গণমাধ্যম-শিশুদের জন্য বাংলায় বিনোদন চাই by শওকত আলী

রীফ উদ্দিন গত ২২ নভেম্বর ২০১১ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘শিশুমন: সমস্যার নাম ডোরেমন’ শীর্ষক প্রতিবেদন পড়ে অনলাইনে প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। তিনি তাঁর আদরের ছোট্ট মেয়েটিকে শত চেষ্টা করেও ‘বাবা’ ডাকাতে পারছেন না। ঘুরেফিরে মেয়ে তাঁকে ‘পাপা’ বলেই ডাকছে। মেয়ে এতেই ক্ষান্ত নয়, বরং এই শীতের প্রকৃতি দেখে বাবাকে বলছে, ‘পাপা, বাহার ইতনা ঠান্ডি কিউ হ্যা?’ হতভম্ব বাবা অবাক বিস্ময়ে কেবল মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।


ভেতরে বাঙালিত্বের অহংটি ভেঙে চুরমার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ডিশ লাইনটা কেটে দিতে হবে বলে মনে মনে সান্ত্বনা খোঁজেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে খেই হারিয়ে ফেলেন।
আমাদের শিশু বিনোদনে কার্টুন-নির্ভরতা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে, কেব্ল সংযোগ আছে এমন বাসাবাড়ির শিশুরা গভীর অনুরাগী হয়ে উঠছে হিন্দি ভাষায় ডাবিং করা নানা কার্টুনের প্রতি। ভুক্তভোগীরা কেউ বলছেন ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাস না করেও তাঁদের সন্তান নিজ বাড়িতে বাংলায় কথা বলতে পারছে না। তারা মাতৃভাষা রপ্ত করার আগেই হিন্দি ভাষায় দীক্ষিত হচ্ছে। হিন্দি আসক্তিতে তাদের ভাষা বদলে যাচ্ছে।
সমস্যার মূল উৎস হিসেবে দেখা যাচ্ছে ‘ডিজনি’ নামের একটি চ্যানেল। এখানে ‘ডোরেমন’ নামের একটি জাপানি কার্টুন সিরিয়াল হিন্দি ভাষায় ডাবিং করে দেখানো হয়। এটা প্রায় সারা দিনমানই চলে। শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়ার অনেক গুণগত উপাদান হয়তো কার্টুনটির মধ্যে আছে। আবার মন্দ দিক নিয়েও অনেক জোরালো যুক্তি-বিতর্ক আছে। সমস্যা বিষয়বস্তুতে যতটা না, তার চেয়ে বেশি সমস্যা বেঁধেছে ‘ভাষা’ শিক্ষা আর স্বদেশি সংস্কৃতির ‘আদর্শ’ নিয়ে। শিশুরা এই সিরিয়ালের বিভিন্ন চরিত্রকে হুবহু নকলের চেষ্টায় লিপ্ত। বিশেষ করে, ডোরেমন ও নবিতার চরিত্র ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গেও শিশুরা এসব চরিত্র নিয়ে নিজেদের মতামত বিনিময় করছে। ভুক্তভোগী অভিভাবকেরা এই বিপজ্জনক সমস্যার সমাধান হাতড়ে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।
কেব্ল টিভি নেটওয়ার্ক তথা, প্রধান সব স্যাটেলাইট চ্যানেলের উপমহাদেশীয় কার্যালয় এখন ভারতে। ভারত সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনেই তাদের নিজেদের শিশুদের জন্য ইংরেজি অনুষ্ঠানগুলো হিন্দিতে ডাবিং করে প্রচার করছে। সিএন (কার্টুন নেটওয়ার্ক) নামে যে চ্যানেলটি বাংলাদেশ থেকে দেখা যায়, এর বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনে পাকিস্তান শব্দটা আছে এবং উর্দু ভাষা শোনা যায়। চ্যানেলটা পাকিস্তানি ভার্সন। ডিজনি, নিক, এনিম্যাক্স—এসব চ্যানেল ভারতীয়। এর সব কটির মাধ্যমেই শিশুরা শিখছে হিন্দি অথবা উর্দু ভাষা। বিপজ্জনক হচ্ছে, এসব শিশু হিন্দি বা উর্দু যে বাংলা থেকে পৃথক একটা ভাষা, তা বুঝতে পারে না। নাগরিক জীবনের নানামুখি সীমাবদ্ধতায় বাবা-মায়েরা এই আসক্তি থেকে সন্তানকে বের করে আনতে পারছেন না। বিকল্প কিছু সামনে দিতে না পেরে চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার নিষ্ঠুরতাও দেখতে পারছেন না।
শিশুরা কার্টুন ভালোবাসে। তাদের দেখতে দিতে আপত্তিও নেই। অনেক কাল আগে থেকেই আমাদের শিশুরা কার্টুন দেখে আসছে। এসবের মধ্যে টম অ্যান্ড জেরি, উডি উড পেকার, টারজান—এগুলোতে শিক্ষণীয় তেমন কিছু ছিল না। সেই সব কার্টুন ইংরেজি ভাষায় হওয়ায় এমন আপত্তিও ওঠেনি। শিশুদের পাঠ্যধারায় ইরেজি বিষয়টি থাকায় অভিভাবকেরা এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই নিতেন। কার্টুন এমন বয়সী শিশু দর্শকেরা দেখে, যাদের জীবন বিকাশের বয়স চলছে। তাদের মস্তিষ্কে নতুন ভাষার শব্দবন্ধন, বিকাশ খুব দ্রুত হয়। এটাকে শিশুর প্রাইম ফাউন্ডেশনের সময় বলা হয়। প্রাক-কৈশোরে বাংলার চেয়ে হিন্দি ভাষায় স্বপ্নকল্পনা বেশি চর্চা হলে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবনে মাতৃভাষার বৈকল্য আর পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। নিজ ভাষার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা গোড়ায় না হলে পরে আর ততটা ভালো হয় না।
এদিকে ‘ডোরেমন’ ব্র্যান্ডিং গেঞ্জি, পুতুল, খাতা, কলম, স্কুলব্যাগ ইত্যাদি পণ্যে আমাদের বাজার ছেয়ে গেছে। শিশুরা এই ব্র্যান্ড পণ্যের নেশাগ্রস্ততায় ভুগছে। পারলে জন্মদিনের কেকটাও ডোরেমন ব্র্যান্ডের হওয়া চাই। অসহায় অভিভাবকেরা শিশুর বায়নার কাছে পরাস্ত হয়ে এসব পণ্য কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ভারতের সহযোগী ব্যবসায় বাজারও বিকশিত হচ্ছে। অথচ কী বিস্ময়কর, বাংলাদেশের একটি চ্যানেলও ভারতে দেখানো হয় না। আমাদের চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমান ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের চেয়ে কত খারাপ? কত নিম্নমানের? কতটা অরুচিকর যে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলেও দেখানো সম্ভব নয়? এমন অসম্মানজনক আচরণে আমরা সাধারণ নাগরিকেরা আর কত দিন চুপ করে থাকব? সরকার লজ্জা না পেলেও আমরা নাগরিক হিসেবে লজ্জিত, অপমানিত। প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে সরকার সাংস্কৃতিক বিনিময় বলতে কী বোঝায়? আর কিবা দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে বিনিময় করছে? এ রকম বিনিময়ে দেশের মানুষের আসলে কী লাভ হয়? এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের এখনই পেতে হবে।
বিগত এবং বর্তমান সরকার মিলে দেশে প্রায় দুই ডজন টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। নাগরিকদের অভিযোগ, চ্যানেল অনুমোদনে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। দেশের মানুষ কী ধরনের চ্যানেল দেখতে চায়, তা জানতে কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সচেতন নাগরিকেরা অধিকাংশ চ্যানেলের সংবাদ মান এবং লাইসেন্স প্রদানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আমাদের ক্ষুদ্র আয়তনের একটি দেশে এতগুলো নিউজ চ্যানেল দিয়ে কী উপকার হচ্ছে বা এগুলোর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না?
প্রশ্ন আসে, শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান আমাদের মতো বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করতে কেন পারছি না? কিসের অভাব, কিসের ঘাটতি আমাদের বিটিভি আর চ্যানেল-মালিকদের, যা উত্তরণ করতে আমরা অক্ষম? টাকা, নাকি আরও অন্য কিছুর অভাব? এদিকে বাংলা ডাবিং অনুষ্ঠান একেবারেই যে হচ্ছে না, এমনটাও আর বলা যায় না। অনেক টিভি চ্যানেলই অনুষ্ঠান বাংলায় ডাবিং করে দেখায়, আর আমাদের শিশুদের জন্য ওই রকম কোনো চ্যানেল নেই, যারা ওই রকম অনুষ্ঠান বাংলায় ডাবিং করে দেখাতে পারে।
দর্শক বিদেশি চ্যানেল থেকে যে মাত্রায় বৈচিত্র্য লাভ করে, তেমনি দেশি উদ্যোক্তারাও সহজে এটা করতে পারেন। বাংলাদেশে সব কটি চ্যানেলগুলো চায় তাদের চ্যানেলে থাকবে এ টু জেড সবকিছুই। সিনেমা, নাটক, খবর, টক শো, খেলা, কার্টুন, ধর্ম থেকে শুরু করে সব কিছুই। স্যাটেলাইট মিডিয়াগুলোর এসব একপেশে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সামাজিক প্রভাব কী, তা নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা সরকারকেই করতে হবে। শিশুদের মধ্যে একটি ভেজাল জাতিসত্তা গ্রথিত হলে ভবিষ্যৎ বিচারে বড় ক্ষতিটা কার হবে?
প্রথম আলোর বদলে যাও বদলে দাও মিছিলের পক্ষ থেকে ‘গণমাধ্যমে শিশুদের জন্য বাংলায় বিনোদন চাই’ ইস্যু নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা চাই, দেশের সব টেলিভশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকার যৌথভাবে এ বিষয়ে একটি কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। শিশু বিনোদনে সৃষ্ট হিন্দি-আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রকৃত সমাধান কী হওয়া উচিত? আমাদের শিশুদের জন্য চ্যানেলগুলোর দায়বদ্ধতা কী হবে, কী ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার করা উচিত, শিশুদের কার্টুন হিন্দিতে না বাংলা ভাষায় চলবে, দেশের শিশুদের জন্য পৃথক বিশেষায়িত চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তাদের মধ্যে স্বদেশি চেতনার বিকাশ বিভাবে ঘটানো, টেলিভিশন স্যাটেলাইটে শিশু বিনোদনে একটি সার্বজনীন রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি কি না? এ মুহূর্তে কী করণীয়? এসব বিষয় নিয়ে একটি অর্থবহ আলোচনা, প্রস্তাব ও সুপারিশ প্রণয়নে সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কেননা, সাধারণ নাগরিকেরাই এর ভুক্তভোগী। আপনাদের সবার কাছে শিশুদের কল্যাণের জন্য www.bodlejaobodledao.com ওয়েবসাইটে লিখতে আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদের পরামর্শ, সুপারিশ আমরা পর্যায়ক্রমে প্রথম আলোর মূল কাগজেও প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রথম আলো আপনাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে না পারলেও আপনাদের যেকোনো সংগ্রামে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে সব সময় পাশে থাকবে। আমাদের যতটুকু দায়িত্ব, তার শতভাগ উজাড় করে দিতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
শওকত আলী: সমন্বয়ক, বদলে যাও বদলে দাও মিছিল। প্রথম আলো।
shawkat1404@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.