বিশেষ সাক্ষাৎকার : সাঈদ খোকন-নগর সরকারের কোনো বিকল্প নেই

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা এবং ডিসিসির প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন। ডিসিসি নির্বাচন এবং বহুমুখী সমস্যায় আক্রান্ত মহানগরীর উন্নয়নসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে।


সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : আপনি কি আপনার দল আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করছেন?
সাঈদ খোকন : ডিসিসি নির্বাচন স্থানীয় সরকারের। এই নির্বাচন দলীয় নয়। তার পরও দলীয় সমর্থনের একটা রীতি আছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের দল। এই দল আমাকে সমর্থন দেবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
কালের কণ্ঠ : ঢাকাকে বিভক্তিকরণ নিয়ে নানা রকম মত আছে। কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
সাঈদ খোকন : ঢাকা এখন বিশাল নগরী। এর গণ্ডি তো শুধু বাড়ছেই। ২০১৫ কিংবা ২০২১ সালের কথা চিন্তা করুন, দেখবেন, এর সীমানা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। একদিকে যাবে নারায়ণগঞ্জ ছাড়িয়ে কদমরসুল পৌরসভা পর্যন্ত। রূপগঞ্জ, ধামরাই- সবই একাকার হয়ে যাবে মহানগরের সঙ্গে। ধরতে পারেন, বর্তমান ঢাকার ১০ গুণ হবে আগামী ঢাকা। এত বড় ঢাকার নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হলে বিভাজন অত্যন্ত জরুরি। আমি মনে করি, সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে সুদূরপ্রসারী কাজ করেছে।
কালের কণ্ঠ : বিভাজিত মহানগরের মধ্যে অবকাঠামোগত পার্থক্যও বিশাল। এটা কি প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে না?
সাঈদ খোকন : হ্যাঁ, দুই অংশের মধ্যে অবকাঠামোগত একটা পার্থক্য তো আছেই। আমি মনে করি, নতুন হওয়া দুই ডিসিসিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিশ্চয়ই অবকাঠামোগত অসুবিধাগুলো দূর করা হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের দল এখন ক্ষমতায়। ঢাকা মহানগরের সমস্যা সমাধানে সরকার কতটা সাফল্য অর্জন করেছে বলে আপনি মনে করেন?
সাঈদ খোকন : আওয়ামী লীগ জনগণের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার ভার জনগণের ওপর। সরকার গৃহীত অনেক কর্মসূচি ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিছু বাস্তবায়নাধীন আছে, আর কিছু পরিকল্পনাধীন আছে। তবে মহানগরের উন্নয়নের জন্য সিটি করপোরেশনের প্রশাসনের ব্যাপারটি ভাবতে হবে। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ডিসিসিতে চারদলীয় জোটের মেয়র ছিলেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর যে কঠিন সমস্যায় জর্জরিত, সেই ব্যাপারে তিনিই বলতে পারবেন।
কালের কণ্ঠ : নগর সরকার পদ্ধতির কথা বলেছিলেন আপনার পিতা এবং ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। নির্বাচিত হলে আপনি কি নগর সরকার পদ্ধতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবেন?
সাঈদ খোকন : আমার পিতা প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র। তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ এবং অভিজ্ঞ মানুষ। দীর্ঘ ৯ বছর তিনি ঢাকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের কথা বলেছিলেন। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হলে সিটি করপোরেশনের আওতায় বিদ্যুৎ, গ্যাস, যোগাযোগব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, পৃথক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থাসহ আরো কিছু বিষয় আনতে হবে। মহানগরের বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হলে মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের কোনো বিকল্প নেই।
কালের কণ্ঠ : সরকার কি এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে?
সাঈদ খোকন : সরকার রংপুর সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা যাচাই করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। আমরা আশাবাদী, সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করবে।
কালের কণ্ঠ : সংসদের বিরোধী দল ঢাকা মহানগরের এই বিভাজনকে মেনে নেয়নি। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
সাঈদ খোকন : বিরোধী দল অনেক কিছুই করতে পারে। তারা তো এ নিয়ে হরতাল করেছে, ভাঙচুর করেছে। বলেছে, এটা হতে পারে না, খুবই খারাপ হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু তাদের তো দ্বৈত ভূমিকা কিংবা স্ববিরোধী ভূমিকা পালনের অভ্যাসও আছে। রাজনীতিতে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বলে যে কথা আছে, সেই অবস্থা থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত। আমি কামনা করি, তারা ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরে আসবে।
কালের কণ্ঠ : সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তরুণদের বিশাল একটি অংশ ভোটার হওয়া সত্ত্বেও ভোট দিতে পারবে না তালিকা সম্পন্ন না হওয়ায়। আওয়ামী লীগের তরুণ একজন নেতা হিসেবে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন এ বিষয়টিকে।
সাঈদ খোকন : তরুণরা ভোট দিতে পারলে আমার জন্য ভালো হতো। আমি বয়সে তরুণ, এটা ঠিক, তবে রাজনীতিতে কিন্তু একেবারে নতুন নই। ১৯৮৭ সাল থেকে আমি রাজনীতি করি। ধাপে ধাপে মহানগর আওয়ামী লীগের এই পর্যায়ে আসার সুযোগ হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবেন কিভাবে?
সাঈদ খোকন : গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, পরিচ্ছন্নতা নিয়ন্ত্রণ, যানজট- এমন অনেক সমস্যাই আমরা ভোগ করি। মশার বিষয়টিও অনেকাংশে পরিচ্ছন্নতার ওপর নির্ভর করে।
কালের কণ্ঠ : এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেবেন?
সাঈদ খোকন : আমার আশা আছে বিশাল। কয়েকটি ক্ষেত্রে বড় রকমের প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও রাস্তাঘাটের প্রসঙ্গ আনা যায়। বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এ ধরনের বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব। আমি যদি নির্বাচিত হই এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত প্রশাসন পাই, তাহলে প্রয়োজন মেটানোর মতো ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট করা যায় কি না, তা দেখার আশা রাখি। এ কাজে সিটি করপোরেশন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বিদ্যুৎ ও রাস্তার মতো বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থার জন্যও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা চাইতে পারে সিটি করপোরেশন। গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যুগান্তকারী প্রাপ্তি হিসেবে সমুদ্র বিজয়ের কথা ধরা যেতে পারে। আমি যদি নির্বাচিত হই, তাহলে প্রথম ছয় মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ করব। রাস্তার বাতিগুলো ৯০ শতাংশ কার্যকর করব। কবরস্থান সংস্কার করতে হবে। আমার বাবা বেশ কিছু কাজ করেছিলেন। হাসপাতালগুলো বেহাল অবস্থায় আছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। দিবাযত্ন কেন্দ্র, পাঠাগার, পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো কার্যকর করতে হবে। ফুটওভারব্রিজ-ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। সেগুলো দ্রুত শেষ করা দরকার।
কালের কণ্ঠ : যানজট দূর করার জন্য কী ব্যবস্থা নেবেন?
সাঈদ খোকন : এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। টোকিও-কলকাতায় এখন যানজট নিরসন হয়েছে। তারা পেশাজীবীদের নিয়োগ করেছিল।
কালের কণ্ঠ : শিক্ষাব্যবস্থাসহ নাগরিক সেবার বিভিন্ন দিক আছে, সেই বিষয়গুলো কিভাবে সমাধান করবেন?
সাঈদ খোকন : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাইমারি শিক্ষার ব্যবস্থাও করে সিটি করপোরেশন। আমাদের এখানে এর ব্যতিক্রম। আমি নির্বাচিত হতে পারলে শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করব। সিটি করপোরেশন তার প্রতিটি ওয়ার্ডে শিশু শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমার বাবা পুরান ঢাকায় মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি আমার বাবার মতো শিক্ষার বিস্তারে কাজ চালিয়ে যাব।
কালের কণ্ঠ : পাতাল রেল চালুর ব্যাপারে কিছু ভাবছেন কি?
সাঈদ খোকন : ঢাকা দক্ষিণে পাতাল রেল করা এত সহজ নয়। দক্ষিণে প্রচুর ঘনবসতি। তবে সেখানে মনোরেল করা যেতে পারে।
কালের কণ্ঠ : পুরান ঢাকার রাস্তাঘাটের দুরবস্থা প্রকট। কিভাবে দূর করবেন?
সাঈদ খোকন : পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট প্রশস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। খুবই কঠিন। আর রাস্তা প্রশস্ত করতে হলে জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে নানাবিধ অসুবিধার মুখে পড়তে হবে। সুতরাং প্রশস্ত করার চেয়ে ভিন্ন উপায় খুঁজতে হবে।
কালের কণ্ঠ : পুরান ঢাকায় রাসায়নিক পদার্থের গুদাম সরানোর ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
সাঈদ খোকন : আমরা নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা ভুলিনি। আর কোনো নিমতলীয় যাতে না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেমিক্যালের গুদামগুলো এখন থেকেই সরিয়ে নিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : ঢাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। এ সমস্যা সমাধানের পথ কী?
সাঈদ খোকন : কমিউনিটি সেন্টার, পাঠাগার এবং লেকসহ বিভিন্ন স্থাপনার সংস্কার ও উন্নয়ন করতে হবে। ধানমণ্ডি লেকের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। তারা রবীন্দ্র সরোবরসহ লেকের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
কালের কণ্ঠ : মহানগরীতে মাদক একটা বড় সমস্যা। এর সমাধানে করণীয় কী?
সাঈদ খোকন : মাদক আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। মাদকমুক্ত সমাজ গঠন করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সিটি পুলিশের কথা বলেছি। সিটি পুলিশ গঠন করে সিটি করপোরেশনের সম্পদ রক্ষা করা থেকে মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সিটি পুলিশ গঠনের কাজটা খুব একটা জটিলও নয়।
কালের কণ্ঠ : সিটি করপোরেশনে দলীয় নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজির অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। এই অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী?
সাঈদ খোকন : দখলবাজ-টেন্ডারবাজদের ব্যাপারে জিরো টলার‌্যান্স হবে। দলবাজরা সিটি করপোরেশনের চৌহদ্দিতে ঢুকতে পারবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাঈদ খোকন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.