লিবিয়া-আল ফাতা আবাদান? by আবুল হায়াত
দাখিল সাহেব, আশা করি উপর্যুপরি বোমা হামলার মাঝেও সহিসালামতে আছেন আপনি। আজ এত দিন পর কেন বারবার আপনার কথা মনে পড়ছে, সেটা বলার জন্যই এই চিঠির অবতারণা। আপনার হয়তো মনে নেই, তিনটি বছর আপনাদের দেশে থাকার সময়টিতে যে মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছিল তাঁর নাম হলো আস সাইদ আদ দাখিল, আপনি।
আপনি ছিলেন আমাদের কোম্পানির কারিগরি পরিচালক। খুব ভালো ইংরেজি জানা মানুষ হিসেবে আপনার সঙ্গে একধরনের সখ্য গড়ে ওঠে আমার। আপনার মনমানসিকতা ছিল আপনার দেশের অন্য অনেকের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি অনেক সময় এমন সব কথা উচ্চারণ করেছেন, যা সেই সময় ছিল খুবই অস্বাভাবিক এবং আমার মতো একজন বিদেশির শোনাটাও ছিল ভীতিপ্রদ। ওই দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জেনেছিলাম—ওখানকার নাগরিকদের প্রতি দশজনের একজন সরকারি গুপ্তচর। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, ওপরে ওপরে যতই বন্ধুত্ব থাকুক। জেনেছিলাম, বেফাঁস কথা বলার শাস্তি একটাই: বিএমডব্লিউ গাড়ি হাঁকিয়ে কোনো যুবক এসে তার লাজনা তাওরিয়ার (বিপ্লবী পরিষদ) সদস্য কার্ড দেখিয়ে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে অজানা গন্তব্যে; কোনো দিন হদিস মিলবে না আপনার।
কিন্তু আপনি অনেক কথাই বলতেন আমার সঙ্গে। আমি সাহস করে আপনার কথায় সায় দিতাম না। শুধু শুনতাম আর মৃদু হাসতাম।
আপনাদের দেশে পৌঁছেছিলাম ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর। আবুলাসের পুরোনো বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া করা বোয়িং থেকে আমরা প্রায় ২০০ বাঙালি নেমে যখন গাড়িতে উঠলাম, প্রচণ্ড শীতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা আমাদের। ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অতি চমৎকার প্রাকৃতিক তেলসমৃদ্ধ দেশ আপনাদের। আমার কর্মস্থল ছিল ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাওরিয়াহ শহরের কোলঘেঁষে। রাজধানী ত্রাবুলাস (ত্রিপোলি) থেকে ৫০ কিমি. পশ্চিমে।
দাখিল সাহেব, আপনাদের মহান বিপ্লবী নেতা সম্বন্ধে জেনেছিলাম খুব দ্রুতই। জেনেছিলাম, সোভিয়েত রাশিয়া আপনাদের বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু মিসর সবচেয়ে বড় শত্রু। মোয়াম্মার আল গাদ্দাফি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবেই ইতালির পুতুল বাদশা ইদ্রিসকে তাড়িয়ে ১৯৬৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর এক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তাই আপনাদের মুক্তিদিবস হলো আওয়াল সেবতেম্বর (পয়লা সেপ্টেম্বর)। আর আপনাদের জাতীয় স্লোগান হলো, ‘আলফাতাহ আবাদান’। আলফাতাহ অর্থাৎ প্রথম। এটা ওই পয়লা সেপ্টেম্বরের প্রতীক। আর ‘আবাদান’ হচ্ছে ‘চিরদিনের জন্য’ বা চিরজীবী বা জিন্দাবাদ।
একদিন আপনি বলেছিলেন, ‘আলফাতা আবাদান ইজ ফানি মি. হায়াত। ইট ক্যান চেঞ্জ অ্যানি ডে। আই ডোন্ট এগ্রি উইথ ইট।’ মানুন আর না-ই মানুন, আর সবার মতো আপনিও প্যারেডে গিয়ে বজ্রমুষ্টি আকাশে তুলে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন, ‘আলফাতা আবাদান!’
হ্যাঁ, আপনি একজন প্রকৌশলী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর একবার সেনাবাহিনীর পোশাক পরে প্যারেড করতে যেতেন। এটা ছিল আপনার দেশের রীতি। আপনি বলেছিলেন, ‘আমরা ধনী দেশ, ধনীদের আবার সমাজতন্ত্র কী? গাদ্দাফি আমাদের ুঅলীক সব স্বপ্ন দেখান।’ আমি শুধু স্মিতহাস্যে উত্তর করেছিলাম, ‘আমার তো খুব ভালো লাগছে আপনাদের সিস্টেম। কী সুন্দর, শান্তির দেশ!
‘শান্তি! হা। আমার টাকা আছে। আমি তো ফকির না। আমি কেন চাল-ডাল, কাপড় কিনতে লাইন দেব?’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠ ছিল আপনার।
ও হ্যাঁ, ওখানে গিয়েই জানতে পারি, সবুজ খুব পছন্দ আপনাদের বিপ্লবী নেতার (তিনি কোনো দিনই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হননি)। তাঁর প্রথম প্রকল্প ছিল মরুর দেশকে সবুজ করার। তাই সৃষ্টি করেন মানুষের তৈরি বৃহত্তম নদী। কত বড় সব কৃষিপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয় প্রথমেই, আর তারই একটিতে কাজ করতে গিয়েছিলাম আমি আপনাদের দেশ লিবিয়ায়।
সবুজ আসলেই তাঁর খুব পছন্দের রং। ক্ষমতা গ্রহণ করেই পতাকার রং করলেন সম্পূর্ণ সবুজ। বই লিখলেন কিতাবুল আখদার অর্থাৎ ‘সবুজ বই’। এতে তিনি লিখলেন, পৃথিবীর কোথাও যদি গণতন্ত্র থেকে থাকে, তা হচ্ছে একমাত্র লিবিয়ায়। ত্রাবুলাস শহরে যে মাঠে তিনি বক্তব্য দেন সেটা কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে সবুজ রং করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় ‘ময়দানে আখদার’—সবুজ মাঠ। এককথায় সবুজ আপনাদের রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় রং। গাদ্দাফি সাহেবের পোশাকেও সবুজের আধিক্য।
এই সবুজ নিয়ে একদিন কী হয়েছিল মনে আছে আপনার? আমি ছিলাম ধার আত তারফাস প্রকল্পের নির্মাণ প্রকৌশলী। আমার অধীনে সেখানে অন্যান্য ভৌতকাঠামোর সঙ্গে ৭২টি পানির পাম্পহাউস নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলো নির্মাণের পর যখন দরজা-জানালা রং করার প্রশ্ন এল, তখন এক কারিগরি সভা বসল। সেই সভায় আপনি উপস্থিত ছিলেন, দাখিল সাহেব। নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করতে থাকায় সমস্যা বাড়তে থাকে। আমি সেই সময় বলি, ‘সবুজ রং দিয়ে দিই? তাহলে নিশ্চয় কারও আপত্তি হবে না।’
এর পরের প্রতিক্রিয়া মনে হলে আজও আমি শিউরে উঠি। সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল আমার দিকে। কেবল হাসি দেখেছিলাম আপনার চোখেমুখে। মিসরীয় প্রধান প্রকৌশলী মজিদ সাহেব এককাঠি ওপরের মানুষ। তিনি হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘সবুজ রং নিয়ে আপনার তামাশা করা উচিত নয় মি. হায়াত।’
বিষয়টা আরও মারাত্মক হতে পারত, কিন্তু আপনি বলে উঠেছিলেন, ‘আরে না না, তামাশা হবে কেন? উনি তো আমাদের একটা সহজ সমাধান দিতে চেয়েছেন। সমাধান গ্রহণ করা না-করা আমাদের ব্যাপার। তাই না মি. হায়াত?’ বলেই একগাল হেসে পরিস্থিতি হালকা করেছিলেন আপনি।
