গাজীপুরের মাণিক্য মাধবের রথযাত্রা ও রথমেলা by এনামুল হক
আজ উল্টোরথ। ভাওয়াল রাজাদের প্রচলিত জয়দেবপুরের শ্রীশ্রী মাণিক্য মাধবের রথযাত্রা ও রথমেলা এমনই এক কীর্তি, যার গায়ে লেগে রয়েছে প্রায় দেড়শ' বছর সময়ের স্পর্শ। ভাওয়াল রাজবংশের বিলুপ্তি ঘটলেও বর্তমানে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে ছাড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র লাভ করায় মেলাটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
তবে ভাওয়াল রাজবংশের ইতিহাস যত প্রাচীন, মেলাটির ইতিহাস কিন্তু নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে যে কুশধস রায়ের মাধ্যমে ভাওয়াল রাজবংশের পত্তন ঘটে, তারই অষ্টম উত্তর-পুরুষ রাজা কালীনারায়ণ রায় চৌধুরীর আমলে এ রথযাত্রা ও মেলার প্রচলন ঘটে। ভাওয়াল রাজবংশের মধ্যে রাজা কালীনারায়ণ সবচেয়ে খ্যাতিমান শাসক ছিলেন। এ রথযাত্রা প্রচলনের পেছনেও রয়েছে এক চমকপ্রদ কাহিনী। রাজা কালীনারায়ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী সত্যভামা ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও পূজার্চনায় নিবেদিতপ্রাণ মহিলা। রাজবাড়ীর অভ্যন্তরে রানীদের পূজার্চনার জন্য ছিল 'পদ্মনাভ ঠাকুরঘর'। জনশ্রুতি আছে, একদিন পদ্মনাভ ঠাকুরঘরে পূজার্চনার সময় সত্যভামা দেববাণী শুনতে পান যে, দীঘি থেকে মাধবমূর্তি উত্তোলন করে সে মূর্তি দিয়ে জয়দেবপুরে রথযাত্রার প্রচলন করতে হবে। এছাড়া একই বিষয়ে তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী ভাওয়াল রাজাদের প্রথম আবাসস্থল চাঁদনা (চান্দনা) গ্রামের নবলক্ষ্মী দীঘি থেকে পাঁচটি এবং বর্তমান রাজবাড়ী সংলগ্ন রাজদীঘি (মতান্তরে শ্রীপুর থানার রাজবাড়ী এলাকার একটি দীঘি) থেকে দুটিসহ মোট সাতটি মাধববিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু শেষোক্ত দুটি মূর্তি উত্তোলনকালে একটি মূর্তির নাক আংশিক কর্তিত হয়ে গেলে সে মূর্তিটি আর উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য অন্য একটি জনশ্রুতি অনুসারে রাজবাড়ী সংলগ্ন রাজদীঘি থেকেই ছয়টি মাধববিগ্রহ পাওয়া যায়। এ ছাড়া যে ছয়টি মাধববিগ্রহ পাওয়া যায় সেগুলোর নামকরণ নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবে সংখ্যাধিক্যের মতানুসারে ছয়টি মাধববিগ্রহের নাম হচ্ছে মাণিক্য মাধব, ঠাকুর কুমার মাধব, চক্রপাণি মাধব, নীলাম্বর মাধব, যশোমাধব এবং বাসুদেব মাধব।
রথযাত্রা প্রচলনের সময় থেকে শ্রীশ্রী মাণিক্য মাধব মূর্তি রথে অধিষ্ঠান করিয়েই রথযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা করা হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রথযাত্রা বন্ধ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাধববাড়ী ও মাধবমূর্তিসহ রথের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। স্বাধীনতার পর রাজদীঘি থেকে দুটি মাধববিগ্রহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়, বাকি চারটি মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। যে দুটি মাধবমূর্তি উদ্ধার করা হয় তার একটি মাণিক্য মাধব বলে শনাক্ত করা হয় এবং স্বাধীনতার পর থেকে এ মূর্তিটিই রথে অধিষ্ঠান করিয়ে রথটান দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুটি মাধববিগ্রহই একদল দুষ্কৃতকারী দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ১৯৯৩ সাল থেকে শ্রীশ্রী মাণিক্য মাধবের বিগ্রহের অনুরূপ মাটির তৈরি একটি মূর্তি বর্তমানে রথে অধিষ্ঠান করে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়।
ভাওয়াল রাজবংশের বিলুপ্তি ঘটলে রাজাদের বিশাল সহায়-সম্পত্তি তত্ত্বাবধানের ভার বর্তায় ভাওয়াল কোর্ট অব ওয়ার্ডস এস্টেটের ওপর। রথমেলার আয়োজন ও পরিচালনার ভারও পড়ে এস্টেটের ওপর। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা ও জটিলতার কারণে এস্টেটের পক্ষে রথমেলাটি সুচারুভাবে পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ে। জয়দেবপুর রথখোলার অধিকাংশ জমি লিজ দেওয়ায় মেলার স্থানও সংকুচিত হয়ে এসেছে। মেলা আয়োজনের খরচ মেটানোর জন্য যেসব ধানি জমি ছিল সেগুলো ইতিমধ্যে লিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৪ সালে গাজীপুর জেলায় উন্নীত হওয়ার পর মেলাটি পরিচালনার ভার বর্তায় জেলা প্রশাসনের ওপর। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রা ও দশমী তিথিতে পুনর্যাত্রা বা উল্টো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। রথযাত্রা ও পুনর্যাত্রার দিন নির্দিষ্ট লগ্নে রথটান হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ হাজার হাজার নর-নারী উপবাস থেকে রথটানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। রথযাত্রা উপলক্ষে জেলা শহরের রথখোলায় ১৫ থেকে ২০ দিনব্যাপী বিরাট মেলা বসে। মেলাটি বর্তমানে একটি সর্বজনীন মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। কাঠের তৈরি বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র, মাটির তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য, হস্তজাত দ্রব্য, তামা-কাঁসার জিনিস, চুড়ি, খেলনা, তৈজসপত্র, মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদির বিপুল সমারোহে মেলাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। মেলায় আরও আসে সার্কাস, পুতুলনাচ, নাগরদোলা। সব মিলিয়ে মেলাটি যেন এক আড়ম্বরপূর্ণ জৌলুস ও মহিমময় দীপ্তি নিয়ে এলাকার গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে প্রতিবছর জমে ওঠে।
enamulgpur@gmail.com
রথযাত্রা প্রচলনের সময় থেকে শ্রীশ্রী মাণিক্য মাধব মূর্তি রথে অধিষ্ঠান করিয়েই রথযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা করা হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রথযাত্রা বন্ধ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাধববাড়ী ও মাধবমূর্তিসহ রথের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। স্বাধীনতার পর রাজদীঘি থেকে দুটি মাধববিগ্রহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়, বাকি চারটি মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। যে দুটি মাধবমূর্তি উদ্ধার করা হয় তার একটি মাণিক্য মাধব বলে শনাক্ত করা হয় এবং স্বাধীনতার পর থেকে এ মূর্তিটিই রথে অধিষ্ঠান করিয়ে রথটান দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুটি মাধববিগ্রহই একদল দুষ্কৃতকারী দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ১৯৯৩ সাল থেকে শ্রীশ্রী মাণিক্য মাধবের বিগ্রহের অনুরূপ মাটির তৈরি একটি মূর্তি বর্তমানে রথে অধিষ্ঠান করে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়।
ভাওয়াল রাজবংশের বিলুপ্তি ঘটলে রাজাদের বিশাল সহায়-সম্পত্তি তত্ত্বাবধানের ভার বর্তায় ভাওয়াল কোর্ট অব ওয়ার্ডস এস্টেটের ওপর। রথমেলার আয়োজন ও পরিচালনার ভারও পড়ে এস্টেটের ওপর। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা ও জটিলতার কারণে এস্টেটের পক্ষে রথমেলাটি সুচারুভাবে পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ে। জয়দেবপুর রথখোলার অধিকাংশ জমি লিজ দেওয়ায় মেলার স্থানও সংকুচিত হয়ে এসেছে। মেলা আয়োজনের খরচ মেটানোর জন্য যেসব ধানি জমি ছিল সেগুলো ইতিমধ্যে লিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৪ সালে গাজীপুর জেলায় উন্নীত হওয়ার পর মেলাটি পরিচালনার ভার বর্তায় জেলা প্রশাসনের ওপর। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রা ও দশমী তিথিতে পুনর্যাত্রা বা উল্টো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। রথযাত্রা ও পুনর্যাত্রার দিন নির্দিষ্ট লগ্নে রথটান হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ হাজার হাজার নর-নারী উপবাস থেকে রথটানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। রথযাত্রা উপলক্ষে জেলা শহরের রথখোলায় ১৫ থেকে ২০ দিনব্যাপী বিরাট মেলা বসে। মেলাটি বর্তমানে একটি সর্বজনীন মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। কাঠের তৈরি বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র, মাটির তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য, হস্তজাত দ্রব্য, তামা-কাঁসার জিনিস, চুড়ি, খেলনা, তৈজসপত্র, মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদির বিপুল সমারোহে মেলাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। মেলায় আরও আসে সার্কাস, পুতুলনাচ, নাগরদোলা। সব মিলিয়ে মেলাটি যেন এক আড়ম্বরপূর্ণ জৌলুস ও মহিমময় দীপ্তি নিয়ে এলাকার গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে প্রতিবছর জমে ওঠে।
enamulgpur@gmail.com
No comments