অরণ্যে রোদন-জনতা কী চায় আর নেতারা কী করেন? by আনিসুল হক
আমি সব সময় বলি, আমরা, দেশের সাধারণ নাগরিকেরা, এক দিনের রাজা। বছরের পর বছর ধরে ওই একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করি, যে দিনটা একান্তই আমার। যে দিন পরম শক্তিধর গডফাদার কিংবা দণ্ডমুণ্ডের কর্তাও আমার সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়ান, সুন্দর করে হাসেন এবং আমার কৃপা প্রার্থনা করেন। আমি প্রবেশ করি একটা গোপন ঘরে,
আমার হাতে থাকে একটা সিল, একটা ব্যালট বাক্স, আমি আমার নিজের ইচ্ছামতো ভোট দিই, আমার এত দিনের রাগ-ক্ষোভ-বঞ্চনা—অবমাননার শোধ নিই। কিংবা একটা নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে কারও প্রতি আমার সমর্থন ব্যক্ত করি। আমি সেদিন রাজা, কারণ আমি রাজা বানাই।
আমরা এভাবেই একবার এ দল আরেকবার ও দলকে ক্ষমতায় এনেছি। আগের মেয়াদেই যারা পেয়েছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, পরেরবারেই তাদের আর এক-চতুর্থাংশ আসনও থাকে না।
আমাদের খুব কষ্ট হয়, অবমাননা হয়, যখন আমাদের এক দিনের রাজার ওই সম্মানটুকুও কেউ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ২০০৬ সালে নিজেদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার সময় বিএনপি-জামায়াত তা-ই করার চেষ্টা করেছিল। তারা নিজেদের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বানানোর জন্য সংবিধান সংশোধন করেছিল, নিজেদের লোককে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে রেখেছিল এবং অবশেষে নিজেদের রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে একটা প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যাচ্ছিল। সেই নির্বাচন হয়নি। দুই বছর পরে একটা দিন এল, যেটা কিনা জনগণের দিন। মানুষ তার এত দিনের অপমানের শোধ নিল। ভোটের জোয়ারে ভেসে গেল বিএনপি-জামায়াত চক্র।
কিন্তু তা থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। সংবিধান সংশোধিত হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তাতে নেই। মানুষের এক দিনের রাজা হওয়ার ক্ষমতাটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলেই মনে হয়।
এরই প্রেক্ষাপটে এল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। মেয়র পদে তিনজন প্রধান প্রার্থী; দুজন আওয়ামী লীগের, একজন বিএনপির। এর মধ্যে একজনের ভাবমূর্তি খুবই খারাপ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য যে কজন গডফাদারের কুখ্যাতিকে কারণ বলে মনে করা হয়, তিনি তাঁদেরই একজন। তাঁকেই কিনা আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়ে বসল! অন্য আওয়ামী লীগারের ভাবমূর্তি খুবই পরিচ্ছন্ন। তিনি চিকিৎসক, ২০০৩ সালে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন মানুষের ভোটে। সাংবাদিক এবিএম মূসা সূত্রে জেনেছি, তিনি তাঁর বাবার ভাঙাবাড়িতে থাকেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের মমতা ব্যানার্জি। বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধেও নানা রকমের মামলা আছে আর ভোটের মাঠে তিনি কোনো রকমের আওয়াজ তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদক, মন্ত্রীরা শামীম ওসমান সমীপে যাচ্ছেন, তাঁর প্রতি দলের সমর্থন ব্যক্ত করে আসছেন। সারা দেশের মানুষের চোখ তখন নারায়ণগঞ্জের দিকে, আওয়ামী লীগ এটা কী করল? একজন ত্যাগী জনপ্রিয় উজ্জ্বল ভাবমূর্তির প্রার্থীকে বাদ দিয়ে একজন বিতর্কিত লোককে কেন তারা সমর্থন দিচ্ছে? তাহলে কি এ দেশে ভালোমানুষের কোনো জায়গা নেই? অন্ধকারের কাছে চিরদিন হেরে যাবে আলো?
না, মানুষ ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছিল। আসুক সেই দিনটা, যেদিন আমরা এসব ব্যাপারে আমাদের রায় জানিয়ে দেব। কিন্তু হঠাৎ করে এল অশনি সংকেত। নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করার কথা ঘোষণা করেছে, সব ঠিকঠাক, সেনাবাহিনীর ইউনিট মাঠে নামার জন্য তৈরি। এই সময়ে জানা গেল, সরকার চাইছে না, তাই সেনাবাহিনী নিয়োজিত হচ্ছে না। খবরটা শুনে আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম; ভাবছিলাম, এই দেশে কি তাহলে থাকা যাবে না? এটা কিসের ইঙ্গিত? সরকার কী বার্তা দিতে চায়? তাহলে কি এরশাদ আমলে যেমন করে কেন্দ্র দখল করে ভোট করা হতো, তা-ই করা হবে? ভোট যে মার্কাতেই পড়ুক না কেন, ফল ঘোষণার সময় সরকার তার নিজের প্রার্থীকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করবে? তা করা হলে দেশ রক্তারক্তির দিকেই কেবল যাবে। দ্বিতীয়ত, এটা সংবিধান ও আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশন যা বলবে, তা মানতে সাংবিধানিকভাবে সরকার বাধ্য। সরকার যদি তা না করে, তাহলে কমিশন কী করতে পারবে? তার তো নিজের পুলিশ, নিজের বাহিনী নেই। কমিশন আদালতে যেতে পারে। আদালতের সিদ্ধান্ত যদি সরকার না মানে? তাহলে যা হয়, তার নাম নৈরাজ্য। আমরা কি তাহলে নৈরাজ্যের যুগে প্রবেশ করলাম? এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না বলে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছি, সেই প্রতিজ্ঞা কি রাখা যাবে না? নাকি দেশের ভালোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে লড়াই করে সবাই মিলে মরতে হবে?
এ অবস্থায় নির্বাচন হয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী যে একতরফাভাবে ভোট পাবেন, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ ছিল না। সেটা তৈমুর সাহেব থাকলেও হতো। ভোটে মানুষ তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, তারা ভালোর পক্ষে। এবং এখনো দেশের অসাম্প্রদায়িক শান্তিপ্রিয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ এবং সারা বিশ্বের সঙ্গে ডিজিটালি যুক্ত তরুণ প্রজন্ম মনে করে, আওয়ামী লীগের বিকল্প জামায়াত এবং অবক্ষয়িত বিএনপি নয়। খারাপ আওয়ামী লীগের বিকল্প কী, নারায়ণগঞ্জের মানুষ সেটাই দেখিয়ে দিল। আইভীর পক্ষে ফেসবুকে অনেক পাতা খোলা হয়েছিল, গ্রুপ হয়েছিল, একটু পরপর আইভীর পক্ষে ভোট চেয়ে বার্তা এসেছে ফেসবুকে। এটা তরুণ প্রজন্ম নিজের গরজে নিজের উদ্যোগে করেছে। এই বার্তাটা কি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা শুনতে পাচ্ছেন?
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে মানুষের ভোটেই জয়লাভ করতে পারবে, যদি তারা ১) ব্যর্থ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খারাপ ভাবমূর্তির নেতা-মন্ত্রীদের অপসারিত করে ভালো, সৎ, যোগ্য, দক্ষ নেতা-মন্ত্রীদের সামনে আনে। ২) ৩০০ আসনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো ভালো মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ, সৎ মানুষকে মনোনয়ন দেয়। ৩) বিশ্বাস করে যে ভোট আমেরিকা দেয় না, ভারত দেয় না, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন দেয় না, গুন্ডাপান্ডা সন্ত্রাসীরা দেয় না; ভোট দেয় সাধারণ মানুষ। নিরস্ত্র, ভাষাহীন মানুষ। তারা দলে দলে যায়, একা একা ভোট দেয় এবং পাল্টে দেয় ক্ষমতার দাবাখেলার সব চাল। তারাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালকে উল্টে দিয়েছিল। বারবার তারা এটা প্রমাণ করেছে। ৪) গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের বক্তব্যকে একটুখানি আমলে নেয়। (সরকারের এজেন্সিগুলো সব সময়ই সরকারকে তাই শোনায়, যা সরকার শুনতে চায়। এবারও নাকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিবেদন দিয়েছিল, আইভী আর শামীম ওসমানের মধ্যে শামীম ওসমানের জনপ্রিয়তা একটু বেশি। এ রকম ভুল খবর ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে সংস্থাগুলো সরকারকে দিয়েছিল) ৫) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিকে আবার ফিরিয়ে আনে।
কিন্তু আমরা জানি, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করবে না। সরকার এই জয়কে আওয়ামী লীগেরই জয় বলে হজম করে ফেলবে। ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারিত করা হবে না। গডফাদাররা থাকবে, নতুন নতুন গডফাদার, নতুন নতুন ভূমিদস্যু নতুনতর দস্যুবৃত্তিতে মত্ত হয়ে উঠবে এবং জনগণ ত্রাহি ত্রাহি করতে থাকবে। আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ রাখা হবে না এবং গুন্ডাপান্ডা দিয়ে নির্বাচন করার চেষ্টা করা হবে। এর একমাত্র পরিণতি হবে রাজনৈতিক হানাহানি। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত হবে, এমনকি গণতন্ত্রও ব্যাহত হতে পারে। সেটা কারও জন্যই ভালো হবে না। আমি এই কথা ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বলেছি, পরেও বলেছি, এখনো বলছি, আবারও বলব—গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই, গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র, আর সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও সবচেয়ে ভালো স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে ভালো।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য ভালো হতো, যদি আওয়ামী লীগ আগেই সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দিত অথবা কারও প্রতিই সমর্থন ব্যক্ত না করত। এর পরে উচিত ছিল, নির্বাচন কমিশনের চাওয়া সেনা মোতায়েনের কাজটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে ও নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে সুসম্পন্ন করা। তাতে আজকে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল থাকত, তাদের জন্য রাজনীতি অনেক সহজ হয়ে যেত। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল এ ক্ষেত্রে ভুল করেছে এবং আইন অমান্য করেছে। এর ফল কী দাঁড়ায়, সামনে আমরা দেখতে পাব।
কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা যারা ক্ষমতা-কাঠামোর অংশ নই, তাদের জন্য আজকের প্রহর একটা আলোকিত প্রভাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা আবার এই দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নে আস্থাশীল হতে পারছি। কারণ, আমরা দেখছি, দেশের মানুষ ভালোর পক্ষে, আলোর পক্ষে। দেখছি, জনগণের জোয়ারের কাছে সব ষড়যন্ত্র, সব অন্ধকারের শক্তি খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। আমরা দেখছি, মানুষের পরাজয় নেই। ১৯৮৬ সালে, তখন আমি বুয়েটে পড়ি, আমার ২১ বছর বয়স, ঘোরতর সামরিক শাসনের কালে একটা কবিতা লিখেছিলাম, যেটা এখনো আবৃত্তিকারেরা আবৃত্তি করে থাকেন:
মানুষের জাগরণে অবিশ্বাস করো না মানুষ
মানুষের উদ্বোধনে অবিশ্বাসী হয়ো না মানুষ
মানুষের উজ্জীবনে আস্থাহীন হয়ো না সারথী
মানুষ জাগবে ফের। (‘মানুষ জাগবে ফের’, খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে)
২৫ বছর পরেও মানুষের জাগরণের শক্তিতে, সম্মিলিত মানুষের বিপুল বিশাল অসম্ভব সুন্দর বিক্রমে আমার আস্থা এতটুকু কমেনি। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত রেখে নীরবে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে মানুষ তার বদলে দেওয়ার ক্ষমতার একটা ছোট্ট কিন্তু সুন্দর রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। আর ভোটের ফল ঘোষণার সময় শহীদ জিয়া হলের সামনে সমবেত হাজার হাজার মানুষের হর্ষোল্লাসে এত দিনের চাপা দিয়ে রাখা বেদনা যেন বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো প্রকাশিত হতে আমরা দেখেছি।
আমাদের নেতাদের বলি, কোটি হূদয়ের এই অব্যক্ত বেদনার ভাষ্য পাঠ করার চেষ্টা করুন। ক্ষমতার লৌহবর্মবেষ্টিত শিখরাসীন পাষাণ হূদয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর কি এবারও পৌঁছাবে না?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আমরা এভাবেই একবার এ দল আরেকবার ও দলকে ক্ষমতায় এনেছি। আগের মেয়াদেই যারা পেয়েছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, পরেরবারেই তাদের আর এক-চতুর্থাংশ আসনও থাকে না।
আমাদের খুব কষ্ট হয়, অবমাননা হয়, যখন আমাদের এক দিনের রাজার ওই সম্মানটুকুও কেউ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ২০০৬ সালে নিজেদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার সময় বিএনপি-জামায়াত তা-ই করার চেষ্টা করেছিল। তারা নিজেদের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বানানোর জন্য সংবিধান সংশোধন করেছিল, নিজেদের লোককে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে রেখেছিল এবং অবশেষে নিজেদের রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে একটা প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যাচ্ছিল। সেই নির্বাচন হয়নি। দুই বছর পরে একটা দিন এল, যেটা কিনা জনগণের দিন। মানুষ তার এত দিনের অপমানের শোধ নিল। ভোটের জোয়ারে ভেসে গেল বিএনপি-জামায়াত চক্র।
কিন্তু তা থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। সংবিধান সংশোধিত হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তাতে নেই। মানুষের এক দিনের রাজা হওয়ার ক্ষমতাটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলেই মনে হয়।
এরই প্রেক্ষাপটে এল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। মেয়র পদে তিনজন প্রধান প্রার্থী; দুজন আওয়ামী লীগের, একজন বিএনপির। এর মধ্যে একজনের ভাবমূর্তি খুবই খারাপ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য যে কজন গডফাদারের কুখ্যাতিকে কারণ বলে মনে করা হয়, তিনি তাঁদেরই একজন। তাঁকেই কিনা আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়ে বসল! অন্য আওয়ামী লীগারের ভাবমূর্তি খুবই পরিচ্ছন্ন। তিনি চিকিৎসক, ২০০৩ সালে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন মানুষের ভোটে। সাংবাদিক এবিএম মূসা সূত্রে জেনেছি, তিনি তাঁর বাবার ভাঙাবাড়িতে থাকেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের মমতা ব্যানার্জি। বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধেও নানা রকমের মামলা আছে আর ভোটের মাঠে তিনি কোনো রকমের আওয়াজ তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদক, মন্ত্রীরা শামীম ওসমান সমীপে যাচ্ছেন, তাঁর প্রতি দলের সমর্থন ব্যক্ত করে আসছেন। সারা দেশের মানুষের চোখ তখন নারায়ণগঞ্জের দিকে, আওয়ামী লীগ এটা কী করল? একজন ত্যাগী জনপ্রিয় উজ্জ্বল ভাবমূর্তির প্রার্থীকে বাদ দিয়ে একজন বিতর্কিত লোককে কেন তারা সমর্থন দিচ্ছে? তাহলে কি এ দেশে ভালোমানুষের কোনো জায়গা নেই? অন্ধকারের কাছে চিরদিন হেরে যাবে আলো?
না, মানুষ ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছিল। আসুক সেই দিনটা, যেদিন আমরা এসব ব্যাপারে আমাদের রায় জানিয়ে দেব। কিন্তু হঠাৎ করে এল অশনি সংকেত। নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করার কথা ঘোষণা করেছে, সব ঠিকঠাক, সেনাবাহিনীর ইউনিট মাঠে নামার জন্য তৈরি। এই সময়ে জানা গেল, সরকার চাইছে না, তাই সেনাবাহিনী নিয়োজিত হচ্ছে না। খবরটা শুনে আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম; ভাবছিলাম, এই দেশে কি তাহলে থাকা যাবে না? এটা কিসের ইঙ্গিত? সরকার কী বার্তা দিতে চায়? তাহলে কি এরশাদ আমলে যেমন করে কেন্দ্র দখল করে ভোট করা হতো, তা-ই করা হবে? ভোট যে মার্কাতেই পড়ুক না কেন, ফল ঘোষণার সময় সরকার তার নিজের প্রার্থীকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করবে? তা করা হলে দেশ রক্তারক্তির দিকেই কেবল যাবে। দ্বিতীয়ত, এটা সংবিধান ও আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশন যা বলবে, তা মানতে সাংবিধানিকভাবে সরকার বাধ্য। সরকার যদি তা না করে, তাহলে কমিশন কী করতে পারবে? তার তো নিজের পুলিশ, নিজের বাহিনী নেই। কমিশন আদালতে যেতে পারে। আদালতের সিদ্ধান্ত যদি সরকার না মানে? তাহলে যা হয়, তার নাম নৈরাজ্য। আমরা কি তাহলে নৈরাজ্যের যুগে প্রবেশ করলাম? এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না বলে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছি, সেই প্রতিজ্ঞা কি রাখা যাবে না? নাকি দেশের ভালোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে লড়াই করে সবাই মিলে মরতে হবে?
এ অবস্থায় নির্বাচন হয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী যে একতরফাভাবে ভোট পাবেন, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ ছিল না। সেটা তৈমুর সাহেব থাকলেও হতো। ভোটে মানুষ তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, তারা ভালোর পক্ষে। এবং এখনো দেশের অসাম্প্রদায়িক শান্তিপ্রিয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ এবং সারা বিশ্বের সঙ্গে ডিজিটালি যুক্ত তরুণ প্রজন্ম মনে করে, আওয়ামী লীগের বিকল্প জামায়াত এবং অবক্ষয়িত বিএনপি নয়। খারাপ আওয়ামী লীগের বিকল্প কী, নারায়ণগঞ্জের মানুষ সেটাই দেখিয়ে দিল। আইভীর পক্ষে ফেসবুকে অনেক পাতা খোলা হয়েছিল, গ্রুপ হয়েছিল, একটু পরপর আইভীর পক্ষে ভোট চেয়ে বার্তা এসেছে ফেসবুকে। এটা তরুণ প্রজন্ম নিজের গরজে নিজের উদ্যোগে করেছে। এই বার্তাটা কি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা শুনতে পাচ্ছেন?
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে মানুষের ভোটেই জয়লাভ করতে পারবে, যদি তারা ১) ব্যর্থ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খারাপ ভাবমূর্তির নেতা-মন্ত্রীদের অপসারিত করে ভালো, সৎ, যোগ্য, দক্ষ নেতা-মন্ত্রীদের সামনে আনে। ২) ৩০০ আসনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো ভালো মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ, সৎ মানুষকে মনোনয়ন দেয়। ৩) বিশ্বাস করে যে ভোট আমেরিকা দেয় না, ভারত দেয় না, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন দেয় না, গুন্ডাপান্ডা সন্ত্রাসীরা দেয় না; ভোট দেয় সাধারণ মানুষ। নিরস্ত্র, ভাষাহীন মানুষ। তারা দলে দলে যায়, একা একা ভোট দেয় এবং পাল্টে দেয় ক্ষমতার দাবাখেলার সব চাল। তারাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালকে উল্টে দিয়েছিল। বারবার তারা এটা প্রমাণ করেছে। ৪) গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের বক্তব্যকে একটুখানি আমলে নেয়। (সরকারের এজেন্সিগুলো সব সময়ই সরকারকে তাই শোনায়, যা সরকার শুনতে চায়। এবারও নাকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিবেদন দিয়েছিল, আইভী আর শামীম ওসমানের মধ্যে শামীম ওসমানের জনপ্রিয়তা একটু বেশি। এ রকম ভুল খবর ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে সংস্থাগুলো সরকারকে দিয়েছিল) ৫) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিকে আবার ফিরিয়ে আনে।
কিন্তু আমরা জানি, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করবে না। সরকার এই জয়কে আওয়ামী লীগেরই জয় বলে হজম করে ফেলবে। ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারিত করা হবে না। গডফাদাররা থাকবে, নতুন নতুন গডফাদার, নতুন নতুন ভূমিদস্যু নতুনতর দস্যুবৃত্তিতে মত্ত হয়ে উঠবে এবং জনগণ ত্রাহি ত্রাহি করতে থাকবে। আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ রাখা হবে না এবং গুন্ডাপান্ডা দিয়ে নির্বাচন করার চেষ্টা করা হবে। এর একমাত্র পরিণতি হবে রাজনৈতিক হানাহানি। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত হবে, এমনকি গণতন্ত্রও ব্যাহত হতে পারে। সেটা কারও জন্যই ভালো হবে না। আমি এই কথা ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বলেছি, পরেও বলেছি, এখনো বলছি, আবারও বলব—গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই, গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র, আর সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও সবচেয়ে ভালো স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে ভালো।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য ভালো হতো, যদি আওয়ামী লীগ আগেই সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দিত অথবা কারও প্রতিই সমর্থন ব্যক্ত না করত। এর পরে উচিত ছিল, নির্বাচন কমিশনের চাওয়া সেনা মোতায়েনের কাজটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে ও নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে সুসম্পন্ন করা। তাতে আজকে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল থাকত, তাদের জন্য রাজনীতি অনেক সহজ হয়ে যেত। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল এ ক্ষেত্রে ভুল করেছে এবং আইন অমান্য করেছে। এর ফল কী দাঁড়ায়, সামনে আমরা দেখতে পাব।
কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা যারা ক্ষমতা-কাঠামোর অংশ নই, তাদের জন্য আজকের প্রহর একটা আলোকিত প্রভাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা আবার এই দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নে আস্থাশীল হতে পারছি। কারণ, আমরা দেখছি, দেশের মানুষ ভালোর পক্ষে, আলোর পক্ষে। দেখছি, জনগণের জোয়ারের কাছে সব ষড়যন্ত্র, সব অন্ধকারের শক্তি খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। আমরা দেখছি, মানুষের পরাজয় নেই। ১৯৮৬ সালে, তখন আমি বুয়েটে পড়ি, আমার ২১ বছর বয়স, ঘোরতর সামরিক শাসনের কালে একটা কবিতা লিখেছিলাম, যেটা এখনো আবৃত্তিকারেরা আবৃত্তি করে থাকেন:
মানুষের জাগরণে অবিশ্বাস করো না মানুষ
মানুষের উদ্বোধনে অবিশ্বাসী হয়ো না মানুষ
মানুষের উজ্জীবনে আস্থাহীন হয়ো না সারথী
মানুষ জাগবে ফের। (‘মানুষ জাগবে ফের’, খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে)
২৫ বছর পরেও মানুষের জাগরণের শক্তিতে, সম্মিলিত মানুষের বিপুল বিশাল অসম্ভব সুন্দর বিক্রমে আমার আস্থা এতটুকু কমেনি। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত রেখে নীরবে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে মানুষ তার বদলে দেওয়ার ক্ষমতার একটা ছোট্ট কিন্তু সুন্দর রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। আর ভোটের ফল ঘোষণার সময় শহীদ জিয়া হলের সামনে সমবেত হাজার হাজার মানুষের হর্ষোল্লাসে এত দিনের চাপা দিয়ে রাখা বেদনা যেন বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো প্রকাশিত হতে আমরা দেখেছি।
আমাদের নেতাদের বলি, কোটি হূদয়ের এই অব্যক্ত বেদনার ভাষ্য পাঠ করার চেষ্টা করুন। ক্ষমতার লৌহবর্মবেষ্টিত শিখরাসীন পাষাণ হূদয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর কি এবারও পৌঁছাবে না?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments