বেথনাল গ্রিন থেকে ব্রাডফোর্ড- ব্রিটেনের রাজনীতিতে বাসন্তী হাওয়া by ফারুক যোশী

নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর স্কাই নিউজের পক্ষ থেকে যখন তাঁকে ব্রিটেনের অতি আলোচিত-সমালোচিত নেতা হিসেবে উল্লেখ করে বিভিন্নভাবে তির্যক মন্তব্য করে দর্শকদের হাসানোর কিংবা তাঁকে হেয় করার প্রক্রিয়া চালানো হয়, তখন গ্যালওয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে বলতে পেরেছিলেন, 'সহজ কথায় আমি জয়ী। এটাই সত্যি আমি জয়ী।


আমি যখন বিজয় ছিনিয়ে আনি, তখন আমার বিগব্রাদারের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা উঠে আসে, আমার গ্যাম্বলিং নিয়ে কথা ওঠে।' আসলেও তাই। বাঙালি অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিন-বোতে যখন তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখনো তাঁর গণমাধ্যমে আসাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্কাই নিউজের সাংবাদিক অ্যাডামের মতো এ রকম আক্রমণাত্মক কথাই সে সময় আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক জেরেমি ফ্যাঙ্ম্যানও বলেছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন, 'কালো উনা কিংকে হারিয়ে গ্যালওয়ে আপনি কি গর্ববোধ করেন?' কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি সে সময়ও তাঁর যুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি ব্রিটেনের করপোরেট মিডিয়া। আর তাই তো চৌকস সাংবাদিক অ্যাডামকে এবারও সুযোগ না দিয়েই বলেই ফেলেন, 'অ্যাডাম দয়া করে কি যুদ্ধ নিয়ে কথা বলবেন?'
জর্জ গ্যালওয়ে, বলতেই হয়, এক কারিশমা দেখিয়েছেন ব্রিটেনের এই উপনির্বাচনে। ব্রাডফোর্ড ওয়েস্ট মুসলিম অধ্যুষিত, অন্য কথায় বলতে গেলে পাকিস্তানি মুসলমান অধ্যুষিত একটি এলাকা। এখানে লেবার পার্টি প্রায় ৪০ বছর থেকে দাপটের সঙ্গে টিকেছিল। কিন্তু সেই ভিত্তিমূলে নাড়া দিলেন ব্রিটেনের আরেক বহুল আলোচিত রাজনীতিবিদ জর্জ গ্যালওয়ে। পৃথিবীর দেশে দেশে, বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে ব্রিটেনের আক্রমণকে এত ব্যাপক আলোচনায় আনতে পারেননি কোনো পশ্চিমা রাজনীতিবিদ, যতটুকু না এনেছেন জর্জ গ্যালওয়ে। তৎকালীন লেবার সরকারের ইরাক আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে গ্যালওয়ে ২০০৩ সালে তাঁর পার্টি থেকে বহিষ্কৃৃত হয়েছিলেন। স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিলেন বাঙালি অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিন-বো এলাকায়। তার মাত্র দুই বছর পর ইরাক আগ্রাসন আর যুদ্ধবাজদের বিরোধিতা করে আরেক লেবারের দুর্গে তিনি আঘাত হেনেছিলেন সে সময়। ইসরায়েলের বন্ধু এবং ইরাক আগ্রাসনের সমর্থক উনা কিং তখন পরাজিত হয়েছিলেন। গ্যালওয়ের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিজয় নিয়ে এসেছিলেন বাঙালিরা সে সময়। বলতেই হয় গ্যালওয়ে বেথনাল গ্রিন-বোতে জয়ী না হলে আজকের রোশনারা আলীর বিজয়ও হয়তো প্রশ্নবোধকই হয়ে থাকত। কেননা গ্যালওয়ে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হয়েছিল এই আসনে লেবারের বাঙালি প্রার্থীর মনোনয়ন। সেই পথ ধরেই বাঙালিরা এখানে ভিত্তি গেড়েছে। এগিয়ে চলেছে থর থর করে।
এবারও সেই একই ধারা। কোনো ইস্যু নয়। লেবার পার্টির নির্বাচিত এমপি মারশা শারীরিক কারণে পদত্যাগ করেছেন। সেখানে লেবার দল তার প্রার্থী মনোনয়নও দিয়েছে একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্যারিস্টারকে। অথচ সেখানেই এসে বলতে গেলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনেন তিনি। একজন নেতার সামনে সুনির্দিষ্ট ভিশন কিংবা লক্ষ্য যে কিভাবে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারে তার এক জীবন্ত কিংবদন্তি যেন জর্জ গ্যালওয়ে। মানুষের সচেতনতা ব্রিটেনে নির্বাচনকে বিভিন্ন সময়েই ধাক্কা দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে ধরাশায়ী হয়। মূলত দুটো দলের মাঝেই ঘুরপাক খায় ক্ষমতার পালাবদল। কিন্তু ব্রাডফোর্ড ওয়েস্টের মানুষ সচেতনভাবেই, এমন কি নিজস্ব গোত্র কিংবা কমিউনিটির প্রতিনিধিকেও ভোট দেয়নি। কারণ তারা চেয়েছিল রাজনীতিতে যেন অন্তত কেউ তাদের কথা বলুক। যুদ্ধবিরোধী স্লোগান তাই তো ক্রমেই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণেই গ্যালওয়ের নেতৃত্বে লেবার পার্টির দুর্গে ব্রাডফোর্ডের মানুষ গত ২৯ মার্চ আঘাত হেনেছে। ১০ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে তিনি লেবার পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন। গ্যালওয়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় এমন কিছু ইস্যু এনেছেন, যা ওই এলাকার মানুষকে টেনেছে চুম্বকের মতো। যুদ্ধ নিয়ে ব্রিটেনের উন্মাদনা এবং এই উন্মাদনায় টনি ব্লেয়ারের উদ্যোগকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে চায়। কিন্তু লেবার-কনজারভেটিভ- কেউই এতে তাদের অংশীদার হয় না। তারা একজন গ্যালওয়েকে দেখেছে। গ্যালওয়ের প্রতিবাদের উচ্চারণে এই এলাকার ভোটার মূলধারায় বার্তা পৌঁছাতে পেরেছে। যুদ্ধ নিয়ে শত-সহস্র বিলিয়ন পাউন্ডের অপচয় আর সাম্প্রতিক ২১ বছরের ছয় তরুণের বাঙ্ বন্দি হয়ে আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসাকে তিনি দাগ কাটাতে পেরেছেন এমনকি শ্বেতাঙ্গ ভোটারদেরও। সাদা তরুণদের রাগী উচ্চারণ দেখেছি আমরা এই নির্বাচনের সময়। যুদ্ধ উন্মাদনা এবং ব্রিটেনের শত-সহস্র তরুণকে ব্যবহার করা হচ্ছে ভিনদেশে মানুষ হত্যার কাজে। নিহত মানুষগুলোর প্রায়ই সবাই-ই মুসলমান এবং এই হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হচ্ছে ব্রিটেনের শত শত তরুণ অকারণে। যুদ্ধ করতে গিয়ে ব্রিটেন নামের দেশটি আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে। এর সব কিছুর মূলেই টনি ব্লেয়ারের লেবার। এ কথাগুলো যাদুর মতো কাজ করেছে ভোটারদের মধ্যে। তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে কাজ করেছে। লেবারের মানুষ হয়েও লেবার পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিয়েছে একজন জর্জ গ্যালওয়েকে।
তিউনিসিয়ায় সে দেশের তরুণ-তরুণীরা বিপ্লব ঘটিয়েছে। তিউনিসিয়া থেকে শুরু করে আরবের বিভিন্ন দেশে আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছে, ঠিক তেমনি ব্রাডফোর্ড যেন জেগে উঠেছে নতুন বাসন্তী হাওয়ায়। এই হাওয়ায় আছে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যাবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানুষের সুদৃঢ় উচ্চারণ। হত্যাযজ্ঞের বিপরীতে শান্তির দৃপ্ত শপথ। আর তাই তো বিজয়ের পর রেসপেক্ট পার্টির ওই নেতা জর্জ গ্যালওয়ে তাঁর বিজয়কে 'ব্রাডফোর্ড-স্প্রিং' কিংবা 'ব্রাডফোর্ড বসন্তের' সঙ্গে তুলনা করেছেন। হতেই পারে গ্যালওয়ের এ এক অতিশয় উচ্চারণ। কিন্তু ব্রিটেনের বাস্তবতার বিপরীতে এই উচ্চারণটাই যেন সঠিক। রেসপেক্ট পার্টি হয়তো ক্ষমতার অংশীদার হতে পারবে না কখনো। কিন্তু রেসপেক্টের প্রার্থী হয়ে গ্যালওয়ের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে যে বার্তা পৌঁছে গেল সারা ব্রিটেনে, তা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার নয়। গ্যালওয়ে সময়ে সময়ে চমক এনেছেন। কখনো ব্রিগব্রাদারে, কখনো গ্যাম্বলিংয়ে। রাজনীতিতে এনেছেন বিস্ময়। তাই তো তার ভাগ্যে জুটেছে 'সুযোগসন্ধানী' কিংবা 'বসন্তের কোকিল' শব্দ দুটোও। কিন্তু গ্যালওয়ে আর যাই করুন, অন্তত ব্রিটেনের এথনিক কমিউনিটিতে তাঁর রাজনৈতিক 'বসন্তের কোকিল' হওয়া এই কমিউনিটিগুলোকেই সমৃদ্ধ করেছে। আগেই উল্লেখ করেছি, গ্যালওয়ে এগিয়ে না এলে টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালি কমিউনিটিকে কাউন্সিলর পদগুলো নিয়ে লম্পঝম্প দিতে হতো। আজ তারা এমপির পাশাপাশি নির্বাহী মেয়রও।
ব্রাডফোর্ড কমিউনিটিতে পাকিস্তানিরা সমৃদ্ধ, অন্তত লেবার পার্টির রাজনৈতিক মনোনয়নে। কিন্তু এখানেও আছে বর্ণবাদ। বর্ণবাদের থাবা আছে। আছে দরিদ্র একটি এলাকার বদনাম। কিন্তু কোনো রাজনীতিই এই ধারাকে সমৃদ্ধ করতে পারছে না। তাই তো এবারে তাদের নিজস্ব মানুষ পেয়েও নির্ভর করতে পারেনি এই এলাকার মানুষ। ব্রিটেনের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার জন্য লেবার পার্টি কম দায়ী নয়। যুদ্ধ বাঁধানোর দায় লেবার পার্টির ওপরই বর্তায়। তাই তো মানুষ এবার ইস্যু হিসেবে বেছে নিয়েছে জাতীয় ইস্যু। অন্য অর্থে মুসলমান জনগোষ্ঠী মনে করেছে, গ্যালওয়েকে জয়ী করানোর মধ্য দিয়ে তারা একটা নতুন কিছুর সূত্রপাত করতে পারবে। বেথনাল গ্রিন-বোতে বাঙালিদের একটা ধারা সৃষ্টি হয়েছে, যেখান থেকে সরে আসবে না বাঙালি কমিউনিটি। বরং আগাবে সময়ে সময়ে। আমরা বিশ্বাস রাখি, ব্রাডফোর্ডের এ বসন্তের হাওয়া ব্রিটিশ রাজনীতিতেই একটা দমকা বাতাসের মতো কাজ করবে। যুদ্ধবিরোধী মনোভাব নিয়ে তিনটি বড় দলকেই ভোটারদের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, বেথনাল গ্রিন থেকে ব্রাডফোর্ড- গ্যালওয়ের এই বাসন্তী হাওয়ায় এমনকি ব্রিটেনের রাজনীতিতেও আসতে পারে একটি গুণগত পরিবর্তন।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
Faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.