সেখানেই বিষয়টা শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। মিটিং শেষে আমার প্রকল্প পরিচালক আলী জেরেবি তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে সাবধান করে দেওয়ার মতো করেই বলেছিলেন, ‘মি. হায়াত, এ দেশে তোমার সাবধানে কথাবার্তা বলা উচিত। আমরা সবাই এক মন-মানসিকতার নই। তা ছাড়া মনে রেখো, তোমরা বিদেশিরা এখানে এসেছ টাকা উপার্জন করতে। সুতরাং কাজ করবে, টাকা নেবে। খাবে, ঘুমাবে। ব্যস। আর কিছু না।’
জেরেবি সাহেব আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি প্রায়ই ইউরোপিয়ানদের গালাগাল দিয়ে কথা বলতেন, ‘এ দেশে এসে ওরা কাজ করে না, কাজের ভান করে। কিন্তু তোমরা বাঙালিরা অনেক পরিশ্রমী। আমি তোমাদের পছন্দ করি।’ তিনি আমার পরিবারকে দেশে চলে আসার আগে বাড়িতে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন, যেটা ও দেশে ছিল বিরল ঘটনা। তিনি অবশ্য একটু মুডিও ছিলেন, বেশির ভাগ লিবীয়কেই তাই মনে হয়েছে আমার কাছে। বন্ধুবৎসল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অহংকার আপনাদের। টাকার অহংকার। সেই অহংকারের কারণেই বিদেশিদের বলতেন মিসকিন (দুস্থ)।
কিন্তু সত্যিই একজনকে পেয়েছিলাম ব্যতিক্রম। তিনি হলেন মি. আস সাইদ আদ দাখিল। সে কারণেই বারবার মনে পড়ছে আপনার কথা। আজ আপনার দেশে পশ্চিমা হানাদার চক্রের বোমা পড়ছে। বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে হয়তো আপনাদের গোছানো সংসার। হতাহত হচ্ছে কত নিরীহ নাগরিক। দুই দিকে শত্রু আজ আপনাদের। ঘরে এবং বাইরে। বেঁচে থাকলে কোন দিকে আজ আপনি? গাদ্দাফির পক্ষে না কি মুক্তিকামী জনতার কাতারে? শেষের পক্ষের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে। তাই তো আমার আশঙ্কাটা বেড়ে যাচ্ছে অনেক।
যা-ই হোক, সবুজের কথা বলছিলাম। ওই ঘটনার পর আমি লিবিয়ায় অবস্থানকালে কোনো দিন ‘সবুজ’ শব্দ উচ্চারণ করার মতো সাহস দেখাইনি আর। হ্যাঁ, সেই সঙ্গে মনে পড়ছে, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়, কেন? ‘গাদ্দাফি’ উচ্চারণ করে বাংলায় প্রশংসা করলে ভুল বোঝার আশঙ্কা ছিল একজন লিবীয়র পক্ষে। সেই ভুল বোঝার কারণে যেকোনো সময় দরজায় বিএমডব্লিউ গাড়ি এসে হাজিরও হতে পারত। সেই ভয়ে আমরা (সব বিদেশিই) ওই নেতার নাম উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকতাম। দেয়ালেরও কান আছে—কথাটা নাকি আপনাদের দেশে বাস্তব সত্য। শুনেছি আপনারা নিজেরাও ভুলে তাঁর প্রশংসাও করতেন না, ‘কী দরকার বাবা, ওই ধরনের বিপদে পড়ার—খারাপ তো নেই আমরা।’ আসলে আপনারা যত সুখেই থাকুন না কেন, সব সময় থাকতেন তটস্থ। কারণ, ওই যে দশজনে একজন সরকারি চর!
