আওয়ামী লীগ-তাকাতে হবে সামনের দিকে by এমএ করীম

যে আশায় জনগণ মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় আসীন করেছে তা বুঝি আর হচ্ছে না। দেশ একটি আধুনিক সংবিধান পাবে। সাম্প্রদায়িকতার জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে অসাম্প্রদায়িকতার ঘরে পেঁৗছবে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করবে। বাস্তবে তেমন কিছু ঘটছে না।


বেসামরিক ও সামরিক জান্তারা যেভাবে একটি আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংবিধানকে তছনছ করে দিয়েছিল, সেখান থেকে খুব বেশি একটা সরে আসতে পারছে বলে মনে হয় না


১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার 'রোজ গার্ডেনে' ২৫০ থেকে ৩শ' ডেলিগেটের উপস্থিতিতে জন্ম নিল 'আওয়ামী মুসলিম লীগ'। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে সদ্য নির্বাচিত তরুণ নেতা শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকায় সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। তবে কারামুক্ত ছাত্রনেতাদের জোরালো প্রস্তাবে তিনি (বঙ্গবন্ধু) হলেন এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী মুসলিম লীগের যাত্রা এভাবেই শুরু। 'জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫' পুস্তকে 'আওয়ামী লীগের জন্মকথা' শীর্ষক লেখাতে দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও ভাষাসৈনিক অলি আহাদ বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেওয়া উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্মকথাটি তুলে ধরেছেন। 'বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-বাংলাদেশ' ইতিহাসে এ তিনটি নাম অবিনশ্বর, অমলিন। ১৯৫৫ সাল। স্থান ঢাকার 'রূপমহল সিনেমা' হল। সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ' নামকরণের মধ্য দিয়ে দলটি অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। বাঙালি জাতির সকল মহতী অর্জনের নেতৃত্ব ছিল এ দলটি। যার মাঝি ও মহানায়ক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্র্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। জন্মলাভের পর মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, '৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা, '৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং '৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে এ দলের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ক্রমশ এগিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। এ দলের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এ দলটিই উপহার দেয় এ দেশের 'সংবিধান' নামক একটি মহাকাব্যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দলটি আজ এ দেশের গণমানুষের ভাব ও ভাবনার ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে দলটি। জন্মলাভের পর দ্বিতীয়বারের মতো তিনি চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার সরকার গঠন করে এই দলটি। এর মধ্যে দেশের 'সংবিধান' তছনছ করা হয়েছে। ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় এসেছে 'মহাজোট' নামে কিন্তু জনগণ যে আশায় এ দলটিকে ক্ষমতায় আসীন করেছে সেদিকে নৌকা ভাসছে কি?
যে আশায় জনগণ মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় আসীন করেছে (সব কালো অধ্যায় শেষ হবে) তা বুঝি আর হচ্ছে না। দেশ একটি আধুনিক সংবিধান পাবে। সাম্প্রদায়িকতার জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে অসাম্প্রদায়িকতার ঘরে পেঁৗছবে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করবে। বাস্তবে তেমন কিছু ঘটছে না। বেসামরিক ও সামরিক জান্তারা যেভাবে একটি আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংবিধানকে তছনছ করে দিয়েছিল, সেখান থেকে খুব বেশি একটা সরে আসতে পারছে (বর্তমান মহাজোট সরকার) বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বহাল রাখার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় যেভাবে কেউ কেউ সমালোচনার মুখে পড়েছেন, বড়ই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। এ রকম ভর্ৎসনা করতে দেখা গেছে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে তার সিনিয়র সহকর্মীদের। 'ধর্মের' নামে রাজনীতি করতে গিয়ে এই উপমহাদেশ আধুনিক রাজনীতি থেকে ধসে পড়ছে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উপমহাদেশের এই তিনটি দেশ ধর্মের নামে অপরাজনীতির সাগরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়ন সবকিছু থেকে পিছিয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানী বা সুশীল সমাজ যে কেউই নিদ্বর্িধায় স্বীকার করবেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রে ও আধুনিক রাজনীতিতে ধর্ম রাজনীতিও রাষ্ট্রের সহায়ক নয়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্ম জুড়ে দিলে পৃথিবীর কোনো দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষার উন্নতি ঘটেছে, এমন কোনো নজির নেই। সবারই জানা, উন্নয়নের সঙ্গে উদারনীতি জড়িত। রাষ্ট্র যত উদার হবে তত বেশি টেকসই হবে সামাজিক উন্নয়ন। এ দেশের জনগণ যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, সরকারের বর্তমান কার্যকলাপে তা হতাশায় পর্যবসিত হতে চলেছে। মানব সমাজ বহুতা নদী। হতাশার পরেও আশার আলো দেখা যায়। তখন মানুষ মনে করে একদিন না একদিন তাদের সে আশা পূরণ হবেই। কিন্তু সবচেয়ে করুণ ইতিহাস হলো আশা তো বেঁচে থাকে কিন্তু যারা একদিন প্রগতির কথা বলত, আধুনিক রাষ্ট্রের কথা বলত, সমাজতন্ত্রের জন্য জীবন বাজি রাখত, তারা যখন বলেন, 'রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে বহুকাল আমিও কথা বলেছি এবং আন্দোলন করেছি। এখন আমি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ রাখার পক্ষপাতী।' তখনই বলতে হয় হায়রে কপাল। শুধু শেখ হাসিনাকে দায়ী করে লাভ নেই। প্রায় ত্রিশ বছর সামরিক বা বেসামরিক ছদ্মাবরণে সামরিক শাসনের ছাতার নিচে থাকার ফলে জনগণ যেন বিস্মৃতপ্রায়। আমার বড় ভাই একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে নওগাঁ যান গ্রামের জনসাধারণের চিকিৎসা সেবা দিতে। তিনি হঠাৎ করে সেদিন ফোনে জানতে চাইলেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ সংবিধানে রাখা-না রাখার ব্যাপারে মতামত। আমি না রাখার পক্ষে মত দিলে তিনি বললেন, 'তত্ত্বগত কথা বাদ দিয়ে বাস্তবতার দিকে ফিরে আয়। গ্রামে তো যাস না। গেলে বছরে একবার। ষাট না সত্তর দশকের জনগণ আর এখনকার জনগণের সীমারেখা টানা যায়। তাদের সাল্ফপ্রদায়িকতার আফিম খাওয়ানো হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলরা এমনভাবে তৎপর, তারা মনে করে শেখ হাসিনা বিধর্মীদের কথায় এগুলো তুলে দিচ্ছে। শেখ হাসিনা ইসলামের বিরোধী।' জনগণের মধ্যে এমনভাবে সাল্ফপ্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি উত্তরে শুধু এটুকু বললাম, 'এদেশের তরুণরা যখন জেগে উঠবে তখন কিন্তু এ ধরনের মানসিকতা থাকবে না। জনগণের মধ্য থেকে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করা যেত তা হলে কারও শক্তি ছিল না সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ রাখার। এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে একমাত্র তরুণ সমাজ। তারাই পারে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে বাধ্য করতে আধুনিকতার পথ ধরতে। আরব বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আধুনিক ও উদার রাষ্ট্রের জন্য সেখানকার তরুণ সমাজ সংঘবদ্ধ হচ্ছে, আন্দোলন করছে, সফলতাও পাচ্ছে। আমাদের দেশের তরুণ সমাজ আগের মতো (ষাট, সত্তর ও আশি দশকের) আর সংঘবদ্ধ নয়। কিন্তু যে রাজনীতিকরা আজ সাহস পাচ্ছেন না ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বাদ দিতে, তারা কিন্তু সাহসী হতে বাধ্য হবেন যখন এখানকার তরুণ সমাজ সংঘবদ্ধ হবে একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে (আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে)। যদি দেশের শহীদ মিনার চত্বর, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ মাঠে তরুণদের পদভারে প্রকম্পিত হতো, তা হলে কিন্তু বদলে যেত বর্তমান রাজনৈতিক ধারা। কিন্তু এই তরুণ সল্ফপ্রদায় এখনও জেগে ওঠেনি। এদের জাগানোর দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। যেমনভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সে দিন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাকে লাখ লাখ তরুণ মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। কলাপাতা সবুজের মাঝে লাল রঙ আমাদের মনে করিয়ে দেয় লাখ লাখ জনগণের রক্তের কথা। যার উষ্ণতার মাঝে উদয় হয়েছিল একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের। আর যারা এ আধুনিক রাষ্ট্রকে হত্যা করেছিল, তারা রাজনীতিকে ধর্মের বর্ম পরিয়ে সে কাজ করেছিল। উন্নত জীবন, উন্নত সমাজ জীবন পেতে হলে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ অপরিহার্য। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতি চান। তার কথায়, 'এ মুহূর্তে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বাদ দেওয়ার মতো বাস্তবতা নেই। পারে যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সে কাজ করবে।' কিন্তু তিনি নিজে এখন সে পথে এগোতে সাহস পাচ্ছেন না। কিন্তু আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব বঙ্গবন্ধু (দু'জন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপের সময়) বলেছিলেন, 'স্বাধীন বাংলাদেশেও সেক্যুলার বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষাকারী হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি এই ধর্মনিরপেক্ষতার চারা বাংলাদেশের মাটিতে পুঁতে রেখে গেলাম। যদি কেউ এই চারা উৎপাটন করে তা হলে বাঙালি জাতির স্বাধীন অস্তিত্বই সে বিপন্ন করবে' (কলকাতার দৈনিক যুগান্তর, ২৯ নভেম্বর ১৯৭২)। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এ বাণীকে পাথেয় করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নৌকার মাঝি হবেন, 'আওয়ামী মুসলিম লীগের' নয়।

অধ্যাপক ডা. এমএ করীম : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.