সময়ের প্রতিবিম্ব-শজারু ওগরানো যায় না, গেলাও যায় না by এবিএম মূসা
রোগমুক্তির দেড় মাস পর গত সপ্তাহে প্রথম আলোয় বর্তমান সরকারের ইউনূস-বিরাগ নিয়ে কলাম লেখা পুনরারম্ভ করেছিলাম। প্রতিবেদনের সূচনা করেছিলাম ক্রিকেট-জ্বরাক্রান্ত উদ্দাম বাঙালি কিশোর-তরুণদের নিয়ে। তবে মূল উপাত্ত ছিল বর্তমান সরকারের ইউনূস-হেনস্তা।
এবারের লেখাটিরও সূচনা হলো সেই ক্রিকেট-ব্যাধির রোগের আপাত উপশম নিয়ে। মনে পড়ল বহুদিন আগে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার নিয়মাদির কথা। তখন ম্যালেরিয়া-টাইফয়েড হলে লেপ-কম্বল-কাঁথা দিয়ে রোগীর গায়ের ঘাম ঝরানো হতো। একবার আমার স্ত্রী লিভারসংক্রান্ত রোগে ভুগছিলেন। নানা ধরনের ওষুধপত্র এমনকি তখনকার প্রায় অজানা অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন প্রয়োগে ১০৪-০৫ ডিগ্রির তাপমাত্রা নিচে নামছে না। তখনকার একমাত্র মুসলিম নারী চিকিৎসক জোহরা কাজীকে বাসায় নিয়ে এলাম। তিনি এসেই রোগীকে বারান্দায় এনে চারদিকে পর্দা দিয়ে ঢাকলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাথায় হড়হড় করে দুই কলসি ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলেন।
রোগীর তাপমাত্রা স্বাভাবিকে নেমে এল। স্ত্রী দুই-চার দিনের মধ্যে অনেকখানি সুস্থ হয়ে তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এলেন। আমাদের ঔপন্যাসিক কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অসংখ্য ক্রিকেটবোদ্ধা এবং সর্বোপরি কতিপয় কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণের অগণিত তেজস্বী ক্রিকেটার গত দেড় মাস লেখালেখি, কথা আর শব্দের খেলায় অনেককেই ক্রিকেট-জ্বরে ভোগাচ্ছিলেন। সেই ক্রিকেট-জ্বরাক্রান্তদের মাথায়ও এমনি করে দুই কলস পানি ঢেলে দিল প্রথমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তারপর দক্ষিণ আফ্রিকা। আমার আশা ও বিশ্বাস, সেই জ্বরের উপশমের পর উন্মাদনামুক্ত ও উচ্ছ্বাসবিহীন পরিবেশে বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা আমার রোগমুক্ত স্ত্রীর মতোই আবার স্বাভাবিক ক্রিকেট জীবনে ফিরে সাম্প্রতিককালের গৌরবান্বিত দিনগুলোতে ফিরে যাবেন।
ক্রিকেট আপাতত ঘুরে দাঁড়াক, কীভাবে? এ নিয়ে হয়তো প্রথম আলোর ‘খেলার’ পাতায় ক্রিকেটের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু লিখব। এখন গত সপ্তাহের একই ধারায় নোবেল লরেট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-সংক্রান্ত যে ঝঞ্ঝাট সৃষ্টি হয়েছিল, যা ‘সমঝোতার’ প্রস্তাবের নতুন মাত্রা পেয়েছে, তা নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের প্রতিবেদনটি লিখব। মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সরকারের উচ্চতম মহল যে আচরণ করেছেন, তার যৌক্তিকতা নিয়ে দেশে আলোচনায় সাময়িক বিরতি ঘটিয়েছে নতুন একটি মাত্রা, যার নাম ‘সমঝোতা’। সরাসরি বলতে হয়, ইউনূস নিয়ে যাঁরা ঝঞ্ঝাট বাধিয়েছেন, তাঁরা এখন নিজেরা গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসতে চান। বস্তুত ইতিপূর্বে দেশে ফিরে এই কয় দিন দেশের গণমাধ্যমের রহস্যজনক নীরবতা ও বিদেশের সর্বমহলের উৎকণ্ঠার কারণটির খোঁজখবর নিয়েছি। দুই ধরনের উত্তর পেয়েছি। এক. সরকারের একটি বিশেষ মহল থেকে অধ্যাপক ইউনূস বিষয়ে ‘স্বাধীন’ গণমাধ্যমে আলোচনার ওপর একটি কালো পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথম আলো ও চ্যানেল আই, বাংলাভিশন, আরটিভি এবং আরও দু-একটি ব্যতীত অন্যান্য বেসরকারি সম্প্রচার কর্তৃপক্ষের কাছে ইউনূস-আলোচনা ছিল একটি ট্যাবু। তার পরও কোনো একটি চ্যানেল বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন আলোচনা করতে চেয়েছিল। শুনলাম, তারা আরেকটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের বিরাগ মনোভাবের সমালোচনায় অনেকে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এবার ইউনূস-হেনস্তার তথা ইউনূস-মাইনাস পদক্ষেপে সরকারের যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য পাওয়া দুষ্কর মনে হলো। এ সম্পর্কে পাঠকনন্দিতসাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার প্রতিবেদনটি (১৭ মার্চ, সংখ্যা ৪) বেশ উপভোগ্য মনে হয়েছে। মোর্তোজা কয়েকটি চ্যানেলের আলোচনামূলক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। তাঁর সম্পাদিতসাপ্তাহিকে তিনি লিখেছেন, আরটিভির টক শো ‘আওয়ার ডেমোক্রেসির’ প্রথম দু-তিনটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আলোচকেরা সরকারের ইউনূস-হেনস্তার সমালোচনা করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই টিভি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামীভাবাপন্ন হিসেবে পরিচিত, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জানালেন এসব ব্যক্তিত্বের কমপক্ষে ১০-১২ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। কিন্তু তাঁদের কেউ অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হলেন না। এ সম্পর্কে এসব টক শোর দুজন সঞ্চালক জানালেন কেউ ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে, কেউ সরাসরি ‘না’ বলে দিলেন। কেউ টেলিফোনে বক্তব্য দিলেন কিন্তু সাবধান করে দিলেন প্রচার করা যাবে না। অদ্ভুত ব্যাপার নয় কি? দলের অতিবড় স্তাবক যাঁরা টেলিভিশন মাইক পেলেই অথবা জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার সব কাজের নিরন্তর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁরা সবাই অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি আচরণের বিষয়ে প্রিয় নেত্রীর গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলতে মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন! বক্তব্যটির অধিকতর ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কী?
তবে হ্যাঁ, জাতীয় সংসদে দু-চারজন অবশ্য অনুপস্থিত ব্যক্তিটিকে নিয়ে কিছু অশোভন মন্তব্য করেছেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তা করুন, অবাক হইনি। কারণ, আমাদের গণতন্ত্রচর্চার ‘পীঠস্থান’ জাতীয় সংসদে এসবেরই চর্চা হচ্ছে। তাই বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার সম্মানীয়া অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর মুখ থেকে অগ্নিনিঃসৃত হয়ে নোবেল লরেট সম্পর্কে যে কথাটি বেরিয়ে এল, সেটি টেলিভিশনের প্রচারণায় শুনে মর্মাহত হয়েছিলাম। মনে পড়ল, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ মতিয়া চৌধুরীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই ছবি নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছাপা হয়েছিল। সুদূর নিউইয়র্ক থেকে আমার একাত্তরের বন্ধু সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ সম্মানধারী পুলিৎজার পদকপ্রাপ্ত সিডনি শেনবার্গ টেলিফোন করেছিলেন, ‘মতিয়া চৌধুরী কে?’ এ নিয়ে তখন এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম, ছাপা হয়েছিল দেশ ও বিদেশের পত্রিকায়। অধ্যাপক ইউনূস প্রসঙ্গে অগ্নিকন্যার মুখনিঃসৃত অনভিপ্রেত মন্তব্যটি আমায় ব্যথিত করেছে। মতিয়া প্রসঙ্গ শেষ করার আগে একটি কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছিলাম না। মতিয়া আপা যখন অধ্যাপক ইউনূসের দাম্পত্য জীবন নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করছিলেন, একটু দূরের আসনে উপবিষ্ট তাঁর মহাজোটসঙ্গী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন বোধহয় মুচকি হাসছিলেন। অনুমানমাত্র। টেলিভিশনে দেখিনি।
দেশের মানুষের মধ্যে অধ্যাপক ইউনূসের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আরও অনেক লিখেছেন বিশিষ্টজনেরা। মোর্তোজারসাপ্তাহিক একটি সংস্করণই ইউনূস দিয়ে ভরে ফেলেছে। সম্পাদক নিজস্ব আলোচনায় আমার গত সপ্তাহের লেখাটিও পর্যালোচনা করেছেন। একটি প্রশ্ন করেছেন, ‘মূসা ভাই, আপনি লিখেছেন, ইউনূস-হেনস্তার কারণ জানেন কিন্তু বলেননি। এখন বলুন।’ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার এক দিন পর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, নোবেল প্রাইজটি পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার পাওয়া উচিত ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার মনে হচ্ছে, মোর্তোজা তাঁর লেখার উপসংহারে নিজেই আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, মূসা ভাইয়ের আসল কারণ কী মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল দিয়ে দিয়েছেন।’ মোর্তোজাকে বলছি, তা যে নয়। পরবর্তী প্যারায় একটুখানি আভাস পেতে পারেন।
এরই মাঝে একমাত্র মোহাম্মদ আরাফাত আমার মতে, একটি সুদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস নাকি টাকা দিয়ে বিদেশে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন।’ তবু ভালো যে বলেননি টাকা দিয়ে নোবেল কমিটিকে কিনে নিয়েছিলেন। তবে একটি কথা বলে রাখি, কোনো তরফ থেকে অন্য কারও জন্য এমন একটি প্রচেষ্টা যে হয়নি, এমন কথা হলফ করে বলতে পারবেন না। মোর্তোজার অনুমান ঠিক নয় এই কারণে বলছি, সেই প্রচেষ্টার ব্যর্থতার ক্ষোভ থেকেই আসিফ নজরুল উল্লিখিত ‘মাইনাস ইউনূস’ ফর্মুলার উদ্ভব। আমার সূত্রমতে, তারাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের উদ্ভট প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কৈফিয়ত দিতে অধ্যাপক ইউনূসকে বলির পাঁঠা বানিয়ে বাংলাদেশ ও তাঁর জনগণকে বিশ্বের দরবারে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছেন। সমঝোতার জন্য সমগ্র জাতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করিয়েছেন। আশা করি, গোলাম মোর্তোজা তাঁর প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন জবাব পেয়েছেন। যা-ই হোক, সাপ্তাহিকে বিভিন্ন সুধীজনের মননশীল সব আলোচনার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্যটি খুঁজে পেলাম। পরম শ্রদ্ধেয় আইনজীবী রফিক-উল হক লিখেছেন, ‘ইউনূসকে ছোট করলে! তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি ছোট হলে।’ রফিক-উল হকের কথাটি কতখানি নির্মম সত্য, মার্কিন কূটনীতিক তিন দিনের সফরে তা জানিয়ে দিলেন।
কী অবাক ব্যাপার, এমনটি আগে তো কখনো ঘটেনি। একটিমাত্র নাগরিকের প্রতি, যৌক্তিক-অযৌক্তিক আচরণ, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে এমন প্রভাব, আমাদের বহির্বাণিজ্য তথা রপ্তানিনির্ভর আয়ের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়েছে। অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে একজন মাত্র বাংলাদেশির। বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রপ্রধান বিস্মিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, একটি দেশ তাদের নোবেল লরেট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘কংগ্রেসনা অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া ব্যক্তিকে হেনস্তা করার খেসারত দিতে হচ্ছে জাতীয় মান-সম্মান খুইয়ে? দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে এক প্রবাসী বাঙালি চিকিৎসক আত্মীয় জানিয়েছিলেন সেখানকার সুধীমহল বাংলাদেশ বলতে চেনে ক্রিকেট দল, গরিব আফ্রিকানদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের উদ্যোক্তা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে। আর জানে এক লিটার পানি, এক চামচ চিনি ও এক চিমটে লবণ দিয়ে বানানো কলেরা-ডায়রিয়া নির্মূলকারী আইসিডিডিআরবি, যাদের গবেষণার ফসলে অতীতের বসন্ত রোগের অনুসরণে কলেরা-ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। অধ্যাপক ইউনূসের হেনস্তা কি সেই পরিচিতিকে কলঙ্কিত করল না?
এত সব যখন লিখছি, তখন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশে এলেন। পরোক্ষে ধমক দিয়ে গেলেন, যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য এত লজ্জাকর, বিস্তারিত আলোচনা করতে মন চায় না। প্রথম আলোয় এতদসম্পর্কীয় কূটনৈতিক প্রতিবেদনে বিষয়টি সুরাহার কথায় লিখেছেন, সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির (গ্রামীণ ব্যাংক-ইউনূস জটিলতা) সুরাহা সম্ভব। বুধবারের প্রথম আলোয় পড়লাম, ব্লেক সরাসরি সে কথাই বলেছেন। ‘সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।’ না হলে কী হবে, সেই অপমানজনক কথাটিও পরদিন সংবাদ সম্মেলনে খোলসা করে বলেছেন।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের আচরণ সম্পর্কে আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকেরা আর বিনিয়োগ বোর্ড কী বলবে, জানি না। ব্লেকের সফরসঙ্গী বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট উলফেনসন বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস-সরকার টানাপোড়েন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। তাঁরা দুজনই বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বিষয়টির একটি সম্মানজনক সমঝোতা হওয়া উচিত। আমিও কায়মনোবাক্যে তা-ই কামনা করি। প্রশ্ন হচ্ছে, কী হতে পারে সেই সমঝোতা? বুধবারের সব দৈনিকে সম্ভাব্য সমঝোতার খবরটি প্রকাশের পর দু-চারজন টেলিফোনে ও ই-মেইলে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। উল্লিখিত পত্রিকায় অবশ্য লিখেছে, ‘ড. ইউনূসকে আগে তাঁর মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।’ যাঁরা আমাকে টেলিফোনে মতামত জানিয়েছেন তাঁরা বলেছেন, তাঁকে আগে পূর্ণ মর্যাদায় স্বপদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অতঃপর তিনি হয়তো দেশের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা রক্ষায় তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে মামলা প্রত্যাহার করে স্বেচ্ছায় অবসর নেবেন। একজন একান্ত বিশ্বাসভাজনও সমঝোতার ব্যাপারে অধ্যাপক ইউনূসের এই মনোভাবের আভাস দিয়েছেন।
এসব নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল কী করবেন জানি না, তবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল (ষড়যন্ত্রকারী বলব না) আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ও জাতির গলায় একটি শজারু ঢুকিয়ে দিয়েছে? এটি তারা গেলাতে পারেনি কিন্তু ওগরানো যাবে কীভাবে? তা নিয়ে আমি ভাবছি, আপনারাও ভাবুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
রোগীর তাপমাত্রা স্বাভাবিকে নেমে এল। স্ত্রী দুই-চার দিনের মধ্যে অনেকখানি সুস্থ হয়ে তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এলেন। আমাদের ঔপন্যাসিক কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অসংখ্য ক্রিকেটবোদ্ধা এবং সর্বোপরি কতিপয় কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণের অগণিত তেজস্বী ক্রিকেটার গত দেড় মাস লেখালেখি, কথা আর শব্দের খেলায় অনেককেই ক্রিকেট-জ্বরে ভোগাচ্ছিলেন। সেই ক্রিকেট-জ্বরাক্রান্তদের মাথায়ও এমনি করে দুই কলস পানি ঢেলে দিল প্রথমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তারপর দক্ষিণ আফ্রিকা। আমার আশা ও বিশ্বাস, সেই জ্বরের উপশমের পর উন্মাদনামুক্ত ও উচ্ছ্বাসবিহীন পরিবেশে বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা আমার রোগমুক্ত স্ত্রীর মতোই আবার স্বাভাবিক ক্রিকেট জীবনে ফিরে সাম্প্রতিককালের গৌরবান্বিত দিনগুলোতে ফিরে যাবেন।
ক্রিকেট আপাতত ঘুরে দাঁড়াক, কীভাবে? এ নিয়ে হয়তো প্রথম আলোর ‘খেলার’ পাতায় ক্রিকেটের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু লিখব। এখন গত সপ্তাহের একই ধারায় নোবেল লরেট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-সংক্রান্ত যে ঝঞ্ঝাট সৃষ্টি হয়েছিল, যা ‘সমঝোতার’ প্রস্তাবের নতুন মাত্রা পেয়েছে, তা নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের প্রতিবেদনটি লিখব। মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সরকারের উচ্চতম মহল যে আচরণ করেছেন, তার যৌক্তিকতা নিয়ে দেশে আলোচনায় সাময়িক বিরতি ঘটিয়েছে নতুন একটি মাত্রা, যার নাম ‘সমঝোতা’। সরাসরি বলতে হয়, ইউনূস নিয়ে যাঁরা ঝঞ্ঝাট বাধিয়েছেন, তাঁরা এখন নিজেরা গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসতে চান। বস্তুত ইতিপূর্বে দেশে ফিরে এই কয় দিন দেশের গণমাধ্যমের রহস্যজনক নীরবতা ও বিদেশের সর্বমহলের উৎকণ্ঠার কারণটির খোঁজখবর নিয়েছি। দুই ধরনের উত্তর পেয়েছি। এক. সরকারের একটি বিশেষ মহল থেকে অধ্যাপক ইউনূস বিষয়ে ‘স্বাধীন’ গণমাধ্যমে আলোচনার ওপর একটি কালো পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথম আলো ও চ্যানেল আই, বাংলাভিশন, আরটিভি এবং আরও দু-একটি ব্যতীত অন্যান্য বেসরকারি সম্প্রচার কর্তৃপক্ষের কাছে ইউনূস-আলোচনা ছিল একটি ট্যাবু। তার পরও কোনো একটি চ্যানেল বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন আলোচনা করতে চেয়েছিল। শুনলাম, তারা আরেকটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের বিরাগ মনোভাবের সমালোচনায় অনেকে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এবার ইউনূস-হেনস্তার তথা ইউনূস-মাইনাস পদক্ষেপে সরকারের যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য পাওয়া দুষ্কর মনে হলো। এ সম্পর্কে পাঠকনন্দিতসাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার প্রতিবেদনটি (১৭ মার্চ, সংখ্যা ৪) বেশ উপভোগ্য মনে হয়েছে। মোর্তোজা কয়েকটি চ্যানেলের আলোচনামূলক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। তাঁর সম্পাদিতসাপ্তাহিকে তিনি লিখেছেন, আরটিভির টক শো ‘আওয়ার ডেমোক্রেসির’ প্রথম দু-তিনটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আলোচকেরা সরকারের ইউনূস-হেনস্তার সমালোচনা করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই টিভি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামীভাবাপন্ন হিসেবে পরিচিত, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জানালেন এসব ব্যক্তিত্বের কমপক্ষে ১০-১২ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। কিন্তু তাঁদের কেউ অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হলেন না। এ সম্পর্কে এসব টক শোর দুজন সঞ্চালক জানালেন কেউ ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে, কেউ সরাসরি ‘না’ বলে দিলেন। কেউ টেলিফোনে বক্তব্য দিলেন কিন্তু সাবধান করে দিলেন প্রচার করা যাবে না। অদ্ভুত ব্যাপার নয় কি? দলের অতিবড় স্তাবক যাঁরা টেলিভিশন মাইক পেলেই অথবা জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার সব কাজের নিরন্তর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁরা সবাই অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি আচরণের বিষয়ে প্রিয় নেত্রীর গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলতে মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন! বক্তব্যটির অধিকতর ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কী?
তবে হ্যাঁ, জাতীয় সংসদে দু-চারজন অবশ্য অনুপস্থিত ব্যক্তিটিকে নিয়ে কিছু অশোভন মন্তব্য করেছেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তা করুন, অবাক হইনি। কারণ, আমাদের গণতন্ত্রচর্চার ‘পীঠস্থান’ জাতীয় সংসদে এসবেরই চর্চা হচ্ছে। তাই বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার সম্মানীয়া অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর মুখ থেকে অগ্নিনিঃসৃত হয়ে নোবেল লরেট সম্পর্কে যে কথাটি বেরিয়ে এল, সেটি টেলিভিশনের প্রচারণায় শুনে মর্মাহত হয়েছিলাম। মনে পড়ল, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ মতিয়া চৌধুরীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই ছবি নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছাপা হয়েছিল। সুদূর নিউইয়র্ক থেকে আমার একাত্তরের বন্ধু সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ সম্মানধারী পুলিৎজার পদকপ্রাপ্ত সিডনি শেনবার্গ টেলিফোন করেছিলেন, ‘মতিয়া চৌধুরী কে?’ এ নিয়ে তখন এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম, ছাপা হয়েছিল দেশ ও বিদেশের পত্রিকায়। অধ্যাপক ইউনূস প্রসঙ্গে অগ্নিকন্যার মুখনিঃসৃত অনভিপ্রেত মন্তব্যটি আমায় ব্যথিত করেছে। মতিয়া প্রসঙ্গ শেষ করার আগে একটি কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছিলাম না। মতিয়া আপা যখন অধ্যাপক ইউনূসের দাম্পত্য জীবন নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করছিলেন, একটু দূরের আসনে উপবিষ্ট তাঁর মহাজোটসঙ্গী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন বোধহয় মুচকি হাসছিলেন। অনুমানমাত্র। টেলিভিশনে দেখিনি।
দেশের মানুষের মধ্যে অধ্যাপক ইউনূসের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আরও অনেক লিখেছেন বিশিষ্টজনেরা। মোর্তোজারসাপ্তাহিক একটি সংস্করণই ইউনূস দিয়ে ভরে ফেলেছে। সম্পাদক নিজস্ব আলোচনায় আমার গত সপ্তাহের লেখাটিও পর্যালোচনা করেছেন। একটি প্রশ্ন করেছেন, ‘মূসা ভাই, আপনি লিখেছেন, ইউনূস-হেনস্তার কারণ জানেন কিন্তু বলেননি। এখন বলুন।’ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার এক দিন পর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, নোবেল প্রাইজটি পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার পাওয়া উচিত ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার মনে হচ্ছে, মোর্তোজা তাঁর লেখার উপসংহারে নিজেই আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, মূসা ভাইয়ের আসল কারণ কী মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল দিয়ে দিয়েছেন।’ মোর্তোজাকে বলছি, তা যে নয়। পরবর্তী প্যারায় একটুখানি আভাস পেতে পারেন।
এরই মাঝে একমাত্র মোহাম্মদ আরাফাত আমার মতে, একটি সুদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস নাকি টাকা দিয়ে বিদেশে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন।’ তবু ভালো যে বলেননি টাকা দিয়ে নোবেল কমিটিকে কিনে নিয়েছিলেন। তবে একটি কথা বলে রাখি, কোনো তরফ থেকে অন্য কারও জন্য এমন একটি প্রচেষ্টা যে হয়নি, এমন কথা হলফ করে বলতে পারবেন না। মোর্তোজার অনুমান ঠিক নয় এই কারণে বলছি, সেই প্রচেষ্টার ব্যর্থতার ক্ষোভ থেকেই আসিফ নজরুল উল্লিখিত ‘মাইনাস ইউনূস’ ফর্মুলার উদ্ভব। আমার সূত্রমতে, তারাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের উদ্ভট প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কৈফিয়ত দিতে অধ্যাপক ইউনূসকে বলির পাঁঠা বানিয়ে বাংলাদেশ ও তাঁর জনগণকে বিশ্বের দরবারে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছেন। সমঝোতার জন্য সমগ্র জাতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করিয়েছেন। আশা করি, গোলাম মোর্তোজা তাঁর প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন জবাব পেয়েছেন। যা-ই হোক, সাপ্তাহিকে বিভিন্ন সুধীজনের মননশীল সব আলোচনার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্যটি খুঁজে পেলাম। পরম শ্রদ্ধেয় আইনজীবী রফিক-উল হক লিখেছেন, ‘ইউনূসকে ছোট করলে! তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি ছোট হলে।’ রফিক-উল হকের কথাটি কতখানি নির্মম সত্য, মার্কিন কূটনীতিক তিন দিনের সফরে তা জানিয়ে দিলেন।
কী অবাক ব্যাপার, এমনটি আগে তো কখনো ঘটেনি। একটিমাত্র নাগরিকের প্রতি, যৌক্তিক-অযৌক্তিক আচরণ, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে এমন প্রভাব, আমাদের বহির্বাণিজ্য তথা রপ্তানিনির্ভর আয়ের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়েছে। অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে একজন মাত্র বাংলাদেশির। বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রপ্রধান বিস্মিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, একটি দেশ তাদের নোবেল লরেট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘কংগ্রেসনা অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া ব্যক্তিকে হেনস্তা করার খেসারত দিতে হচ্ছে জাতীয় মান-সম্মান খুইয়ে? দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে এক প্রবাসী বাঙালি চিকিৎসক আত্মীয় জানিয়েছিলেন সেখানকার সুধীমহল বাংলাদেশ বলতে চেনে ক্রিকেট দল, গরিব আফ্রিকানদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের উদ্যোক্তা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে। আর জানে এক লিটার পানি, এক চামচ চিনি ও এক চিমটে লবণ দিয়ে বানানো কলেরা-ডায়রিয়া নির্মূলকারী আইসিডিডিআরবি, যাদের গবেষণার ফসলে অতীতের বসন্ত রোগের অনুসরণে কলেরা-ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। অধ্যাপক ইউনূসের হেনস্তা কি সেই পরিচিতিকে কলঙ্কিত করল না?
এত সব যখন লিখছি, তখন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশে এলেন। পরোক্ষে ধমক দিয়ে গেলেন, যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য এত লজ্জাকর, বিস্তারিত আলোচনা করতে মন চায় না। প্রথম আলোয় এতদসম্পর্কীয় কূটনৈতিক প্রতিবেদনে বিষয়টি সুরাহার কথায় লিখেছেন, সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির (গ্রামীণ ব্যাংক-ইউনূস জটিলতা) সুরাহা সম্ভব। বুধবারের প্রথম আলোয় পড়লাম, ব্লেক সরাসরি সে কথাই বলেছেন। ‘সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।’ না হলে কী হবে, সেই অপমানজনক কথাটিও পরদিন সংবাদ সম্মেলনে খোলসা করে বলেছেন।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের আচরণ সম্পর্কে আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকেরা আর বিনিয়োগ বোর্ড কী বলবে, জানি না। ব্লেকের সফরসঙ্গী বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট উলফেনসন বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস-সরকার টানাপোড়েন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। তাঁরা দুজনই বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বিষয়টির একটি সম্মানজনক সমঝোতা হওয়া উচিত। আমিও কায়মনোবাক্যে তা-ই কামনা করি। প্রশ্ন হচ্ছে, কী হতে পারে সেই সমঝোতা? বুধবারের সব দৈনিকে সম্ভাব্য সমঝোতার খবরটি প্রকাশের পর দু-চারজন টেলিফোনে ও ই-মেইলে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। উল্লিখিত পত্রিকায় অবশ্য লিখেছে, ‘ড. ইউনূসকে আগে তাঁর মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।’ যাঁরা আমাকে টেলিফোনে মতামত জানিয়েছেন তাঁরা বলেছেন, তাঁকে আগে পূর্ণ মর্যাদায় স্বপদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অতঃপর তিনি হয়তো দেশের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা রক্ষায় তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে মামলা প্রত্যাহার করে স্বেচ্ছায় অবসর নেবেন। একজন একান্ত বিশ্বাসভাজনও সমঝোতার ব্যাপারে অধ্যাপক ইউনূসের এই মনোভাবের আভাস দিয়েছেন।
এসব নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল কী করবেন জানি না, তবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল (ষড়যন্ত্রকারী বলব না) আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ও জাতির গলায় একটি শজারু ঢুকিয়ে দিয়েছে? এটি তারা গেলাতে পারেনি কিন্তু ওগরানো যাবে কীভাবে? তা নিয়ে আমি ভাবছি, আপনারাও ভাবুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments