বাংলা বর্ষবরণ-কী বার্তা দিয়ে গেল? by আবু সাঈদ খান

নগরজীবনের বর্ষবরণ মধ্যবিত্তের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিম্নবিত্ত, বিত্তহীনদের স্পর্শ করেছে সত্য, কিন্তু প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, কবে তাদের জীবনে নতুন বছর আনন্দের বারতা নিয়ে আসবে? সেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তাটুকু ছাড়া বর্ষবরণ_ দুঃখকে বরণ করে নেওয়ারই শামিল।


এই দীনদশা থেকে দেশের অগণিত মানুষ কখন, কীভাবে মুক্ত হবে_ এ প্রশ্ন বৈশাখী মেলা থেকে কেনা কোনো পণ্যের মতো শিকেয় তুলে রাখার নয়

বাংলা বর্ষবরণ এখন দেশের সর্ববৃহৎ উৎসব। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের সামাজিক উৎসবের যে রূপান্তর ঘটেছে, তাতে ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমার মতো দিনগুলোও শুধু ধর্মীয় কৃত্যে সীমাবদ্ধ নেই। তবে এসব উৎসব অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আকৃষ্ট করলেও মূলত বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাই স্ব-স্ব ধর্মীয় দিবসগুলো পালন করে। আর বাংলা বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের। দিনটির আবেদন সর্বজনীন। নগরজীবনেও এটি এখন ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে। বর্ষবরণ আর রমনার অশ্বত্থমূলে আটকে নেই। চারুকলা ইনস্টিটিউট, টিএসসি, বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর হয়ে রাজধানীর সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। ঢেউ লেগেছে জেলা-উপজেলা শহরেও। নানা আয়োজনে বর্ষবরণ হচ্ছে দেশজুড়ে।
কালের হাওয়ায় ম্রিয়মাণ লোকজ উৎসবকে শহরে নিয়ে আসা যে নিছক বিনোদন নয়, শিকড়ের টান অনুভবেরও বিষয়, তা বর্ষবরণের উৎসব পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়। ব্রিটিশ ভারতে স্বদেশী আন্দোলন কেবল বিলেতি পণ্য বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ইংরেজি নববর্ষ পালনের বিপরীতে কলকাতায় বাংলা নববর্ষ পালনের রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঠাকুর পরিবারসহ কলকাতায় বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হলেও তা তখন তত সাড়া জাগায়নি। জাতীয় উৎসবে রূপ নেয়নি।
পঞ্চাশের দশকেই বাংলার স্বশাসনের আন্দোলনের পটভূমিতে ঢাকায় ঘটা করে নববর্ষ পালন শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে রমনা অশ্বত্থমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন একটি মাইলফলক। তবে সেদিন পর্যন্ত এটি ছিল লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের অনুষ্ঠান। কয়েক বছর আগেও দেখেছি, কেবল শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত নারীরা বাহারি শাড়ি পরে, পুরুষরা নকশা করা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনত। নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবীরা ধারেকাছেও যেত না। আমার মনে পড়ে, শিশুপার্কের সামনে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর একটি অনুষ্ঠানে ফকির আলমগীর গেয়েছিলেন 'আমি এহন রিকশা চালাই ঢাহা শহরে'সহ বিভিন্ন লোক ও গণসঙ্গীত। সেখানে দেখলাম ভিন্ন এক চিত্র। কেবল মধ্যবিত্তরা নেই, শ্রমিক-হকার-পথচারী সবাই স্ব-স্ব কাজ-গন্তব্য ভুলে গান শুনছে। এভাবেই যখন বিভিন্ন স্থানে লোকসঙ্গীত গীত হতে লাগল, তখন শহরের নিম্নবিত্ত-শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণ বেড়ে গেল। পহেলা বৈশাখ নতুন আবেদন তৈরি করল গ্রাম থেকে আসা শিল্পীদের পুতুল, খেলনাসহ নানা পণ্যের সম্ভার সাজিয়ে বৈশাখী মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
এখন বর্ষবরণ সব শ্রেণীর, সব পেশার মানুষকে স্পর্শ করেছে। গার্মেন্ট শিল্পের মেয়েরাও তাঁতের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। মেলায় আসছে সর্বস্তরের নর-নারী, শিশু। আয়োজকও কেবল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নয়, পাড়া-মহল্লায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। অনেক স্থানে ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো উদ্যোক্তা। এসব অনুষ্ঠানে খররোদেও লোকসঙ্গীতের সুর-মূর্ছনায় বিমুগ্ধ নর-নারীদের ভিড় দেখা যায়। এবার পহেলা বৈশাখের সকালে ঘণ্টাতিনেক হেঁটে এবং টেলিভিশন সেটের সামনে বসে বুঝেছি, ক্রমেই এটি মধ্যবিত্তের চৌহদ্দি পেরিয়ে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে অনুষ্ঠানভেদে দর্শক আলাদা। সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব শ্রেণীর নর-নারী একাকার হয়ে গেছে। এ মেলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে_ কেউ প্রশ্ন করে না যে, তার পাশের মানুষটি হিন্দু না মুসলিম। এখানে নারী-পুরুষ পাশাপাশি হেঁটেছে, উল্লাস করেছে। কোনো অঘটন ঘটেনি। কেননা, এ মেলা কেবল বিনোদনের নয়, মানবিক বোধেরও জাগৃতি ঘটিয়েছে। গড়ে তুলেছে সংহতির বাতাবরণ, যা জাতীয় সংহতিরই নামান্তর।
নগরের এ মেলায় দেশের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর আধিপত্য। এখানে আদিবাসীর অংশগ্রহণ নেই। তারা স্ব-স্ব এলাকায় তাদের মতো করেই বর্ষবরণ করে। আদিবাসীরা ব্যাপকভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে পার্বত্য চট্টগ্রামে। সেখানে একদা চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরারা বৈসুক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। এখন বৈসুকের বৈ, সাংগ্রাইর সা এবং বিজুর বি নিয়ে একত্রে বৈসাবি পালিত হচ্ছে পাহাড়ে। তিন আদিবাসী গোষ্ঠীর এ সম্মেলন ইতিবাচক। কিন্তু রাজধানীতে তারা কেন অনুপস্থিত থাকবে? সেই দায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিরই। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে লোকসঙ্গীত ও গ্রামীণ সামগ্রী নিয়ে যখন বৈশাখী মেলা হতে শুরু করল, তখন নববর্ষ পালনে গুণগত পরিবর্তন এলো, ব্যাপক জনতার সম্পৃক্তি ঘটল। একইভাবে যদি নববর্ষের মঞ্চগুলোতে আদিবাসীদের গান ও নৃত্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, খাসিয়া, মণিপুরিসহ আদিবাসীদের হৃদয়ের স্পন্দন একসঙ্গে অনুভূত হবে, বাঙালির বর্ষবরণ বাংলার বর্ষবরণে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের দায়িত্বও কম নয়। পত্রিকার ক্রোড়পত্রে এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে হবে।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবকিছুই বাঙালিকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গ সন কেবল বাঙালির সন নয়, এটি বাংলার সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষের বর্ষ গণনার পদ্ধতি। সব বঙ্গসন্তানই হৃদয়ের গভীর ভালোবাসায় বাংলা নববর্ষকে অভিষিক্ত করে। তা-ই যদি হয়, তবে কোন যুক্তিতে বাংলা নববর্ষকে আমরা খণ্ডিত করব? এ ক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যমগুলোর সংকীর্ণতা রয়েছে। সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের শিরোনাম হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির স্বাধীনতা, বাঙালির বিজয় ইত্যাদি। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী প্রকাশিত হওয়ার পরও আমরা ভাবতে পারি না যে, এটি বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, সব মানুষের বিজয়গাথা। এ সংকীর্ণতার দেয়াল ভাঙতে হবে। বর্ষবরণ, বসন্তবরণ, পৌষমেলা, নবান্ন উৎসব, স্বাধীনতা উৎসব, বিজয় উৎসব, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী, নজরুল জন্মজয়ন্তী, লালন মেলা, হাছন মেলা, মধুমেলা, জসীম মেলা, জব্বারের বলীখেলাসহ নানা দিন ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের এক মোহনায় দাঁড়াতে হবে। কোনো বিবেচনায় এসবকে কেবল বিনোদন অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অবকাশ নেই। মেলা আর মিলনের মধ্য দিয়ে মানবিকতা উৎসারিত হবে, অপসৃত হবে উগ্র জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা, পুরুষতান্ত্রিকতা, কূপমণ্ডূকতাসহ সব অশুভ তৎপরতা।
এটি প্রতীয়মান যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষের মধ্যে যে বিভাজন-রেখা রয়েছে, তা দেশজোড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুছে যাচ্ছে, বিলীন হবে হয়তো একদিন। কিন্তু মানুষে মানুষে যে অর্থনৈতিক বিভাজনের দেয়াল গড়ে উঠেছে, তা অক্ষত রেখে জাতীয় সংহতি কতটুকু সুদৃঢ় হবে_ সেটিই বড় জিজ্ঞাসা। এবার অভিজাত রেস্তোরাঁয়, রমনা অশ্বত্থমূলে চড়া দামে পান্তা-ইলিশ বিক্রি হয়েছে। ধনীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তা তাকিয়ে দেখেছে নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন নর-নারীরা। ধনীদের এই পান্তাবিলাস দেশের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কাছে এক চরম উপহাস বলে প্রতীয়মান হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, লোকায়ত জীবনে ইলিশের বংশবৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে চৈত্র-বৈশাখে ইলিশ খাওয়া থেকে বিরত থাকার রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। কেননা এ সময় ইলিশ ডিম ছাড়ে অথবা জাটকা অবস্থায় থাকে। তাই পহেলা বৈশাখে যদি ইলিশ-পান্তার প্রচলন অব্যাহত থাকে, তা হবে ইলিশ-সম্পদ ধ্বংসের কারণ।
এটি ঠিক যে, উৎসবের সঙ্গে বাণিজ্যের যোগ আছে। কিন্তু উৎসবের আমেজ ও সর্বজনীনতাকে বিদীর্ণ করে_ এমন কিছু অবশ্যই পরিহারযোগ্য। আজ সঙ্গতভাবে দেশি তাঁতের শাড়ি, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সবাই মেলায় আসছে। এখানে পোশাকে বড় ধরনের পার্থক্য নেই। আমরা ঈদে, পূজায় দেখি_ লাখ টাকার লেহেঙ্গা, জামদানি-বেনারসি পরিহিতাদের প্রতিযোগিতায় ম্লান হয়ে যায় অনুষ্ঠানের সর্বজনীন আবেদন। একই রকম প্রতিযোগিতায় নববর্ষ বরণের আবেদন যেন ভূলুণ্ঠিত না হয়, সেটি সবারই বিবেচনার বিষয়।
নগরজীবনের বর্ষবরণ মধ্যবিত্তের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিম্নবিত্ত, বিত্তহীনদের স্পর্শ করেছে সত্য, কিন্তু প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, কবে তাদের জীবনে নতুন বছর আনন্দের বারতা নিয়ে আসবে? সেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তাটুকু ছাড়া বর্ষবরণ_ দুঃখকে বরণ করে নেওয়ারই শামিল। এই দীনদশা থেকে দেশের অগণিত মানুষ কখন, কীভাবে মুক্ত হবে_ এ প্রশ্ন বৈশাখী মেলা থেকে কেনা কোনো পণ্যের মতো শিকেয় তুলে রাখার নয়।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.