সময়ের প্রতিধ্বনি-তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা : একটি সরল বিশ্লেষণ by মোস্তফা কামাল
আসমানি কিতাব ছাড়া যেকোনো বিধানই পরিবর্তনশীল। মানব রচিত এমন কোনো বিধান নেই যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করা যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে এবং মানুষের কল্যাণে বিধান করা হয়। আবার তা পরিবর্তনও করা হয়। আমাদের সংবিধানও অপরিবর্তনশীল নয়।
সময়ের প্রয়োজনে এবং জনগণের কল্যাণে অবশ্যই পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা যেতে পারে। কিন্তু অতীতে আমাদের সংবিধানের যেসব পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে, তা করা হয়েছে কেবল নিজেদের স্বার্থে। পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকরা নিজেদের শাসনকালকে বৈধতা দিতে এবং নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছেন। বিশ্বের আর কোনো সংবিধান এত কাটাছেঁড়া হয়েছে কি না জানা নেই। এ কারণেই বার বার ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের দাবি উঠেছিল। এবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার সংবিধান পুনঃমুদ্রণ করেছে। তবে যে পরিবর্তনগুলো জনস্বার্থে নেওয়া হয়েছিল সেগুলো ঠিক রাখার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই গঠন করা হয়েছে বিশেষ কমিটি। কমিটি সংবিধানের অসংগতিগুলোও খতিয়ে দেখছে। আজকে আমার আলোচনার বিষয় সংবিধান নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কাজেই আমার আলোচনাটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
সাম্প্রতিক সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানি চলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করছেন। শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরিসহ বিশিষ্ট আইনজীবীরা এ বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্যদিকে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছে এবং সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে।
এ বিষয়ে আমরা অতীতের দিকে একটু ফিরে তাকাই। বিএনপি সরকারের আমলে মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি ওঠে। সেই দাবিতে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। একপর্যায়ে দাবিটি গণদাবিতে পরিণত হয়। তার পরও বিএনপি বিরোধী দলের দাবি মানতে রাজি হয়নি। তখন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দেশে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বাদ রেখেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি। তারা সরকার গঠনও করে। কিন্তু এতে বিএনপি আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পরে ষষ্ঠ সংসদে অনেকটা তড়িঘড়ি করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে ১৯৯৯ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিমুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস বাবু ও মো. আবদুল মান্নান খান হাইকোর্টে একটি রিট করেন। হাইকোর্ট শুনানির পর ২০০৪ সালে একটি রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ বলে স্বীকৃতি দেন। পরে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। সেই আপিলের শুনানি চলছে। ইতিমধ্যে যাঁরা শুনানিতে অংশ নিয়েছেন তাদের একজন বাদে প্রত্যেকেই বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন এবং কেন প্রয়োজন সেই যুক্তিও তাঁরা আদালতে উপস্থাপন করেছেন। শুনানির পর উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেখানেও নিশ্চয়ই জনস্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। সে বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি না। আমরা এর রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারি।
আমরা দেখেছি, জনদাবির কারণেই তখন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। এ ব্যবস্থায় সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে। পাশাপাশি এ ব্যবস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কাজেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত আরো কয়েকটি মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা এ ক্ষেত্রে একটা বড় অগ্রগতি। এখন নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি স্বাধীন করতে হবে।
বিএনপি সরকার তড়িঘড়ি করে আইনটি প্রবর্তনের কারণে এর ত্রুটিবিচ্যুতি রয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে এই দুর্বলতাগুলো দূর করা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কত হবে তা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠনেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে। এত ক্ষমতা পেয়ে রাষ্ট্রপতি যা খুশি তা করতে পারেন। অনেকে মনে করেন, বিএনপি জেনেশুনেই দলীয় রাষ্ট্রপতিকে বিশেষভাবে ক্ষমতাবান করেছিল, যদি বিএনপির পক্ষে তিনি কিছু করতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রথম বছরই আমরা দেখেছি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস একক ক্ষমতাবলে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করেন। তখন প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি তাৎক্ষণিক বেতার ও টিভিতে ভাষণ দিয়ে বললেন, রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতাবলে কাজটি করেছেন। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। অথচ বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতা দেওয়ার কারণে তা অপব্যহারের সুযোগ থাকে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেই সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। আবার রাষ্ট্রপতি হিসেবেও একের পর এক অধ্যাদেশ জারি, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করেন।
এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুটিন কাজ করার কথা। অথচ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেখেছি, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের পাঁচটি ধাপ পরীক্ষা না করেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। আবার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছেন। তিনি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অধ্যাদেশ জারি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক মেয়াদ নির্দিষ্ট করা না থাকায় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থেকে অনেক বড় কাজে হাত দিয়েছে। এসবই করা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে।
সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ যাতে ৯০ দিনের বেশি না হয় তা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে প্রয়োজনে আরো ৩০ দিন বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা কমানোর ব্যাপারেও মত দিয়েছে। এই মতামত যৌক্তিক এবং গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করি। তবে বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। এ জন্য সরকার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে পারে। বিরোধী দলের মতামত জানতে চাইতে পারে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আইনটি পাস করলেও ত্রুটিগুলো নিশ্চয়ই তাঁদের নজরে পড়েছে। তাঁরাও নিশ্চয়ই চাইবেন না, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদটি গ্রহণ করুক! এককভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করুক!
আমরা মনে করি, গণতন্ত্রের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি ত্রুটিমুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা কেউ ঘটাতে না পারে। একই সঙ্গে বলতে চাই, রাষ্ট্রপতির একক কর্তৃত্বও কাম্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে দায়িত্ব পালন করবেন এবং তখন সরকার যাতে রুটিন কাজের বাইরে আর কিছু করতে না পারে সেদিকটার প্রতিও নজর রাখতে হবে।
তবে এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ীভাবে থাকুক সেটাও আমরা চাই না। কারণ এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য বিএনপি বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়েছিল। একই কারণে এখন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকতে হলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা ছাড়া বিকল্প নেই। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে লোকসভা নির্বাচনের সময় সরকার থাকে নামমাত্র। সরকার রুটিন কাজের বাইরে কিছুই করতে পারে না। সেখানে নির্বাচন কমিশনই সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী। পুরো প্রশাসন থাকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। সে রকম একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন করতে পারলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে না। এ জন্য সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
সাম্প্রতিক সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানি চলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করছেন। শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরিসহ বিশিষ্ট আইনজীবীরা এ বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্যদিকে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছে এবং সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে।
এ বিষয়ে আমরা অতীতের দিকে একটু ফিরে তাকাই। বিএনপি সরকারের আমলে মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি ওঠে। সেই দাবিতে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। একপর্যায়ে দাবিটি গণদাবিতে পরিণত হয়। তার পরও বিএনপি বিরোধী দলের দাবি মানতে রাজি হয়নি। তখন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দেশে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বাদ রেখেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি। তারা সরকার গঠনও করে। কিন্তু এতে বিএনপি আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পরে ষষ্ঠ সংসদে অনেকটা তড়িঘড়ি করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে ১৯৯৯ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিমুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস বাবু ও মো. আবদুল মান্নান খান হাইকোর্টে একটি রিট করেন। হাইকোর্ট শুনানির পর ২০০৪ সালে একটি রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ বলে স্বীকৃতি দেন। পরে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। সেই আপিলের শুনানি চলছে। ইতিমধ্যে যাঁরা শুনানিতে অংশ নিয়েছেন তাদের একজন বাদে প্রত্যেকেই বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন এবং কেন প্রয়োজন সেই যুক্তিও তাঁরা আদালতে উপস্থাপন করেছেন। শুনানির পর উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেখানেও নিশ্চয়ই জনস্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। সে বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি না। আমরা এর রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারি।
আমরা দেখেছি, জনদাবির কারণেই তখন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। এ ব্যবস্থায় সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে। পাশাপাশি এ ব্যবস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কাজেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত আরো কয়েকটি মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা এ ক্ষেত্রে একটা বড় অগ্রগতি। এখন নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি স্বাধীন করতে হবে।
বিএনপি সরকার তড়িঘড়ি করে আইনটি প্রবর্তনের কারণে এর ত্রুটিবিচ্যুতি রয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে এই দুর্বলতাগুলো দূর করা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কত হবে তা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠনেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে। এত ক্ষমতা পেয়ে রাষ্ট্রপতি যা খুশি তা করতে পারেন। অনেকে মনে করেন, বিএনপি জেনেশুনেই দলীয় রাষ্ট্রপতিকে বিশেষভাবে ক্ষমতাবান করেছিল, যদি বিএনপির পক্ষে তিনি কিছু করতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রথম বছরই আমরা দেখেছি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস একক ক্ষমতাবলে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করেন। তখন প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি তাৎক্ষণিক বেতার ও টিভিতে ভাষণ দিয়ে বললেন, রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতাবলে কাজটি করেছেন। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। অথচ বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতা দেওয়ার কারণে তা অপব্যহারের সুযোগ থাকে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেই সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। আবার রাষ্ট্রপতি হিসেবেও একের পর এক অধ্যাদেশ জারি, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করেন।
এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুটিন কাজ করার কথা। অথচ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেখেছি, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের পাঁচটি ধাপ পরীক্ষা না করেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। আবার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছেন। তিনি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অধ্যাদেশ জারি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক মেয়াদ নির্দিষ্ট করা না থাকায় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থেকে অনেক বড় কাজে হাত দিয়েছে। এসবই করা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে।
সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ যাতে ৯০ দিনের বেশি না হয় তা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে প্রয়োজনে আরো ৩০ দিন বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা কমানোর ব্যাপারেও মত দিয়েছে। এই মতামত যৌক্তিক এবং গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করি। তবে বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। এ জন্য সরকার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে পারে। বিরোধী দলের মতামত জানতে চাইতে পারে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আইনটি পাস করলেও ত্রুটিগুলো নিশ্চয়ই তাঁদের নজরে পড়েছে। তাঁরাও নিশ্চয়ই চাইবেন না, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদটি গ্রহণ করুক! এককভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করুক!
আমরা মনে করি, গণতন্ত্রের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি ত্রুটিমুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা কেউ ঘটাতে না পারে। একই সঙ্গে বলতে চাই, রাষ্ট্রপতির একক কর্তৃত্বও কাম্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে দায়িত্ব পালন করবেন এবং তখন সরকার যাতে রুটিন কাজের বাইরে আর কিছু করতে না পারে সেদিকটার প্রতিও নজর রাখতে হবে।
তবে এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ীভাবে থাকুক সেটাও আমরা চাই না। কারণ এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য বিএনপি বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়েছিল। একই কারণে এখন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকতে হলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা ছাড়া বিকল্প নেই। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে লোকসভা নির্বাচনের সময় সরকার থাকে নামমাত্র। সরকার রুটিন কাজের বাইরে কিছুই করতে পারে না। সেখানে নির্বাচন কমিশনই সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী। পুরো প্রশাসন থাকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। সে রকম একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন করতে পারলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে না। এ জন্য সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments