রেলের অর্থ কেলেঙ্কারি-চাকরি গেল দুই কর্মকর্তার

তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চাকরি হারালেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা। মধ্যরাতে অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বক্তব্য জানতে তদন্ত কমিটি তাঁকে ডেকেছিল।
গতকাল রোববার কমিটির কাছে বক্তব্য পেশ করে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বের হন ইউসুফ আলী।


এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, সেদিন মধ্যরাতে তিনি রেলমন্ত্রীর বাসাতেই যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। এই বক্তব্যের প্রায় তিন ঘণ্টার মাথায় রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হককে সাময়িক বরখাস্ত এবং এপিএস ফারুককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী জানান, প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে তাঁদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পরে এপিএসের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়।
তবে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগে এপিএস ও রেল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও এর দায় নিয়ে মন্ত্রী পদ ছাড়বেন না বলে জানিয়ে দেন। রেলভবনে সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলার সময় মন্ত্রী বিতর্কিত নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্থগিত ঘোষণা করেন।
অবশ্য এসব ব্যবস্থা নেওয়ার আগে রেলমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে একাধিকবার সলাপরামর্শ করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। রেলের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত কমিটি কিছু নয়। সব সিদ্ধান্ত মন্ত্রীর।
মন্ত্রী আগে যা বলেছিলেন: রেলমন্ত্রী ১০ এপ্রিল বলেছিলেন, গাড়িচালক তাঁর এপিএসকে হাইজ্যাক ও ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল। এর দুই দিন পর বললেন, এটা ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীর কাজ। আরও বলেছিলেন, জিএমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই।
৯ এপ্রিল মধ্যরাতে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদর দপ্তর পিলখানার ফটকে ৭০ লাখ টাকাসহ ওমর ফারুক, ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হক আটক হন। পরদিনই প্রথম আলোসহ গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন যে তাঁরা মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন। রেলমন্ত্রী এ বক্তব্য খণ্ডন করে বলেছিলেন, ‘আমি রাত ১০টায় ঘুমাই। মধ্যরাতে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো সুযোগ নেই।’
গতকালের সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু নিজের বক্তব্য দেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার তেমন সুযোগ দেননি।
বিরোধী দল আপনার পদত্যাগের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। গণমাধ্যমে এসেছে, প্রধানমন্ত্রীও আপনাকে সরে যেতে বলেছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য বলুন। রেলমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, একজন রাজনীতিকের জন্য পদ গ্রহণ বড় কথা নয়। বর্জন করাও সহজ। বিরোধী দলের কথায় আমি পদ পাইনি। তাই বিরোধী দলের কথায় তো আমি পদত্যাগ করতে পারি না। সিদ্ধান্ত যাঁরা নিতে পারেন, সেখান থেকেই আসবে।’
এ সময় রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের রেলভবনে প্রবেশের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। বলেন, সবাই কি এভাবে সচিবালয়ে যেতে পারবে? কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে বলতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘সামারি ট্রায়ালেরও সময় দেওয়া হয়। বাপ রে বাপ, মিডিয়া ট্রায়ালে কোনো সময় দেওয়া হয় না।’
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: রেলমন্ত্রী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আরও কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা। নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তে জরুরিভাবে তদন্ত কমিটি গঠন। এপিএসের কাছ থেকে পাওয়া সব নথি ও বক্তব্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো ও সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ করা। তদন্তের প্রয়োজনে দুদককে রেলওয়ে থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া।
ওমর ফারুককে গত বুধবারই সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল। দুদকও তদন্ত করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে রেলওয়েকে চিঠি দেয়। গতকাল দুদকের দুই কর্মকর্তা রেলের মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দিনভর নাটক: রেলওয়ে সূত্র থেকে পাওয়া ও সরেজমিনে দেখা গেছে, ইউসুফ আলী মৃধা ও ওমর ফারুকের তদন্ত কমিটির কাছে হাজিরা দেওয়া নিয়ে অনেকটা নাটক চলেছে রেলভবনে। দুজনের হাজির হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু মৃধা খুব সকালে রেলভবনে আসেন। প্রথমে ভবনের সপ্তম তলার এক কর্মকর্তার কক্ষে কিছুক্ষণ কাটান। সাড়ে আটটার দিকে তিনি রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) ও তদন্ত কমিটির প্রধান আবু তাহেরের কক্ষে যান। সকাল নয়টার দিকে আবু তাহের নিজ কক্ষে আসেন।
মৃধা রেলভবনে এসে মহাপরিচালকের কক্ষে বসে নিজ হাতে কম্পিউটারে কিছুক্ষণ কাজ করেন। ডিজি আসার পর আসেন তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য শশী কুমার সিংহ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ডিজি বের হয়ে সাংবাদিকদের জানান, মৃধা লিখিত বক্তব্য তদন্ত কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে ডিজি কথা বলার পরপরই শশী কুমার সিংহ রেলমন্ত্রীর কক্ষে যান।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে একটা পর্যন্ত রেলের ডিজি, শশী কুমার সিংহ এবং ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কর্মকর্তা রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) আখতার উজ জামান বারবার মন্ত্রীর দপ্তরে যান। বেলা একটার পর রেলমন্ত্রী সচিব, ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে দীর্ঘ সময় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন।
ডিজি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর ইউসুফ আলী মৃধাও সাংবাদিকদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। মৃধা বলেন, তিনি গত সোমবার রাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসাতেই যাচ্ছিলেন। তবে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। আমার কোনো ভয় নাই। অন্তত ১০ জন আইনজীবী আমাকে জানিয়েছেন, তাঁরা আমার পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত।’
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হক কেন তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মৃধা বলেন, ‘জিএম হিসেবে আমার নিরাপত্তা দিতে তিনি আমার সঙ্গে ছিলেন।’ জিএমকে নিরাপত্তা দেওয়া এনামুলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি।
গতকাল ওমর ফারুকের হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। পরে জানানো হয়, ফারুক নিজে না এসে লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ফারুকের তদন্ত শেষ হয়ে গেছে। লিখিত জবানবন্দিতে ফারুক সব দায় নিজের ওপর নিয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রীকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। অন্যদিকে এনামুল হককে তদন্তের আওতায় আনা হলেও তাঁকে গতকালের আগে নোটিশই দেওয়া হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.