স্থায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার-পাঠ্যবইয়ে ভুল

আমরা বলি, নোট বই-গাইড বইয়ে ভুল থাকে, তাই পাঠ্যবইকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকেরা সেই পাঠ্যবইয়ের ভিত্তিতেই শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করেন। কিন্তু যদি সেই পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে আর শিক্ষকেরাই বা কী শেখাবেন।


দুঃখজনক ব্যাপার হলো, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অজস্র ভুল রয়েছে। বিশেষত, বিজ্ঞান বইয়ের কিছু ভুলের বিবরণ সম্প্রতি প্রথম আলোয় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। দেখা গেছে, শুধু তথ্যগত ভুল নয়, দৃষ্টিভঙ্গিরও ভুল রয়েছে। অথচ বিজ্ঞান শিক্ষায় সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো বড় ব্যাপার। ভুল দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণত পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা ও কুসংস্কারের জন্ম দেয়। আর বিজ্ঞানের প্রধান কাজ কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ও উন্নত চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানো। পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকলে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।
অষ্টম শ্রেণীর সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ে বলা হয়েছে, বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পিসার হেলানো টাওয়ার থেকে একটি পরীক্ষা করে দেখান যে পড়ন্ত বস্তু একই সময়ে মাটিতে পড়ে। এটা বহুল প্রচলিত একটি কাহিনি। কিন্তু এ কাহিনির ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলে সবাই জানেন, বিজ্ঞানীরাও জানিয়েছেন। তাই এ রকম একটি কাহিনি বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর নামে উল্লেখ করা ঠিক হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের ভুল শেখানো হয়। এ রকম আরও প্রচলিত কাহিনি আছে। যেমন—বিজ্ঞানী নিউটন গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে মহাকর্ষ বল আবিষ্কার করেন। এটাও অষ্টম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ে লেখা হয়েছে। অথচ হঠাৎ করে মহাকর্ষ বল আবিষ্কৃত হয়নি। এটা আপেল পড়তে দেখেই আবিষ্কারের বিষয় নয়। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পেছনে থাকে বহু বছরের ধারাবাহিক গবেষণা ও অনুসন্ধান। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের এই মূল বিষয়টি সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা কঠিন। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অসম্পূর্ণ আরও অনেক তথ্য ও কথা স্কুলের পাঠ্যবইয়ে রয়েছে।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, ১৯৯৬ সাল থেকে এসব বই চলছে। ইতিমধ্যে বইগুলো কয়েকবার সংশোধিত, পরিমার্জিত ও পুনর্মুদ্রিতও হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ ভুল থেকে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো যে ভুল এবং এগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন, সেই উপলব্ধিরই অভাব ছিল। তা না হলে বছরের পর বছর এই সব ভুল নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চলছে কীভাবে? এসব ভুল শিক্ষা লাভ করে যাঁরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁরা দেশকে কীভাবে এগিয়ে নেবেন? এর দায় তো বহন করতে হবে এনসিটিবিকে, যাঁদের নির্লিপ্ত মনোভাবের জন্য পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য ও কথা ছাপা হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, সব পাঠ্যবইয়ের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ, কিন্তু কাজটা এককালীন নয়। একটি স্থায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার। প্রয়োজনে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখতে হবে। যেহেতু বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের কারণে পুরোনো অনেক বিষয় সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাই ওই স্থায়ী কমিটি প্রতিবছর বসে সর্বশেষ আবিষ্কারগুলো পর্যালোচনা করে নতুন সংযোজন-বিয়োজনের সিদ্ধান্ত নেবে। ভুল কথা কোনোভাবেই শেখানো যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.