চিঠিটা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের এই ঘোর বিপর্যয়ের সময় বারবার ভেসে উঠছে সেই সব মুখ—আলী দেরেবি, খলিফা মাউই, আলী হোসেন, মাবরুক, আব্দুল মজিদ, রামাদান, আরও কত না ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর। তাদের শান্তির নীড়ে আজ বাজপাখির হানা, সেই সঙ্গে মুক্তির আহ্বান। কোন দিকে যাবেন আপনারা? সত্যিই এক মহা দোলাচলে পড়েছেন, দাখিল সাহেব।
সেই যে আমরা ওয়াটার রিজারভুয়ারের ফাউন্ডেশন ঢালাই করছিলাম যে রাতে, সেই রাতের কথা কি মনে আছে? জুন বা জুলাই। দিনের বেলায় ঢালাই করা অসম্ভব ছিল। কারণ বাতাসে আর্দ্রতা ছিল অতি অল্প। ঢালাই করার সঙ্গে সঙ্গেই সূর্যের খরতাপে কংক্রিট শুকিয়ে ফাটল ধরে যায়। তাই রাতেই ঢালাই হচ্ছিল। সেদিন আপনি ত্রিপোলি থেকে এসেছিলেন নিজে দাঁড়িয়ে কাজের শুরুটা দেখবেন বলে।
শেষ রাতের দিকে দুজনই ছিলাম একটু শ্রান্ত। চায়ের খোঁজ করতেই বাঙালি শ্রমিক ভাইদের কেউ একজন এগিয়ে এলেন দুকাপ চা নিয়ে। কাপ দুটো হাতে নিয়ে দুলে উঠে হাঁটতে লাগলাম ফাঁকা পিচঢালা রাস্তাটা দিয়ে। ভোরের বাতাস বইতে শুরু করেছে তখন। দূরে কোথায় যেন মোরগ ডেকে উঠল। পাখির কিচিরমিচির শব্দও ভেসে আসতে শুরু করেছিল তখন। আপনাদের দেশটা সত্যিই দারুণ সুন্দর এবং শান্তির ঘর। সত্যিকার ‘দারুস সালাম’—মুগ্ধ হয়ে বলেছিলাম আমি।
আপনি মৃদু হেসে উত্তর করেছিলেন, ‘নো, মি. হায়াত! ইউ আর রং। এটা শান্তির ঘর নয়। ওপরে শান্তি, ভেতরে জ্বলছে আগুন। কালরাতে দেখেননি, টেলিভিশনে কতগুলো মানুষকে জনসমক্ষে বিচার করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো?’
‘হ্যাঁ, সে রকমই দেখেছিলাম মনে হয়। বুঝতে পারিনি কিছু। তারা কি দুর্নীতিবাজ?’
‘না, তারা দুর্নীতিবাজ নয়। তারা প্রতি-বিপ্লবী। জানো, এ দেশে প্রতি মাসে একটা করে ক্যু হয়, আর শ শ লোককে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়।’
সত্যি বলেছিলেন কি মিথ্যা বলেছিলেন জানি না, কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, দাখিল সাহেব।’
জানি না, সেদিন আপনার কী হয়েছিল। মনের সব কথা উজাড় করছিলেন একের পর এক। সবশেষে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে বলছি মি. হায়াত, দিস আলফাতা ইজ নট আবাদান। এর শেষ একদিন হবেই। জানি না দেখে যেতে পারব কি না। বাট ইট মাস্ট এন্ড।’
কথাগুলো আজ ভীষণভাবে বাজছে আমার কানে। চোখে ভেসে উঠছে সেই পরিচিত স্থানগুলো। ত্রাবুলাস, আজ-যাওয়াবিয়াহ্, বির আত তাবফাস, সিরত, সাকাতা, গারিয়ান, মিসরাতা, মিজদাহ, আদিজিয়া, আরও কত কত জায়গা। ভেসে উঠছে সেই সব দেখা দৃশ্য। টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিদিন আপনাদের মহান নেতা এবং তাঁর গুণগ্রাহীদের কণ্ঠে উলুধ্বনির সঙ্গে আলফাতাহ আবাদানের বজ্রকণ্ঠ। সব মনে পড়ছে।
সেসব কি সত্যিই থেমে যাবে? যেমন দেখতে চেয়েছিলেন আপনি? আমার মনে এখন একটা প্রশ্নই জাগছে, ‘আলফাতা আবাদান’ যদি থামেও, সেটা কে থামাবে—মুক্তিকামী লিবীয় জনসাধারণ, নাকি আগ্রাসী পশ্চিমা বাহিনী? যারা দেশে দেশে কায়েমি স্বার্থ অন্বেষণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালে?
আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কামনা করি, আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হোক। লিবিয়া মুক্তির আলো দেখুক—নিজেরা লড়ে আদায় করুক স্বাধীনতা। কোনো স্বার্থবাদী শক্তির সহায়তায় নয়। মনে বিশ্বাস রাখুন। কোনো অন্যায্য আলফাতাই আবাদান হয় না। ভালো থাকুন, দাখিল সাহেব, সুস্থ থাকুন। জয় হোক আপনাদের। মাআ সালামা (শান্তিতে থাকুন)।
ঢাকা, ২৪ মার্চ ২০১১
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
কিন্তু আপনি অনেক কথাই বলতেন আমার সঙ্গে। আমি সাহস করে আপনার কথায় সায় দিতাম না। শুধু শুনতাম আর মৃদু হাসতাম।
আপনাদের দেশে পৌঁছেছিলাম ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর। আবুলাসের পুরোনো বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া করা বোয়িং থেকে আমরা প্রায় ২০০ বাঙালি নেমে যখন গাড়িতে উঠলাম, প্রচণ্ড শীতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা আমাদের। ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অতি চমৎকার প্রাকৃতিক তেলসমৃদ্ধ দেশ আপনাদের। আমার কর্মস্থল ছিল ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাওরিয়াহ শহরের কোলঘেঁষে। রাজধানী ত্রাবুলাস (ত্রিপোলি) থেকে ৫০ কিমি. পশ্চিমে।
দাখিল সাহেব, আপনাদের মহান বিপ্লবী নেতা সম্বন্ধে জেনেছিলাম খুব দ্রুতই। জেনেছিলাম, সোভিয়েত রাশিয়া আপনাদের বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু মিসর সবচেয়ে বড় শত্রু। মোয়াম্মার আল গাদ্দাফি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবেই ইতালির পুতুল বাদশা ইদ্রিসকে তাড়িয়ে ১৯৬৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর এক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তাই আপনাদের মুক্তিদিবস হলো আওয়াল সেবতেম্বর (পয়লা সেপ্টেম্বর)। আর আপনাদের জাতীয় স্লোগান হলো, ‘আলফাতাহ আবাদান’। আলফাতাহ অর্থাৎ প্রথম। এটা ওই পয়লা সেপ্টেম্বরের প্রতীক। আর ‘আবাদান’ হচ্ছে ‘চিরদিনের জন্য’ বা চিরজীবী বা জিন্দাবাদ।
একদিন আপনি বলেছিলেন, ‘আলফাতা আবাদান ইজ ফানি মি. হায়াত। ইট ক্যান চেঞ্জ অ্যানি ডে। আই ডোন্ট এগ্রি উইথ ইট।’ মানুন আর না-ই মানুন, আর সবার মতো আপনিও প্যারেডে গিয়ে বজ্রমুষ্টি আকাশে তুলে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন, ‘আলফাতা আবাদান!’
হ্যাঁ, আপনি একজন প্রকৌশলী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর একবার সেনাবাহিনীর পোশাক পরে প্যারেড করতে যেতেন। এটা ছিল আপনার দেশের রীতি। আপনি বলেছিলেন, ‘আমরা ধনী দেশ, ধনীদের আবার সমাজতন্ত্র কী? গাদ্দাফি আমাদের ুঅলীক সব স্বপ্ন দেখান।’ আমি শুধু স্মিতহাস্যে উত্তর করেছিলাম, ‘আমার তো খুব ভালো লাগছে আপনাদের সিস্টেম। কী সুন্দর, শান্তির দেশ!
‘শান্তি! হা। আমার টাকা আছে। আমি তো ফকির না। আমি কেন চাল-ডাল, কাপড় কিনতে লাইন দেব?’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠ ছিল আপনার।
ও হ্যাঁ, ওখানে গিয়েই জানতে পারি, সবুজ খুব পছন্দ আপনাদের বিপ্লবী নেতার (তিনি কোনো দিনই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হননি)। তাঁর প্রথম প্রকল্প ছিল মরুর দেশকে সবুজ করার। তাই সৃষ্টি করেন মানুষের তৈরি বৃহত্তম নদী। কত বড় সব কৃষিপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয় প্রথমেই, আর তারই একটিতে কাজ করতে গিয়েছিলাম আমি আপনাদের দেশ লিবিয়ায়।
সবুজ আসলেই তাঁর খুব পছন্দের রং। ক্ষমতা গ্রহণ করেই পতাকার রং করলেন সম্পূর্ণ সবুজ। বই লিখলেন কিতাবুল আখদার অর্থাৎ ‘সবুজ বই’। এতে তিনি লিখলেন, পৃথিবীর কোথাও যদি গণতন্ত্র থেকে থাকে, তা হচ্ছে একমাত্র লিবিয়ায়। ত্রাবুলাস শহরে যে মাঠে তিনি বক্তব্য দেন সেটা কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে সবুজ রং করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় ‘ময়দানে আখদার’—সবুজ মাঠ। এককথায় সবুজ আপনাদের রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় রং। গাদ্দাফি সাহেবের পোশাকেও সবুজের আধিক্য।
এই সবুজ নিয়ে একদিন কী হয়েছিল মনে আছে আপনার? আমি ছিলাম ধার আত তারফাস প্রকল্পের নির্মাণ প্রকৌশলী। আমার অধীনে সেখানে অন্যান্য ভৌতকাঠামোর সঙ্গে ৭২টি পানির পাম্পহাউস নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলো নির্মাণের পর যখন দরজা-জানালা রং করার প্রশ্ন এল, তখন এক কারিগরি সভা বসল। সেই সভায় আপনি উপস্থিত ছিলেন, দাখিল সাহেব। নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করতে থাকায় সমস্যা বাড়তে থাকে। আমি সেই সময় বলি, ‘সবুজ রং দিয়ে দিই? তাহলে নিশ্চয় কারও আপত্তি হবে না।’
এর পরের প্রতিক্রিয়া মনে হলে আজও আমি শিউরে উঠি। সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল আমার দিকে। কেবল হাসি দেখেছিলাম আপনার চোখেমুখে। মিসরীয় প্রধান প্রকৌশলী মজিদ সাহেব এককাঠি ওপরের মানুষ। তিনি হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘সবুজ রং নিয়ে আপনার তামাশা করা উচিত নয় মি. হায়াত।’
বিষয়টা আরও মারাত্মক হতে পারত, কিন্তু আপনি বলে উঠেছিলেন, ‘আরে না না, তামাশা হবে কেন? উনি তো আমাদের একটা সহজ সমাধান দিতে চেয়েছেন। সমাধান গ্রহণ করা না-করা আমাদের ব্যাপার। তাই না মি. হায়াত?’ বলেই একগাল হেসে পরিস্থিতি হালকা করেছিলেন আপনি।
সেখানেই বিষয়টা শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। মিটিং শেষে আমার প্রকল্প পরিচালক আলী জেরেবি তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে সাবধান করে দেওয়ার মতো করেই বলেছিলেন, ‘মি. হায়াত, এ দেশে তোমার সাবধানে কথাবার্তা বলা উচিত। আমরা সবাই এক মন-মানসিকতার নই। তা ছাড়া মনে রেখো, তোমরা বিদেশিরা এখানে এসেছ টাকা উপার্জন করতে। সুতরাং কাজ করবে, টাকা নেবে। খাবে, ঘুমাবে। ব্যস। আর কিছু না।’
জেরেবি সাহেব আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি প্রায়ই ইউরোপিয়ানদের গালাগাল দিয়ে কথা বলতেন, ‘এ দেশে এসে ওরা কাজ করে না, কাজের ভান করে। কিন্তু তোমরা বাঙালিরা অনেক পরিশ্রমী। আমি তোমাদের পছন্দ করি।’ তিনি আমার পরিবারকে দেশে চলে আসার আগে বাড়িতে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন, যেটা ও দেশে ছিল বিরল ঘটনা। তিনি অবশ্য একটু মুডিও ছিলেন, বেশির ভাগ লিবীয়কেই তাই মনে হয়েছে আমার কাছে। বন্ধুবৎসল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অহংকার আপনাদের। টাকার অহংকার। সেই অহংকারের কারণেই বিদেশিদের বলতেন মিসকিন (দুস্থ)।
কিন্তু সত্যিই একজনকে পেয়েছিলাম ব্যতিক্রম। তিনি হলেন মি. আস সাইদ আদ দাখিল। সে কারণেই বারবার মনে পড়ছে আপনার কথা। আজ আপনার দেশে পশ্চিমা হানাদার চক্রের বোমা পড়ছে। বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে হয়তো আপনাদের গোছানো সংসার। হতাহত হচ্ছে কত নিরীহ নাগরিক। দুই দিকে শত্রু আজ আপনাদের। ঘরে এবং বাইরে। বেঁচে থাকলে কোন দিকে আজ আপনি? গাদ্দাফির পক্ষে না কি মুক্তিকামী জনতার কাতারে? শেষের পক্ষের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে। তাই তো আমার আশঙ্কাটা বেড়ে যাচ্ছে অনেক।
যা-ই হোক, সবুজের কথা বলছিলাম। ওই ঘটনার পর আমি লিবিয়ায় অবস্থানকালে কোনো দিন ‘সবুজ’ শব্দ উচ্চারণ করার মতো সাহস দেখাইনি আর। হ্যাঁ, সেই সঙ্গে মনে পড়ছে, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়, কেন? ‘গাদ্দাফি’ উচ্চারণ করে বাংলায় প্রশংসা করলে ভুল বোঝার আশঙ্কা ছিল একজন লিবীয়র পক্ষে। সেই ভুল বোঝার কারণে যেকোনো সময় দরজায় বিএমডব্লিউ গাড়ি এসে হাজিরও হতে পারত। সেই ভয়ে আমরা (সব বিদেশিই) ওই নেতার নাম উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকতাম। দেয়ালেরও কান আছে—কথাটা নাকি আপনাদের দেশে বাস্তব সত্য। শুনেছি আপনারা নিজেরাও ভুলে তাঁর প্রশংসাও করতেন না, ‘কী দরকার বাবা, ওই ধরনের বিপদে পড়ার—খারাপ তো নেই আমরা।’ আসলে আপনারা যত সুখেই থাকুন না কেন, সব সময় থাকতেন তটস্থ। কারণ, ওই যে দশজনে একজন সরকারি চর!
চিঠিটা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের এই ঘোর বিপর্যয়ের সময় বারবার ভেসে উঠছে সেই সব মুখ—আলী দেরেবি, খলিফা মাউই, আলী হোসেন, মাবরুক, আব্দুল মজিদ, রামাদান, আরও কত না ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর। তাদের শান্তির নীড়ে আজ বাজপাখির হানা, সেই সঙ্গে মুক্তির আহ্বান। কোন দিকে যাবেন আপনারা? সত্যিই এক মহা দোলাচলে পড়েছেন, দাখিল সাহেব।
সেই যে আমরা ওয়াটার রিজারভুয়ারের ফাউন্ডেশন ঢালাই করছিলাম যে রাতে, সেই রাতের কথা কি মনে আছে? জুন বা জুলাই। দিনের বেলায় ঢালাই করা অসম্ভব ছিল। কারণ বাতাসে আর্দ্রতা ছিল অতি অল্প। ঢালাই করার সঙ্গে সঙ্গেই সূর্যের খরতাপে কংক্রিট শুকিয়ে ফাটল ধরে যায়। তাই রাতেই ঢালাই হচ্ছিল। সেদিন আপনি ত্রিপোলি থেকে এসেছিলেন নিজে দাঁড়িয়ে কাজের শুরুটা দেখবেন বলে।
শেষ রাতের দিকে দুজনই ছিলাম একটু শ্রান্ত। চায়ের খোঁজ করতেই বাঙালি শ্রমিক ভাইদের কেউ একজন এগিয়ে এলেন দুকাপ চা নিয়ে। কাপ দুটো হাতে নিয়ে দুলে উঠে হাঁটতে লাগলাম ফাঁকা পিচঢালা রাস্তাটা দিয়ে। ভোরের বাতাস বইতে শুরু করেছে তখন। দূরে কোথায় যেন মোরগ ডেকে উঠল। পাখির কিচিরমিচির শব্দও ভেসে আসতে শুরু করেছিল তখন। আপনাদের দেশটা সত্যিই দারুণ সুন্দর এবং শান্তির ঘর। সত্যিকার ‘দারুস সালাম’—মুগ্ধ হয়ে বলেছিলাম আমি।
আপনি মৃদু হেসে উত্তর করেছিলেন, ‘নো, মি. হায়াত! ইউ আর রং। এটা শান্তির ঘর নয়। ওপরে শান্তি, ভেতরে জ্বলছে আগুন। কালরাতে দেখেননি, টেলিভিশনে কতগুলো মানুষকে জনসমক্ষে বিচার করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো?’
‘হ্যাঁ, সে রকমই দেখেছিলাম মনে হয়। বুঝতে পারিনি কিছু। তারা কি দুর্নীতিবাজ?’
‘না, তারা দুর্নীতিবাজ নয়। তারা প্রতি-বিপ্লবী। জানো, এ দেশে প্রতি মাসে একটা করে ক্যু হয়, আর শ শ লোককে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়।’
সত্যি বলেছিলেন কি মিথ্যা বলেছিলেন জানি না, কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, দাখিল সাহেব।’
জানি না, সেদিন আপনার কী হয়েছিল। মনের সব কথা উজাড় করছিলেন একের পর এক। সবশেষে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে বলছি মি. হায়াত, দিস আলফাতা ইজ নট আবাদান। এর শেষ একদিন হবেই। জানি না দেখে যেতে পারব কি না। বাট ইট মাস্ট এন্ড।’
কথাগুলো আজ ভীষণভাবে বাজছে আমার কানে। চোখে ভেসে উঠছে সেই পরিচিত স্থানগুলো। ত্রাবুলাস, আজ-যাওয়াবিয়াহ্, বির আত তাবফাস, সিরত, সাকাতা, গারিয়ান, মিসরাতা, মিজদাহ, আদিজিয়া, আরও কত কত জায়গা। ভেসে উঠছে সেই সব দেখা দৃশ্য। টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিদিন আপনাদের মহান নেতা এবং তাঁর গুণগ্রাহীদের কণ্ঠে উলুধ্বনির সঙ্গে আলফাতাহ আবাদানের বজ্রকণ্ঠ। সব মনে পড়ছে।
সেসব কি সত্যিই থেমে যাবে? যেমন দেখতে চেয়েছিলেন আপনি? আমার মনে এখন একটা প্রশ্নই জাগছে, ‘আলফাতা আবাদান’ যদি থামেও, সেটা কে থামাবে—মুক্তিকামী লিবীয় জনসাধারণ, নাকি আগ্রাসী পশ্চিমা বাহিনী? যারা দেশে দেশে কায়েমি স্বার্থ অন্বেষণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালে?
আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কামনা করি, আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হোক। লিবিয়া মুক্তির আলো দেখুক—নিজেরা লড়ে আদায় করুক স্বাধীনতা। কোনো স্বার্থবাদী শক্তির সহায়তায় নয়। মনে বিশ্বাস রাখুন। কোনো অন্যায্য আলফাতাই আবাদান হয় না। ভালো থাকুন, দাখিল সাহেব, সুস্থ থাকুন। জয় হোক আপনাদের। মাআ সালামা (শান্তিতে থাকুন)।
ঢাকা, ২৪ মার্চ ২০১১
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments