন বক্তব্য দিলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরের দিন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুর পাল্টে ফেলে বলেন, 'পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।' গতকাল রেল ভবনে সাংবাদিকরা আবারও তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বৃহস্পতিবার যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটাই সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দেন। এরপর দ্রুত মিলনায়তন থেকে চলে যান।
'তাদের কথায়ও যাব না' : গতকাল রেল ভবনে অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুই রেল কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড এবং এপিএসকে চাকরিচ্যুত করার পর নিজের পদত্যাগের বিষয়ে বিরোধী দলের আহ্বানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'বিরোধী দল আমাকে পদ দেয়নি, তাদের কথায়ও এ পদ থেকে যাব না।' রেল ভবনে মন্ত্রী এই কথা বলার কয়েক ঘণ্টা আগে বিএনপির সংসদীয় দল এক সংবাদ সম্মেলনে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে।
বিরোধী দলের কথায় না হলে প্রধানমন্ত্রীর কথায় পদত্যাগ করবেন কি না- এ প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারে, সেখান থেকেই আসবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় রেল ভবনে নিজের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, 'অবস্থা বাধ্য করলে আমার পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার। কারণ রাজনীতিবিদদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় নয়।' তিনি আরো বলেছিলেন, 'আমার মূল পরিচয়, আমি এমপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে লড়েছি। সুবিধা নিইনি।'
তবে পরের দিন শুক্রবার বিবিসি বাংলায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি পদত্যাগের বিষয় সরাসরি নাকচ করে দেন। ওই সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী বলেন, যেহেতু অভিযোগ উঠেছে তাঁর একজন সহকারী এবং রেলওয়ের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, তাই এখানে তাঁর নিজের পদত্যাগের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
মন্ত্রিসভার একজন দায়িত্বশীল সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের টাকার বস্তাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যও করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বুধবার তুরস্ক যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনাটি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এমনকি রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করুক- এমন কথাও উচ্চারণ করেন তিনি।
তিন অভিযুক্তের শাস্তি : অবশেষে চাপে পড়ে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি জানিয়েছেন, তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হবে। তিনি আরো জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল নিরাপত্তা বাহিনীর নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সাসপেন্ড এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওঠা অভিযোগও জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করা হবে।
গতকাল দুপুরে রেল ভবনে আড়াই ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিংহ, রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের, মন্ত্রীর পিএস আখতার-উজ-জামানও ছিলেন। বৈঠকের পর দুপুর আড়াইটার দিকে রেলমন্ত্রী রেল ভবন মিলনায়তনে সাংবাদিকদের ওই সব সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে পদত্যাগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'এ নিয়ে তো আমি আগেই কথা বলেছি।'
রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পৃক্ত করে তাতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
টাকা আটক ঘটনার পরের দিন এপিএসের পক্ষ নিলেও এখন কেন তাঁকে অব্যাহতি দিলেন, সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে সুরঞ্জিত বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সিআইডি ও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করবে।
ফারুক ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ : সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চাকরিচ্যুত এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তাঁর স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে আগামী সাত দিনের মধ্যে এ দুজনের ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলে দেশে কার্যরত সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটির কাছে এলেন না ফারুক : রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক গতকাল তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হননি। সকাল ১১টায় কমিটির কাছে ওমর ফারুকের লিখিত বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য সকাল থেকেই সাংবাদিকরা রেল ভবনে অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর বিষয়টির তদন্ত কর্মকর্তা রেলমন্ত্রীর পিএস আখতার-উজ-জামান কালের কণ্ঠকে রাতে জানান, ফারুক হাজির হননি। তবে তিনি লোক মারফত তাঁর বক্তব্য পাঠিয়েছেন। আর নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে লিখিত বক্তব্য দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে সকালেই রেল ভবনে হাজির হন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে ইউসুফ কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেন। একেক সময় একেক কথা বলেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, সোমবার রাতে গাড়িটি মন্ত্রীর বাসার দিকে যাচ্ছিল।
জানা গেছে, রেলে নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়াও বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে ঘুষ নিতেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তে গঠিত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি রেল ভবনে হাজির হন। রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহেরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। একই কমিটির সদস্য রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিংহ। গতকাল রেলওয়ে মহাপরিচালকের কক্ষে বসে ইউসুফ লিখিত বক্তব্য দেন।
ইউসুফের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে পাওয়া টাকার বিষয়ে একেক প্রশ্নে একেক রকম উত্তর দেন। বিভিন্ন প্রশ্নে ইউসুফ সরাসরি জবাব না দিয়ে এপিএস ওমর ফারুকের দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। তিনি প্রথমে বলেন, গাড়িতে টাকা ছিল কি না, তা তিনি জানেন না। আরেক প্রশ্নের জবাবে আবার তিনিই বলেন, গাড়িতে কী পরিমাণ টাকা ছিল, তা তাঁর জানা নেই। গাড়িতে কার টাকা ছিল- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওই টাকা যে ফারুকের, তা তিনিই তো বলেছেন। সোমবার রাতে কোথায় যাচ্ছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ফারুক তো বলেছেনই, আমরা মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলাম।' ওমর ফারুকের গাড়িতে কোথা থেকে উঠলেন, জানতে চাইলে ইউসুফ বলেন, 'তাঁরা রাস্তা থেকে আমাকে উঠিয়ে নেন।'
ইউসুফের বিরুদ্ধে রেল কর্মচারীরা নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করে এলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি শনিবার এই টাকা চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে ইউসুফ জানান, ট্রেনে তাঁর সঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, 'দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের প্রমাণ থাকলে উপস্থাপন করুন।'
তদন্ত কমিটির প্রধান রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা তদন্ত কমিটির সদস্যরা আজই কাজ শুরু করলাম। ইউসুফ মৃধা একটি লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন। তা দেখার পর তাঁকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।'
তবে জানা গেছে, সকালে তদন্ত কমিটির প্রধান রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের এবং মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শশী কুমার সিংহের সঙ্গে দেখা করেন ইউসুফ মৃধা।
ফারুক ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ : সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চাকরিচ্যুত এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তাঁর স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে আগামী সাত দিনের মধ্যে এ দুজনের ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলে দেশে কার্যরত সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে রেলমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো সুরঞ্জিতের বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া নিজ দলের একাধিক নেতাও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা জানতে পেরেছেন, গতকাল সকাল ১১টার দিকে সুরঞ্জিতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
গতকাল অবশ্য বেশির ভাগ সময় মন্ত্রীকে রেল ভবনে উদ্বিগ্ন সময় কাটাতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী তলব করেছেন কি না কিংবা তিনি কী বলেছেন, এসব বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে রেলমন্ত্রীর কাছে ফোন দেওয়া হয় কালের কণ্ঠ থেকে। তিনি প্রথমে ফোনটি রেখে দেন। এর পর আবার ফোন করা হলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে আপনিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে জেনে আসুন।'
অবস্থা সে রকম হলে পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার- গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এমন বক্তব্য দিলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরের দিন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুর পাল্টে ফেলে বলেন, 'পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।' গতকাল রেল ভবনে সাংবাদিকরা আবারও তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বৃহস্পতিবার যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটাই সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দেন। এরপর দ্রুত মিলনায়তন থেকে চলে যান।
'তাদের কথায়ও যাব না' : গতকাল রেল ভবনে অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুই রেল কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড এবং এপিএসকে চাকরিচ্যুত করার পর নিজের পদত্যাগের বিষয়ে বিরোধী দলের আহ্বানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'বিরোধী দল আমাকে পদ দেয়নি, তাদের কথায়ও এ পদ থেকে যাব না।' রেল ভবনে মন্ত্রী এই কথা বলার কয়েক ঘণ্টা আগে বিএনপির সংসদীয় দল এক সংবাদ সম্মেলনে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে।
বিরোধী দলের কথায় না হলে প্রধানমন্ত্রীর কথায় পদত্যাগ করবেন কি না- এ প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারে, সেখান থেকেই আসবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় রেল ভবনে নিজের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, 'অবস্থা বাধ্য করলে আমার পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার। কারণ রাজনীতিবিদদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় নয়।' তিনি আরো বলেছিলেন, 'আমার মূল পরিচয়, আমি এমপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে লড়েছি। সুবিধা নিইনি।'
তবে পরের দিন শুক্রবার বিবিসি বাংলায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি পদত্যাগের বিষয় সরাসরি নাকচ করে দেন। ওই সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী বলেন, যেহেতু অভিযোগ উঠেছে তাঁর একজন সহকারী এবং রেলওয়ের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, তাই এখানে তাঁর নিজের পদত্যাগের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
মন্ত্রিসভার একজন দায়িত্বশীল সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের টাকার বস্তাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যও করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বুধবার তুরস্ক যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনাটি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এমনকি রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করুক- এমন কথাও উচ্চারণ করেন তিনি।
তিন অভিযুক্তের শাস্তি : অবশেষে চাপে পড়ে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি জানিয়েছেন, তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হবে। তিনি আরো জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল নিরাপত্তা বাহিনীর নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সাসপেন্ড এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওঠা অভিযোগও জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করা হবে।
গতকাল দুপুরে রেল ভবনে আড়াই ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিংহ, রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের, মন্ত্রীর পিএস আখতার-উজ-জামানও ছিলেন। বৈঠকের পর দুপুর আড়াইটার দিকে রেলমন্ত্রী রেল ভবন মিলনায়তনে সাংবাদিকদের ওই সব সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে পদত্যাগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'এ নিয়ে তো আমি আগেই কথা বলেছি।'
রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পৃক্ত করে তাতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
টাকা আটক ঘটনার পরের দিন এপিএসের পক্ষ নিলেও এখন কেন তাঁকে অব্যাহতি দিলেন, সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে সুরঞ্জিত বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সিআইডি ও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করবে।
ফারুক ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ : সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চাকরিচ্যুত এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তাঁর স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে আগামী সাত দিনের মধ্যে এ দুজনের ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলে দেশে কার্যরত সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটির কাছে এলেন না ফারুক : রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক গতকাল তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হননি। সকাল ১১টায় কমিটির কাছে ওমর ফারুকের লিখিত বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য সকাল থেকেই সাংবাদিকরা রেল ভবনে অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর বিষয়টির তদন্ত কর্মকর্তা রেলমন্ত্রীর পিএস আখতার-উজ-জামান কালের কণ্ঠকে রাতে জানান, ফারুক হাজির হননি। তবে তিনি লোক মারফত তাঁর বক্তব্য পাঠিয়েছেন। আর নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে লিখিত বক্তব্য দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে সকালেই রেল ভবনে হাজির হন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে ইউসুফ কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেন। একেক সময় একেক কথা বলেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, সোমবার রাতে গাড়িটি মন্ত্রীর বাসার দিকে যাচ্ছিল।
জানা গেছে, রেলে নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়াও বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে ঘুষ নিতেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তে গঠিত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি রেল ভবনে হাজির হন। রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহেরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। একই কমিটির সদস্য রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিংহ। গতকাল রেলওয়ে মহাপরিচালকের কক্ষে বসে ইউসুফ লিখিত বক্তব্য দেন।
ইউসুফের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে পাওয়া টাকার বিষয়ে একেক প্রশ্নে একেক রকম উত্তর দেন। বিভিন্ন প্রশ্নে ইউসুফ সরাসরি জবাব না দিয়ে এপিএস ওমর ফারুকের দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। তিনি প্রথমে বলেন, গাড়িতে টাকা ছিল কি না, তা তিনি জানেন না। আরেক প্রশ্নের জবাবে আবার তিনিই বলেন, গাড়িতে কী পরিমাণ টাকা ছিল, তা তাঁর জানা নেই। গাড়িতে কার টাকা ছিল- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওই টাকা যে ফারুকের, তা তিনিই তো বলেছেন। সোমবার রাতে কোথায় যাচ্ছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ফারুক তো বলেছেনই, আমরা মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলাম।' ওমর ফারুকের গাড়িতে কোথা থেকে উঠলেন, জানতে চাইলে ইউসুফ বলেন, 'তাঁরা রাস্তা থেকে আমাকে উঠিয়ে নেন।'
ইউসুফের বিরুদ্ধে রেল কর্মচারীরা নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করে এলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি শনিবার এই টাকা চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে ইউসুফ জানান, ট্রেনে তাঁর সঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, 'দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের প্রমাণ থাকলে উপস্থাপন করুন।'
তদন্ত কমিটির প্রধান রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা তদন্ত কমিটির সদস্যরা আজই কাজ শুরু করলাম। ইউসুফ মৃধা একটি লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন। তা দেখার পর তাঁকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।'
তবে জানা গেছে, সকালে তদন্ত কমিটির প্রধান রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের এবং মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শশী কুমার সিংহের সঙ্গে দেখা করেন ইউসুফ মৃধা।
ফারুক ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ : সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চাকরিচ্যুত এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তাঁর স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে আগামী সাত দিনের মধ্যে এ দুজনের ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলে দেশে কার্যরত সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
No comments