বাংলা পঞ্জিকা : বাংলাদেশি পঞ্জিকা by শিশির কুমার ভট্টাচার্য
মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধ হতে থাকে। বিশেষ করে কৃষিসভ্যতার উন্মেষের পরই কাল গণনা অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। কেননা কৃষি ঋতুনির্ভর। আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো আবার কৃষিনির্ভর। অন্যদিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোও ঋতুনির্ভর।
ঋতু সম্পর্কীয় আগাম পূর্বাভাস তথা কাল গণনা এবং গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানজনিত শুভাশুভ কাল নির্ণয়ের কাল্পনিক ধারণা কৃষিভিত্তিক সমাজ-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেক প্রাচীন সভ্যতায় তাই কাল গণনা বা পঞ্জিকার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদেরও একটি নিজস্ব পঞ্জিকা আছে, যদিও 'বাঙালি' সভ্যতার ইতিহাস তত সুপ্রাচীন নয়। বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস অবশ্য আলাদা। বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে। এই নামের প্রবর্তক শশাংক, না আকবর, না সংসদ তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এই পঞ্জিকার কাঠামোগত পরিচয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এই পঞ্জিকা সৌর পদ্ধতির। প্রাচীন ভারতীয় বেদাঙ্গ জ্যোতিষের সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসৃত। মাস ও বারের নাম, সময়ের একক ইত্যাদি তারই সাক্ষ্য বহন করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পঞ্জিকা সংস্কারের নামে বাংলা পঞ্জিকাকে খণ্ডিত করা হয়েছে। পঞ্জিকা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়। ভাষাবিদ বা সুসাহিত্যিকদের দ্বারা পঞ্জিকার সংস্কার সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশে যে পঞ্জিকা-সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন একজন বিখ্যাত ভাষাবিদ। সেখানে কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন বলে শুনিনি। পঞ্জিকার সংস্কার বলতে এই কমিটি ভারতের সাহা কমিটির মাসের দিন সংখ্যা সংক্রান্ত সুপারিশ গ্রহণ করে অধিবর্ষ এবং বর্ষ গণনা পদ্ধতি গ্রেগরীয় পঞ্জিকার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। পঞ্জিকার প্রকৃতিগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনিক কাজে আমরা ব্যবহার করি গ্রেগরীয় পঞ্জিকা। ধর্মীয় কাজে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ব্যবহার করেন ইসলামী পঞ্জিকা। হিন্দু-বৌদ্ধরা মেনে চলেন আবহমান বাংলা পঞ্জিকা। তাহলে সংস্কৃতিতে এই বাংলা পঞ্জিকার কার্যকরিতা কোথায়? বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের প্রয়োজনই বা হলো কেন? সংস্কারের নামে ঐতিহ্যবাহী বাংলা পঞ্জিকাকে খণ্ডিত করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। যদি সংস্কার করতে হয় তাহলে উভয় বাংলার যৌথ উদ্যোগেই তা করা সমীচীন হবে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা যদি আলাদা নিজস্ব একটি পঞ্জিকার অধিকারী হতে চাই তাহলে বাংলা পঞ্জিকাকে খণ্ডিত না করেই তা করতে হবে। একটি সুষ্ঠু পঞ্জিকা নির্মাণের প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো_বর্ষ শুরু, বর্ষ গণনা পদ্ধতি, মাস ও বছরের দিন সংখ্যা, অধিবর্ষ সংযোজন, মাস ও বারের নাম, দিনের সংজ্ঞা, গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান নির্ণয় ইত্যাদি। বর্ষ গণনার ধারাবাহিকতার জন্য একটি অঙ্কেরও প্রয়োজন। এসব বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশের জন্য বিজ্ঞানসম্মত এবং বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি আধুনিক পঞ্জিকা সহজেই নির্মাণ করা সম্ভব। তারই একটি রূপরেখা হতে পারে নিম্নরূপ।
আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীন দেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার কালকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা একাত্তর সাল থেকেই বাংলাদেশি শব্দ বা সন গণনা করতে পারি। সনের নাম হতে পারে শহীদ সন বা মুজিব সন। বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিন বিবেচ্য। শহীদ দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি), স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ), মুজিবনগর দিবস (১৭ এপ্রিল) ও বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর)। জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে বর্ষ গণনার প্রকৃষ্ট সময় বসন্ত বিষুব (২১ মার্চ)। এই দিন থেকেই সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু। তা ছাড়া এ দিনটি আমাদের স্বাধীনতা দিবসেরও কাছাকাছি। সুতরাং বসন্ত বিষুব থেকে বর্ষ গণনাই যুক্তিযুক্ত।
বর্ষ গণনা হবে সৌর পদ্ধতিতে। এক বসন্ত বিষুব থেকে পরবর্তী বসন্ত বিষুব পর্যন্ত সময়কে বলা হবে এক বছর। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব অনুযায়ী, প্রচলিত সময়ের এককে এই বছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫.২৪২২ দিন ব্যবহারিক জীবনে ভগ্নাংশের ব্যবহার অসুবিধাজনক। বছরের দিন সংখ্যা হতে হবে তাই পূর্ণসংখ্যাজ্ঞাপক। আধুনিক নিয়মে তাই সাধারণ বর্ষ ধরা হয় ৩৬৫ দিনে। আধুনিক নিয়মে অধিবর্ষ সংযোজন করে ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নেওয়া হয় যাতে ঋতুচক্রের সঙ্গে সংগতি থাকে। বছরে মাস ১২টি। আমরাও এই রীতি অনুসরণ করব। তবে মাসের দৈর্ঘ্য নির্মিত হবে নিউটনীয় বিজ্ঞান অনুসারে। এক বছরে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ৩৬০ বার অতিক্রম করে, প্রতি ৩০ বার অতিক্রমণকালকেই বলা হয় এক মাস। কিন্তু পৃথিবীর গতিবেগ সমহারের নয়, সূর্য থেকে বিপরীত দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। গ্রীষ্মকালে পৃথিবী থাকে সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে, যদিও উত্তর গোলার্ধ সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে। পক্ষান্তরে শীতকালে পৃথিবী থাকে সূর্যের সবচেয়ে নিকটে। তাই পৃথিবীর শীতকালীন বেগ গ্রীষ্মকালীন বেগের থেকে বেশি। ফলে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলো শীতকালীন মাসের থেকে দীর্ঘতর। মাসের প্রকৃত দৈর্ঘ্য গাণিতিকভাবে সহজেই বের করা যায়। কিন্তু তাতে ভগ্নাংশ চলে আসে। তাই ব্যবহারের সুবিধার জন্য গ্রীষ্মকালের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনের এবং পরের ৭ মাস ৩০ দিনের ধরা যায়, যাতে বছরে মোট ৩৬৫ দিন হয়।
নতুন পঞ্জিকায় মাসের নাম হিসেবে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি ব্যবহার সমীচীন হবে না। জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে এ নামগুলোর আর কোনো তাৎপর্য নেই। যেমন বিশাখা নক্ষত্রে এখন আর বৈশাখ মাস আসে না। জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখে মাসের নামকরণ যুক্তিযুক্ত। বর্ষ শুরুতে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু। তাই প্রথম মাসের নাম হতে পারে অয়ন মাস। পরের মাসগুলো হতে পারে যথাক্রমে অগি্ন, মৌসুমি, বাদল, বরুণ, নির্মল, হেমন্তি, শ্যামল, বিজয়, শস্য, শিশির ও মধু মাস। বিজয় দিবসকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য 'বিজয়' নামটি রাখা হয়েছে। গ্রেগরীয় পদ্ধতি অনুযায়ী অধিবর্ষ সংযোজন সুবিধাজনক। অতিরিক্ত দিনটি যুক্ত হয় মধু মাসের সঙ্গে। অঙ্কের হিসাবে বাংলাদেশি যে সনকে ৪ দ্বারা ভাগ করলে ১ অবশিষ্ট থাকে সেই সনটি হবে অধিবর্ষ। বাকি সনগুলো হবে সাধারণ বর্ষ। কিন্তু শতাব্দী-পরবর্তী যেসব ২৯তম সনকে ৪০০ দ্বারা ভাগ করলে ২৯ অবশিষ্ট থাকে সেই সনগুলো হবে অধিবর্ষ।
আধুনিক পঞ্জিকার একটি বড় দুর্বলতা হলো_'বার' ও 'তারিখ'-এর মধ্যে মিল না থাকা। মাসের তারিখগুলো প্রতিবছর নির্দিষ্ট বার-এ আসে না। এর প্রধান কারণ হলো সপ্তাহ চক্রটি সাত দিনের। ৫২ সপ্তাহের একটি চক্র শেষ হয় ২৬৪ দিনে। অথচ সাধারণ বর্ষ ৩৬৫ দিনের। ফলে প্রতি সাধারণ বর্ষে 'বার' একদিন করে পিছিয়ে পড়ে। অধিবর্ষ হলে পিছিয়ে পড়ে দুই দিন। ফলে বার ও মাসের তারিখে ক্রমাগত গরমিল দেখা দিতে থাকে। নতুন পঞ্জিকায় আমরা যদি ৩৬৫তম দিনকে এবং অধিবর্ষ হলে ৩৬৬তম দিনকে যথাক্রমে বারহীন 'বর্ষ শেষ' এবং অধিবর্ষ বলে চিহ্নিত করি, তাহলে আর এই সমস্যা থাকে না। যে বারে বর্ষ শুরু হলো, পরবর্তী বছর সে 'বারে'ই শুরু হবে। শেষের এই দিন দুটি ছুটির দিন বলে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো_বারের নামগুলো। আমরা যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৃহীত নামগুলো রেখে দিই, তাহলে অন্যান্য পঞ্জিকার সঙ্গে গরমিল দেখা দেবে। তাই বারের নতুন নামকরণ প্রয়োজন হবে। এই নামগুলো হতে পারে সূর্যের সাতটি নামে অথবা বাংলাদেশের সাতটি ফুল বা সাতটি নদীর নামে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী এক দিন হলো মধ্যরাত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। ভারতীয় পদ্ধতিতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কালকে বলা হয় এক দিন। প্রাত্যহিক জীবনে এ সংজ্ঞার ব্যবহারই সুবিধাজনক। তাই দিন বলতে আমরা এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত বোঝাব, যদিও সূর্যোদয়ের সময় নির্ধারিত হবে আধুনিক ঘড়ির কাঁটার নিয়মে। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান অনুযায়ীই উদ্যাপিত হয়।
এ ছাড়া জ্যোতিষী গণনার জন্যও গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পঞ্জিকায় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানজনিত যে সময়সূচি দেওয়া থাকে তা নির্ভুল নয়। যেমন_তিথি। চাঁদের ১২ বার অতিক্রমণকালকে এক তিথি বলা হয়। পঞ্জিকার হিসাবে তিথির ব্যাপ্তি ২১ ঘণ্টা থেকে ২৫.৫০ ঘণ্টা। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের হিসাবে তিথির ব্যাপ্তিকাল ২০ ঘণ্টা ২৬.৭৫ ঘণ্টার মতো। নতুন পঞ্জিকার জন্য আমরা চন্দ্র-সূর্য এবং গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান-সংক্রান্ত নির্ভুল তথ্য 'আমেরিকান এফিমেরিস' থেকে সংগ্রহ করতে পারি। উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে পারি। এ পঞ্জিকা হবে সহজ-সরল এবং নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের জন্য সুবিধাজনক।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীন দেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার কালকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা একাত্তর সাল থেকেই বাংলাদেশি শব্দ বা সন গণনা করতে পারি। সনের নাম হতে পারে শহীদ সন বা মুজিব সন। বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিন বিবেচ্য। শহীদ দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি), স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ), মুজিবনগর দিবস (১৭ এপ্রিল) ও বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর)। জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে বর্ষ গণনার প্রকৃষ্ট সময় বসন্ত বিষুব (২১ মার্চ)। এই দিন থেকেই সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু। তা ছাড়া এ দিনটি আমাদের স্বাধীনতা দিবসেরও কাছাকাছি। সুতরাং বসন্ত বিষুব থেকে বর্ষ গণনাই যুক্তিযুক্ত।
বর্ষ গণনা হবে সৌর পদ্ধতিতে। এক বসন্ত বিষুব থেকে পরবর্তী বসন্ত বিষুব পর্যন্ত সময়কে বলা হবে এক বছর। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব অনুযায়ী, প্রচলিত সময়ের এককে এই বছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫.২৪২২ দিন ব্যবহারিক জীবনে ভগ্নাংশের ব্যবহার অসুবিধাজনক। বছরের দিন সংখ্যা হতে হবে তাই পূর্ণসংখ্যাজ্ঞাপক। আধুনিক নিয়মে তাই সাধারণ বর্ষ ধরা হয় ৩৬৫ দিনে। আধুনিক নিয়মে অধিবর্ষ সংযোজন করে ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নেওয়া হয় যাতে ঋতুচক্রের সঙ্গে সংগতি থাকে। বছরে মাস ১২টি। আমরাও এই রীতি অনুসরণ করব। তবে মাসের দৈর্ঘ্য নির্মিত হবে নিউটনীয় বিজ্ঞান অনুসারে। এক বছরে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ৩৬০ বার অতিক্রম করে, প্রতি ৩০ বার অতিক্রমণকালকেই বলা হয় এক মাস। কিন্তু পৃথিবীর গতিবেগ সমহারের নয়, সূর্য থেকে বিপরীত দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। গ্রীষ্মকালে পৃথিবী থাকে সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে, যদিও উত্তর গোলার্ধ সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে। পক্ষান্তরে শীতকালে পৃথিবী থাকে সূর্যের সবচেয়ে নিকটে। তাই পৃথিবীর শীতকালীন বেগ গ্রীষ্মকালীন বেগের থেকে বেশি। ফলে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলো শীতকালীন মাসের থেকে দীর্ঘতর। মাসের প্রকৃত দৈর্ঘ্য গাণিতিকভাবে সহজেই বের করা যায়। কিন্তু তাতে ভগ্নাংশ চলে আসে। তাই ব্যবহারের সুবিধার জন্য গ্রীষ্মকালের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনের এবং পরের ৭ মাস ৩০ দিনের ধরা যায়, যাতে বছরে মোট ৩৬৫ দিন হয়।
নতুন পঞ্জিকায় মাসের নাম হিসেবে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি ব্যবহার সমীচীন হবে না। জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে এ নামগুলোর আর কোনো তাৎপর্য নেই। যেমন বিশাখা নক্ষত্রে এখন আর বৈশাখ মাস আসে না। জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখে মাসের নামকরণ যুক্তিযুক্ত। বর্ষ শুরুতে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু। তাই প্রথম মাসের নাম হতে পারে অয়ন মাস। পরের মাসগুলো হতে পারে যথাক্রমে অগি্ন, মৌসুমি, বাদল, বরুণ, নির্মল, হেমন্তি, শ্যামল, বিজয়, শস্য, শিশির ও মধু মাস। বিজয় দিবসকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য 'বিজয়' নামটি রাখা হয়েছে। গ্রেগরীয় পদ্ধতি অনুযায়ী অধিবর্ষ সংযোজন সুবিধাজনক। অতিরিক্ত দিনটি যুক্ত হয় মধু মাসের সঙ্গে। অঙ্কের হিসাবে বাংলাদেশি যে সনকে ৪ দ্বারা ভাগ করলে ১ অবশিষ্ট থাকে সেই সনটি হবে অধিবর্ষ। বাকি সনগুলো হবে সাধারণ বর্ষ। কিন্তু শতাব্দী-পরবর্তী যেসব ২৯তম সনকে ৪০০ দ্বারা ভাগ করলে ২৯ অবশিষ্ট থাকে সেই সনগুলো হবে অধিবর্ষ।
আধুনিক পঞ্জিকার একটি বড় দুর্বলতা হলো_'বার' ও 'তারিখ'-এর মধ্যে মিল না থাকা। মাসের তারিখগুলো প্রতিবছর নির্দিষ্ট বার-এ আসে না। এর প্রধান কারণ হলো সপ্তাহ চক্রটি সাত দিনের। ৫২ সপ্তাহের একটি চক্র শেষ হয় ২৬৪ দিনে। অথচ সাধারণ বর্ষ ৩৬৫ দিনের। ফলে প্রতি সাধারণ বর্ষে 'বার' একদিন করে পিছিয়ে পড়ে। অধিবর্ষ হলে পিছিয়ে পড়ে দুই দিন। ফলে বার ও মাসের তারিখে ক্রমাগত গরমিল দেখা দিতে থাকে। নতুন পঞ্জিকায় আমরা যদি ৩৬৫তম দিনকে এবং অধিবর্ষ হলে ৩৬৬তম দিনকে যথাক্রমে বারহীন 'বর্ষ শেষ' এবং অধিবর্ষ বলে চিহ্নিত করি, তাহলে আর এই সমস্যা থাকে না। যে বারে বর্ষ শুরু হলো, পরবর্তী বছর সে 'বারে'ই শুরু হবে। শেষের এই দিন দুটি ছুটির দিন বলে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো_বারের নামগুলো। আমরা যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৃহীত নামগুলো রেখে দিই, তাহলে অন্যান্য পঞ্জিকার সঙ্গে গরমিল দেখা দেবে। তাই বারের নতুন নামকরণ প্রয়োজন হবে। এই নামগুলো হতে পারে সূর্যের সাতটি নামে অথবা বাংলাদেশের সাতটি ফুল বা সাতটি নদীর নামে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী এক দিন হলো মধ্যরাত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। ভারতীয় পদ্ধতিতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কালকে বলা হয় এক দিন। প্রাত্যহিক জীবনে এ সংজ্ঞার ব্যবহারই সুবিধাজনক। তাই দিন বলতে আমরা এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত বোঝাব, যদিও সূর্যোদয়ের সময় নির্ধারিত হবে আধুনিক ঘড়ির কাঁটার নিয়মে। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান অনুযায়ীই উদ্যাপিত হয়।
এ ছাড়া জ্যোতিষী গণনার জন্যও গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পঞ্জিকায় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানজনিত যে সময়সূচি দেওয়া থাকে তা নির্ভুল নয়। যেমন_তিথি। চাঁদের ১২ বার অতিক্রমণকালকে এক তিথি বলা হয়। পঞ্জিকার হিসাবে তিথির ব্যাপ্তি ২১ ঘণ্টা থেকে ২৫.৫০ ঘণ্টা। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের হিসাবে তিথির ব্যাপ্তিকাল ২০ ঘণ্টা ২৬.৭৫ ঘণ্টার মতো। নতুন পঞ্জিকার জন্য আমরা চন্দ্র-সূর্য এবং গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান-সংক্রান্ত নির্ভুল তথ্য 'আমেরিকান এফিমেরিস' থেকে সংগ্রহ করতে পারি। উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে পারি। এ পঞ্জিকা হবে সহজ-সরল এবং নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের জন্য সুবিধাজনক।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments