এমপিদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ তবু ব্যবস্থা নেই-শিগগিরই বসবেন হাসিনা by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য ও পাভেল হায়দার চৌধুরী

আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সবারই ক্ষোভ দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপর। ক্ষমতাসীন দলের সব সভায়ই তৃণমূল নেতারা বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন দলীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে। তাঁদের অভিযোগ, এমপিরা এলাকায় নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন, দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেন না, মূল্যায়ন করেন না নেতা-কর্মীদের।


কেউ কেউ বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। কেন্দ্রীয় নেতাদেরও অনেকেই ক্ষুব্ধ দলীয় এমপিদের ওপর। এর পরও কেন্দ্র থেকে এ পর্যন্ত একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষ করার পর শিগগিরই দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষ হলে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সভায় এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই-বাছাই হবে। তিনি বলেন, 'শেখ হাসিনা মাঠপর্যায় থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে থাকেন সব সময়। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থাও নেন তিনি। সেটা হয়তো প্রকাশ্যে হয় না বলে কেউ জানে না।' আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্র থেকে অভিযুক্ত সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে দেওয়া হবে। সতর্ক করার পরও যদি তাঁরা আচরণ পরিবর্তন না করেন এবং তৃনমূলের সঙ্গে যোগাযোগ না বাড়ান তবে তাঁদের পরে মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় দলীয় এমপিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। এর ভিত্তিতে গত ২৯ জানুয়ারি সংসদীয় দলের বৈঠকে এমপিদের সতর্ক করে দেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। সেই বৈঠকে জানানো হয়, সব সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ড যাচাই-বাছাই শেষ হলে শেখ হাসিনা ২৫ জনের একেকটি দল করে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও খুশি নন দলের অনেক সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ডে। জানা গেছে, সংসদীয় দলের সভা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সভাসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের শুধু সতর্কই করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে সংসদ সদস্যদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। আমলনামা খতিয়ে দেখা কিংবা পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার মতো হুমকিতেও রাশ টানা যাচ্ছে না এমপিদের। এ কারণে মাঠ পর্যায়ের জনগণের মধ্যে দলের রাজনৈতিক অবস্থান নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতারা।
গত ৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রতিনিধি সভায় তৃণমূল নেতারা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই সংসদ সদস্যদের সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, এখনো সময় আছে দলের এমপিদের ঠিক না করতে পারলে ভবিষ্যতে কঠিনভাবে এর মাসুল দিতে হবে। তাঁরা আরো বলেন, 'ওয়ান টাইম ইকোনো কলম মার্কা' এমপিরা দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছেন। দলের জনপ্রিয়তাকে তলানিতে নিয়ে যাচ্ছেন। দলের কমপক্ষে ২০০ এমপি দুর্নীতি-লুটপাট করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। 'গোলাম মাওলা রনি মার্কা' এমপি দিয়ে দল আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে জেলা নেতাদের চলমান ধারাবাহিক মতবিনিময় সভায়ও অভিযোগ উঠছে এমপিদের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, গত ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এমপিদের বিরুদ্ধে আভিযোগ ওঠার পর শেখ হাসিনা উপস্থিত এমপিদের উদ্দেশে বলেন, 'সংসদ সদস্যদের মনে রাখা উচিত, নেতা-কর্মীদের অবদানেই তাঁরা এমপি নির্বাচিত হয়েছে। নেতা-কর্মীদেরকেই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভোট চাইতে হয়েছে।'
দলীয় সূত্রে জানা যায়, দলীয়ভাবে সংসদ সদস্যদের কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে আওয়ামী লীগ। এই সমস্যা আরো বেশি তাঁদের নিয়ে- যাঁরা প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েছেন।
জানা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলাদলি-কোন্দল, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অবহেলা, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি, ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা, সরকারি কর্মকর্তাকে লাঞ্ছনা, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, তদবিরবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে। মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় শিরোনাম হচ্ছেন এমপিরা। তাঁদের মধ্যে আছেন গোলাম মাওলা রনি, আবদুর রহমান বদি, এম আবদুল লতিফ, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, জুনাইদ আহমেদ পলক, সারাহ বেগম কবরী, সানজিদা খানম, ডা. আনোয়ার হোসেন, আবদুল ওদুদ, জাকির হোসেন, সোলায়মান হক জোয়ার্দার সেলুন, জয়নাল আবেদীন, শাহরিয়ার আলম, ইসহাক হোসেন তালুকদার, কর্নেল (অব.) এ এ মারুফ সাকলান, শেখ আফিল উদ্দিন, কবিরুল হক, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, কামাল আহমেদ মজুমদার, তৌহিদ জং মুরাদ, মিজানুর রহমান খান দীপু, মোজহারুল হক প্রধান, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। সমালোচিত এমপিদের মধ্যে অধিকাংশই এবার প্রথমবারের মতো নির্বাচিত।
এমপি গোলাম মাওলা রনির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এমপি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ-বিরোধীদের নিয়ে ঘোরেন। যারা ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ি এবং দলীয় অফিসে আগুন দিয়েছে, তাদের নিয়েই চলেন এমপি। এলাকার উন্নয়নের জন্য টিআর-কাবিখা এলেও তা দিয়ে কোথায় উন্নয়ন হয়, তা কেউ জানে না।'
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোলাম মাওলা রনি কলের কণ্ঠকে বলেন, 'এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে আমি আগের চেয়ে ২০ হাজার ভোট বেশি পাব। আমি দুষ্টকে দমন করেছি, শিষ্টকে প্রতিপালন করেছি।'

No comments

Powered by Blogger.