আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪১)-নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ভেলা by আলী যাকের

রিদপুরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের কনিষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার এক খালার। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে যখন আমি দুই মাস সেখানে ছিলাম, সে সময় এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। আমার খালুর নাম ছিল তারা মিয়া। তাঁর বড় দুই ভাই চৌধুরী ইউসুফ আলী মোহন মিয়া এবং তাঁর অগ্রজ লাল মিয়া। চৌধুরী ইউসুফ আলীর বড় ছেলেই চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন।


তারা মিয়ার এক মেয়ে, যাকে 'নানি্ন আপা' বলে ডাকতাম, মোটামুটি ভালোই রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তাঁর গাওয়া একটি গান এখনো কানে বাজে, 'তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী; আমি অবাক হয়ে শুনি।' প্রতি সন্ধ্যায় দিদির টেপাখোলার বাড়িতে এ রকম গানবাজনার আসর বসত। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না তাতে। ওই বাড়ির দোতলায় বারান্দার সঙ্গে একটি খোলা ছাদ ছিল। সেই ছাদেই আমরা সবাই মিলে যেমন-তেমন করে গান গাইতাম, গান শুনতাম। শর্ষের তেলে মাখানো মুড়িও সেই আসরে অমৃতের মতো লাগত। মাঝেমধ্যে টেপাখোলা লঞ্চঘাটের আশপাশের নদীর ধারে ঘুরে বেড়াতাম আমরা সবাই। দুলাভাইয়ের কল্যাণে পুরনো দিনের জমিদারবাড়ি দেখা হয়েছে ফরিদপুরের অনেক ছোটখাটো গ্রামে। সেসব স্মৃতি অম্লান রয়েছে আজও। এই টেপাখোলায় সরাসরি যেতে হলে সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে বিক্রমপুরের মধ্য দিয়ে ছোটখাটো নদী পেরিয়ে অবশেষে বিশাল পদ্মা পাড়ি দিতে হতো। অপর পাশেই ছিল ফরিদপুর। একাধিকবার ওই পথে ফরিদপুর গেছি আমি। সাধারণত ছোট দোতলা লঞ্চে করে ওই পথে যাতায়াত করতে হতো। পথে কলাকোপা-বান্দুরা গ্রামে লঞ্চ থামত একবার। কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতিও থাকত। একবার আমি লঞ্চ থেকে নেমে ঘাটের কাছে ছোট ছোট স্থাপনাগুলো দেখেছিলাম, এখনো মনে পড়ে। পরবর্তী সময়ে যে স্কুল-কলেজে পড়েছি, তার পরিচালকদের একটি মূল কেন্দ্র ছিল বান্দুরা। এদের বলা হতো 'হলিক্রস মিশন'। তাদের বেশ কিছু সুদৃশ্য নির্মাণ রয়েছে ওখানে। বিক্রমপুরের মধ্য দিয়ে গোটা পথটাই ভারি সুন্দর ছিল। জানি না, এখন কেমন আছে।
মনে আছে একবার মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওই পথে। ভরা বর্ষা তখন। বিক্রমপুরের ছোট নদী ছাড়িয়ে পদ্মায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল, কালো মেঘের সঙ্গে উদ্দাম হাওয়ায় পদ্মা হয়ে উঠেছে যেন এক হিংস্র সমুদ্র। আমাদের ছোট লঞ্চ সেই ঢেউয়ে হঠাৎ অনেক ওপরে উঠে আবার নদী বক্ষে আছড়ে পড়তে লাগল। সারেং চিৎকার করে বলতে লাগল, 'আপনারা কেউ ডেকে থাকবেন না। নিচে নেমে যান।' মাঝনদীতে যাওয়ার পর সেদিন মনে হয়েছিল, নিশ্চিত সলিল সমাধি হবে আজ পদ্মায়। আমি খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারি তখন। আগেই বলেছি, ব্রজেনদার কাছে সাঁতার শিখেছি আমি। আমার যত ভয় মাকে নিয়ে। মা সাঁতার জানেন না। বিড়বিড় করে কোরআনের কোনো আয়াত পড়ছেন আর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরছে জল। এর মধ্যে যাত্রীদের কেউ হঠাৎ দাঁড়িয়ে আজান দিতে লাগল। এই আজান যেন আরো ভয়ের আবহ সৃষ্টি করল তখন। ওদিকে আমাদের সারেং বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ভয়ের কিছু নেই, কিছু হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মৃত্যুভয়ে সবাই তখন যে যার মতো করে তার ঈশ্বরকে স্মরণ করছে অথবা হাউমাউ করে কাঁদছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড়ের দাপট কমে এল। আমাদের সারেংয়ের মুখে হাসি ফুটল। যাত্রীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যত দূর মনে পড়ে, ফরিদপুরে থাকতেই দুলাভাই সরকারি চাকরি থেকে ডেপুটেশনে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তারপর ক্রমে আমেরিকা থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করে এসে পুরোপুরি অধ্যাপক বনে যান। দিদির ময়মনসিংহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে একাধিকবার গেছি আমরা সবাই। ক্যাম্পাসটা ভারি সুন্দর লাগত আমার। বাগান, গাছপালা, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র_সব নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। ছুটিছাঁটা পেলেই দিদির কাছে ছুটে যেতাম। অতীতের কথা ভাবলে এখন মনে হয় যে সেই সময় আদি ময়মনসিংহ শহর আর ইউনিভার্সিটি টাউন_এ দুটো সমান্তরালে অবস্থান করত। প্রায় রেললাইনের মতোই। একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সম্পর্কই ছিল না যেন। অথচ সেই সময় ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বোধ করি সবচেয়ে ঋদ্ধ ছিল। ধ্রুপদী সংগীতের, আমার শোনা, সব বাঙালি শিল্পীর সেরা আভাদি, পরবর্তী সময়ে আভা আলম, তখন ময়মনসিংহের আকাশ আলো করে ছিলেন। আরো ছিল নাহা পরিবার, হোম রায় এবং সবার ওপরে বাংলাদেশের প্রধান শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষক মিথুন দে। তাঁরা সবাই ময়মনসিংহ শহরে ছিলেন; কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যখন গেছি তখন তাঁদের সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। অবশ্য আমিও যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খুব একটা জড়িয়ে ছিলাম, তা নয়। কাজেই একেবারে অজ্ঞ ছিলাম ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে। পরে যখন ওয়াহিদ ভাই_ওয়াহিদুল হকের সানি্নধ্যে এলাম, কর্মী হিসেবে ছায়ানটে যাতায়াত শুরু হলো, তখন আরো বিশদভাবে জেনেছি ময়মনসিংহ সম্পর্কে, মুক্তাগাছা সম্পর্কে। বাংলাদেশের ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় বড় ওস্তাদরা এসেছেন ভারতের বিভিন্ন কোণ থেকে তাঁদের ধ্রুপদী সংগীতের ঐশ্বর্য বিলাতে। ময়মনসিংহে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের কোলঘেঁষে অপরূপ দৃশ্যরাজি বিরাজ করত তখন। শরতে মাথার ওপরে ঘন নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ভেলা। আর নিচে ব্রহ্মপুত্রের ধারে আদিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের মেলা আমাকে প্রায় পাগল করে দিত। সেই টানে কত দুপুর আমি কাটিয়েছি পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ধারে, তার হিসাব রাখা ভার।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.