বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী! by এম আবদুল হাফিজ
দু'দিন ধরে রীতিমতো 'টক অব দ্য টাউন' রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে সত্তর লাখ টাকা। অবশ্য অজপাড়াগাঁয়ের এক কৃষক সন্তান ইতিমধ্যে কোটিপতি। রেলমন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ওমর ফারুক তালুকদারের কপাল খুলে যায়।
এই বাণিজ্যের সঙ্গে মন্ত্রকের প্রধান নির্বাহী রেলমন্ত্রীর কোনো সম্পর্ক আছে কি-না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও ঘটনাপ্রবাহ সন্দেহে অঙ্গুলি তার দিকেও উত্তোলন করে। সংবাদপত্রে আমরা যে হারে মন্ত্রী, এমপি এবং আমলাদের ভাগ্য পরিবর্তনের চমকপ্রদ কাহিনী পাঠে অভ্যস্ত, তাতে এমন সন্দেহ অমূলক নয়। যারা ক্ষমতায় থাকেন বা ক্ষমতাসীন দলের অংশে পরিণত হন তাদের জন্য তো ইশারা-ইঙ্গিতে অধস্তনদের মাধ্যমে পর্বে-পার্বণে দক্ষিণা গ্রহণ কোনো বিরাট অন্যায় বিবেচিত হয় না।
এদেশে বিভিন্ন সরকারের সময় বিচিত্র সব নামে 'বাণিজ্য' হয়ে আসছে। যারা সরকারে নেই, কিন্তু সরকারের 'লাঠিয়াল'দের অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য জোর দখল, ভর্তিবাণিজ্য বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট-বাণিজ্য এক প্রকার হালালই। সবার দৃষ্টিতেই এসব তো দলের 'লাঠিয়ালি' করার পুরস্কার। তাই কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করে। বস্তা বস্তা টাকা যদি একজন মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে পাওয়া যায় ভ্রু কুঞ্চিত হবেই। প্রশ্ন উঠবে, এপিএস সাহেবের এই দুঃসাহসের উৎস কোথায়। কমন সেন্স তো বলে যে, অবশ্য মন্ত্রী মহোদয়ই সেই উৎস। যদিওবা এ নিয়ে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের যুক্তি, তার (মন্ত্রীর) সঙ্গে ডিউটি করার পর সে (এপিএস) কী করে বা কোথায় যায় তা নিয়ে তার কোনো জবাবদিহিতা নেই।
এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। চাকরিতে যোগ দেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আমার কমান্ডের অধীন এক ড্রাইভার একটি অ্যাক্সিডেন্ট করে, যাতে তার চালিত গাড়িটি অর্থাৎ সরকারি সম্পত্তিটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যথারীতি ঘটনার তদন্ত হলো, যার সুপারিশ অনুযায়ী গাড়িটির ক্ষতি সারাতে আমাকে কিছু আর্থিক জরিমানা করা হলো, ড্রাইভারকে শুধু সতর্ক (ধিৎহরহম) করে দেওয়া হলো। এই উদ্ভট বিচারে আমি মনঃক্ষুণ্ন না হয়ে পারলাম না। কেননা গাড়িটির দুর্ঘটনার সঙ্গে আমার তিলমাত্র সম্পর্ক ছিল না। আমার ঊর্ধ্বতনরা আমাকে বোঝালেন যে, আলোচ্য ড্রাইভারটির প্রশিক্ষণ এবং পারফরম্যান্সের পূর্ণ দায়িত্ব তার ওপরওয়ালার অর্থাৎ আমার। দুর্ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, আমি সেই দায়িত্বটি নিখুুঁতভাবে পালন করিনি।
মন্ত্রিত্ব মানে তো শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয় বা গাড়িতে লাল-সবুজের নিশান ওড়ানোও নয়। এক্ষেত্রে রেলমন্ত্রীকে প্রদত্ত একজন এপিএসসহ সমগ্র রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ভালোমন্দ সবকিছুর জবাবদিহিতাও তাকেই করতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক একজন এপিএস বাছাইয়ের কাজও সম্ভবত তিনিই করেছিলেন। এটি একটি সর্বজনবিদিত প্রবাদ যে, যিনিই মস্তকে মর্যাদার মুকুট ধারণ করেন, কর্তব্য পালন বিবেচনায় তিনি যেন আসলে একটি কণ্টক মুকুটই পরিধান করলেন।
বাংলাদেশে আজ যে দুর্নীতির মচ্ছব তা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, দুর্নীতিগ্রস্ত_ তিনি যে-ই হোন, তিনি তার কৃতকর্মকে দুর্নীতিই মনে করেন না। বরং মনে করেন, ঘুষ-দুর্নীতি তো তার পাওনা। তার বিবেক বলে কিছু থাকলে তা ভোঁতা। সেই বিবেক তাকে দংশন করে না। সে ভাবে, সে তার চাতুর্যে যা বাড়তি কামিয়েছে তা তার প্রাপ্য। দুর্নীতি একটি সর্বজনীন সংক্রামক ব্যাধি। বিভিন্ন দেশে উচ্চাসনে উপবিষ্টদের দুর্নীতি করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা আমরা পড়ি ও শুনি। নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রবাদতুল্য রাজীব গান্ধীও বোফোর্স কামান কিনতে গিয়ে দুর্নীতি করেছিলেন, যার অপচ্ছায়া এখনও পরিবারের পিছু ছাড়েনি। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ, যা রাজীব-পত্নী সোনিয়া গান্ধীর চোখের ইশারায় চলে, সেই সোনিয়া-পুত্র রাহুল গান্ধীর ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ, যদিও রাহুলের দুর্নীতির করার ইতিহাস নেই।
কবিগুরুর কবিতা 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'র প্রথম দুটি চরণ এ রকম :
'কোন বাণিজ্যে নিবাস তোমার কহো আমার ধনী/তাহা হলে সেই বাণিজ্যে করবো মহাজনি'। কিন্তু তিনি তা পারতেন না। কেননা ওমর ফারুকের চাতুর্য ও সাহস কোনোটাই তার ছিল না; না ছিল একজন রেলপথমন্ত্রীর ছত্রছায়া তার মাথার ওপরে। শুনেছি, এখন নাকি অধিক আয়ে সক্ষম থানা নিলামে ওঠে। যে সর্বোচ্চ ডাক হাঁকতে পারে নিয়োগ বাণিজ্যে সে-ই নিয়োগ পায় এমন থানায়। প্রচলিত এসব কথার মধ্যে খানিকটা অতিরঞ্জন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু প্রবণতটা এমনই। সর্বত্রই প্রতিযোগিতা। কিন্তু তা শুধু ভোগবাদের, লোভ-লালসার। এসব নিয়ে সরকার চলবে, দেশও থাকবে দেশের স্থানে। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি, কী রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের উত্তর পুরুষের জন্য? তবে মারাত্মক ভুল হবে যদি আমরা পচনের বিস্তৃতি এখানেই শেষ বলে মনে করি। অন্ধকারে-আবছায়ায় আরও যে কত পচন ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ও সমাজদেহে, তা হয়তো অজ্ঞাতই থেকে যাবে আমাদের কাছে। রাজনীতিকরা, বিদগ্ধ সমাজ ও বিশিষ্টজনরা যেসব কথা বলেন, পরখ করে দেখা দরকার তার কতখানি তারা বিশ্বাস করেন। আমরা বহির্বাণিজ্যে দুর্বল ও অপারদর্শী হলে কী হবে, অভ্যন্তরীণ হাজার রকমের বাণিজ্য উদ্ঘাটনে আমরা আলবৎ পারদর্শী। এখানে আমাদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের উদ্ভাবনী শক্তিতে কোনো ঘাটতি নেই।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল
হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
এদেশে বিভিন্ন সরকারের সময় বিচিত্র সব নামে 'বাণিজ্য' হয়ে আসছে। যারা সরকারে নেই, কিন্তু সরকারের 'লাঠিয়াল'দের অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য জোর দখল, ভর্তিবাণিজ্য বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট-বাণিজ্য এক প্রকার হালালই। সবার দৃষ্টিতেই এসব তো দলের 'লাঠিয়ালি' করার পুরস্কার। তাই কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করে। বস্তা বস্তা টাকা যদি একজন মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে পাওয়া যায় ভ্রু কুঞ্চিত হবেই। প্রশ্ন উঠবে, এপিএস সাহেবের এই দুঃসাহসের উৎস কোথায়। কমন সেন্স তো বলে যে, অবশ্য মন্ত্রী মহোদয়ই সেই উৎস। যদিওবা এ নিয়ে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের যুক্তি, তার (মন্ত্রীর) সঙ্গে ডিউটি করার পর সে (এপিএস) কী করে বা কোথায় যায় তা নিয়ে তার কোনো জবাবদিহিতা নেই।
এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। চাকরিতে যোগ দেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আমার কমান্ডের অধীন এক ড্রাইভার একটি অ্যাক্সিডেন্ট করে, যাতে তার চালিত গাড়িটি অর্থাৎ সরকারি সম্পত্তিটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যথারীতি ঘটনার তদন্ত হলো, যার সুপারিশ অনুযায়ী গাড়িটির ক্ষতি সারাতে আমাকে কিছু আর্থিক জরিমানা করা হলো, ড্রাইভারকে শুধু সতর্ক (ধিৎহরহম) করে দেওয়া হলো। এই উদ্ভট বিচারে আমি মনঃক্ষুণ্ন না হয়ে পারলাম না। কেননা গাড়িটির দুর্ঘটনার সঙ্গে আমার তিলমাত্র সম্পর্ক ছিল না। আমার ঊর্ধ্বতনরা আমাকে বোঝালেন যে, আলোচ্য ড্রাইভারটির প্রশিক্ষণ এবং পারফরম্যান্সের পূর্ণ দায়িত্ব তার ওপরওয়ালার অর্থাৎ আমার। দুর্ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, আমি সেই দায়িত্বটি নিখুুঁতভাবে পালন করিনি।
মন্ত্রিত্ব মানে তো শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয় বা গাড়িতে লাল-সবুজের নিশান ওড়ানোও নয়। এক্ষেত্রে রেলমন্ত্রীকে প্রদত্ত একজন এপিএসসহ সমগ্র রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ভালোমন্দ সবকিছুর জবাবদিহিতাও তাকেই করতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক একজন এপিএস বাছাইয়ের কাজও সম্ভবত তিনিই করেছিলেন। এটি একটি সর্বজনবিদিত প্রবাদ যে, যিনিই মস্তকে মর্যাদার মুকুট ধারণ করেন, কর্তব্য পালন বিবেচনায় তিনি যেন আসলে একটি কণ্টক মুকুটই পরিধান করলেন।
বাংলাদেশে আজ যে দুর্নীতির মচ্ছব তা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, দুর্নীতিগ্রস্ত_ তিনি যে-ই হোন, তিনি তার কৃতকর্মকে দুর্নীতিই মনে করেন না। বরং মনে করেন, ঘুষ-দুর্নীতি তো তার পাওনা। তার বিবেক বলে কিছু থাকলে তা ভোঁতা। সেই বিবেক তাকে দংশন করে না। সে ভাবে, সে তার চাতুর্যে যা বাড়তি কামিয়েছে তা তার প্রাপ্য। দুর্নীতি একটি সর্বজনীন সংক্রামক ব্যাধি। বিভিন্ন দেশে উচ্চাসনে উপবিষ্টদের দুর্নীতি করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা আমরা পড়ি ও শুনি। নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রবাদতুল্য রাজীব গান্ধীও বোফোর্স কামান কিনতে গিয়ে দুর্নীতি করেছিলেন, যার অপচ্ছায়া এখনও পরিবারের পিছু ছাড়েনি। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ, যা রাজীব-পত্নী সোনিয়া গান্ধীর চোখের ইশারায় চলে, সেই সোনিয়া-পুত্র রাহুল গান্ধীর ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ, যদিও রাহুলের দুর্নীতির করার ইতিহাস নেই।
কবিগুরুর কবিতা 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'র প্রথম দুটি চরণ এ রকম :
'কোন বাণিজ্যে নিবাস তোমার কহো আমার ধনী/তাহা হলে সেই বাণিজ্যে করবো মহাজনি'। কিন্তু তিনি তা পারতেন না। কেননা ওমর ফারুকের চাতুর্য ও সাহস কোনোটাই তার ছিল না; না ছিল একজন রেলপথমন্ত্রীর ছত্রছায়া তার মাথার ওপরে। শুনেছি, এখন নাকি অধিক আয়ে সক্ষম থানা নিলামে ওঠে। যে সর্বোচ্চ ডাক হাঁকতে পারে নিয়োগ বাণিজ্যে সে-ই নিয়োগ পায় এমন থানায়। প্রচলিত এসব কথার মধ্যে খানিকটা অতিরঞ্জন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু প্রবণতটা এমনই। সর্বত্রই প্রতিযোগিতা। কিন্তু তা শুধু ভোগবাদের, লোভ-লালসার। এসব নিয়ে সরকার চলবে, দেশও থাকবে দেশের স্থানে। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি, কী রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের উত্তর পুরুষের জন্য? তবে মারাত্মক ভুল হবে যদি আমরা পচনের বিস্তৃতি এখানেই শেষ বলে মনে করি। অন্ধকারে-আবছায়ায় আরও যে কত পচন ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ও সমাজদেহে, তা হয়তো অজ্ঞাতই থেকে যাবে আমাদের কাছে। রাজনীতিকরা, বিদগ্ধ সমাজ ও বিশিষ্টজনরা যেসব কথা বলেন, পরখ করে দেখা দরকার তার কতখানি তারা বিশ্বাস করেন। আমরা বহির্বাণিজ্যে দুর্বল ও অপারদর্শী হলে কী হবে, অভ্যন্তরীণ হাজার রকমের বাণিজ্য উদ্ঘাটনে আমরা আলবৎ পারদর্শী। এখানে আমাদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের উদ্ভাবনী শক্তিতে কোনো ঘাটতি নেই।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল
হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments