চাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, সুশাসন, আইনের শাসন প্রভৃতি প্রত্যয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ একেকজনের কাছে একেক রকম। যাঁরা এ প্রত্যয়গুলোর তাত্তি্বক সংজ্ঞায়ন করেছেন, তাঁরা এর সঠিক এবং যুগসই বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বিশ্লেষণ সর্বজনীন। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। তাদের ভাবনার মধ্যে রয়েছে নিজের সুবিধার পরিপূর্ণতা।
সময় এবং অবস্থানগত কারণে আমরা সরাসরি উপরিউক্ত প্রত্যয়গুলোর ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন না দিলেও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এগুলোর সঠিক সংজ্ঞাকে উল্টো ফেলে দিই। সাধারণ মানুষের কাছে এ কথাটি যতটা সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দল এবং যাদের 'শ্যাডো সরকার' হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেন. সেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেই। সাধারণ মানুষের ভিন্ন অর্থ খোঁজার সুযোগ খুব কম। তারা সব কিছু জানে এবং বোঝে। কিন্তু কিছু করার সুযোগ থাকে না। ঠোঁট কামড়ে বসে থাকে। অপেক্ষার প্রহর গোনে। এক দিনই সেই সুযোগ আসে। তারপর সব কিছু আগের মতো মনে হয়। সাধারণ মানুষের কাছে গণতন্ত্র মাত্র এক দিন। নির্বাচনের দিন তারা তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীন করে। ভোটাররা আগের ভালোমন্দ বিচার করে। আগেকার সরকারের শাসনকাল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রতিশ্রুতি তাদের ভোটদানে উৎসাহী করে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ হয়। একটি দল কিংবা জোট ক্ষমতাসীন হয়। এর পরই অনেক কিছু পাল্টে যায়। রাতারাতি না হলেও ক্রমান্বয়ে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পালনে ফাটল ধরে। একটি পর্যায় এসে জনগণ হয়তো ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। কে কার কথা শোনে! রাষ্ট্রের বিভিন্ন যন্ত্র ও কৌশলগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব জনগণের হাতে তো থাকে না। থাকাটাও জরুরি নয়। কেননা তারা কিছুসংখ্যক লোকের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। শাসকরা ক্রমান্বয়ে জনগণের কথা ভুলে যান। জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। তাতেও শাসক শ্রেণীর কম যায়-আসে। কেননা পাঁচ বছর কম সময় নয়। এ সময়ের উপার্জিত অর্থ বৈধ কিংবা অবৈধ যে পন্থায়ই হোক না কেন তা দিয়ে বহুদিনের খোরাক জোগানো সম্ভব। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় না আসতে পারলে সমস্যা নেই। এভাবেই আমাদের গণতন্ত্র চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে বলে আমরা ধারণা করতে পারি।
জনগণের কাছে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা_তা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির বিভিন্ন খবর জানতে পারি। মিডিয়াগুলো অহেতুক মিথ্যা খবর তুলে ধরবে_এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা মিডিয়াকে মোটেই মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং মিথ্যা কথা মিডিয়াগুলো প্রচার করছে। মিডিয়াগুলোকে তাঁরা প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেন। তাতে তাঁদের কিছু যায়-আসে না। যে যার অবস্থানে থাকছে এবং থাকবে। মিডিয়াগুলোরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা পারে সঠিক তথ্যটি মানুষের সামনে তুলে ধরতে; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার কোনো সুযোগ মিডিয়ার নেই। আর থাকবেই বা কেন? মিডিয়ার কাজ তো তা নয়। আর এর জন্য এখন মিডিয়াকেও কেউ ভয় পায় না। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা আমাদের রাজনীতিবিদদের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। আমরা নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্য যখন যে কথা বলা উচিত, তাই বলি। নিজের দলে কিংবা সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বে যখন কেউ আহত বা নিহত হন, তখন জানা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষ কাজটি করেছে বলে জোর দাবি করি। আবার অন্য দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে কেউ আহত বা নিহত হলে জোর গলায় বলতে থাকি, এটি ওই দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় খুব কাছ থেকে এ জিনিসটি পর্যবেক্ষণ করেছি। এখনো আমরা এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছি না। তখনো একটি ছাত্রসংগঠন নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করে অন্য সংগঠনের ঘাড়ে এর দায় চাপানোর চেষ্টা করত এবং এখনো করছে।
সম্প্রতি নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যার ক্ষেত্রে আমরা বিভ্রান্ত। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, হত্যাকাণ্ডটি আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের ফসল। এটি হয়তো সত্য। হতেই পারে। আমাদের মতো দেশের রাজনীতিতে বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। বিএনপির দাবিও হত্যাকাণ্ডটি দলীয় কোন্দলের কারণে হয়েছে। কিন্ত আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। বেশ কয়েক মাস আগে নরসিংদী সরকারি কলেজে ছাত্রদলের দলীয় কোন্দলে দলের সাধারণ সম্পাদক খুন হন। তখনকার মিডিয়াও এ কথাটি তুলে ধরেছিল। আমার স্মরণ আসে, তখন বিএনপি দলীয় কোন্দলকে মেনে নেয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপানো হয়েছে। তখন সংসদে দাঁড়িয়ে বিএনপি তীব্র ভাষায় আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করেছে। যখন নিজের দলের কেউ অন্তঃকলহে মারা যায়, তখন অন্যের ওপর দোষ চাপানো এবং যখন অন্য দলের কেউ অন্তঃকলহে মারা যায়, তখন তা জোরালোভাবে বলার ধারা আমরা আর কত দিন দেখব। নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপানোর এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বের হব? রাজনীতির মাঠের এ দ্বৈতনীতির ফলে বহু রাজনীতিবিদ হয়তো লাভবান হন, কিন্তু যাদের মায়ের কোল খালি হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ আদৌ সম্ভব কি? এ জন্যই বলছি, গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, সুশাসন, আইনের শাসনের ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকম। আমি যখন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকি তখন একরকম কথা বলি, আর ভিন্ন অবস্থায় সুর পাল্টে দিই। আমাদের উচিত, রাজনীতির এই ডামাডোল থেকে বেরিয়ে আসা। নইলে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, কিন্তু গণতন্ত্র মজবুত এবং টেকসই হবে কি না সন্দেহ।
একটি দেশের মিডিয়ার কাজ হলো সঠিক তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো তা ভালোভাবেই করছে। সুশীল সমাজের কাজ হলো সরকারের দোষত্রুটি তুলে ধরা। সুশীল সমাজও কমবেশি তা করছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র যদি বিষয়গুলো সহজভাবে না নেয়, তাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এদের প্রতিপক্ষ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এদের ক্ষমতা এক অর্থে সীমিতই। অন্য অর্থে অনেক বড়। সীমিত অর্থে এই জন্য বলছি যে তারা রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে না। তাদের কথায় রাষ্ট্র চলে না। পুলিশ, প্রশাসন_কেউই তাদের কথায় কর্ণপাত করে না। উল্টো তাদের হয়রানি করা হয়। তাদের ক্ষমতা বিশাল এই অর্থে যে তারা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে পাঁচ বছর অতিক্রম করার পর ভোটারদের গণতন্ত্রের দিনে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
জনগণের কাছে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা_তা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির বিভিন্ন খবর জানতে পারি। মিডিয়াগুলো অহেতুক মিথ্যা খবর তুলে ধরবে_এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা মিডিয়াকে মোটেই মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং মিথ্যা কথা মিডিয়াগুলো প্রচার করছে। মিডিয়াগুলোকে তাঁরা প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেন। তাতে তাঁদের কিছু যায়-আসে না। যে যার অবস্থানে থাকছে এবং থাকবে। মিডিয়াগুলোরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা পারে সঠিক তথ্যটি মানুষের সামনে তুলে ধরতে; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার কোনো সুযোগ মিডিয়ার নেই। আর থাকবেই বা কেন? মিডিয়ার কাজ তো তা নয়। আর এর জন্য এখন মিডিয়াকেও কেউ ভয় পায় না। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা আমাদের রাজনীতিবিদদের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। আমরা নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্য যখন যে কথা বলা উচিত, তাই বলি। নিজের দলে কিংবা সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বে যখন কেউ আহত বা নিহত হন, তখন জানা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষ কাজটি করেছে বলে জোর দাবি করি। আবার অন্য দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে কেউ আহত বা নিহত হলে জোর গলায় বলতে থাকি, এটি ওই দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় খুব কাছ থেকে এ জিনিসটি পর্যবেক্ষণ করেছি। এখনো আমরা এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছি না। তখনো একটি ছাত্রসংগঠন নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করে অন্য সংগঠনের ঘাড়ে এর দায় চাপানোর চেষ্টা করত এবং এখনো করছে।
সম্প্রতি নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যার ক্ষেত্রে আমরা বিভ্রান্ত। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, হত্যাকাণ্ডটি আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের ফসল। এটি হয়তো সত্য। হতেই পারে। আমাদের মতো দেশের রাজনীতিতে বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। বিএনপির দাবিও হত্যাকাণ্ডটি দলীয় কোন্দলের কারণে হয়েছে। কিন্ত আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। বেশ কয়েক মাস আগে নরসিংদী সরকারি কলেজে ছাত্রদলের দলীয় কোন্দলে দলের সাধারণ সম্পাদক খুন হন। তখনকার মিডিয়াও এ কথাটি তুলে ধরেছিল। আমার স্মরণ আসে, তখন বিএনপি দলীয় কোন্দলকে মেনে নেয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপানো হয়েছে। তখন সংসদে দাঁড়িয়ে বিএনপি তীব্র ভাষায় আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করেছে। যখন নিজের দলের কেউ অন্তঃকলহে মারা যায়, তখন অন্যের ওপর দোষ চাপানো এবং যখন অন্য দলের কেউ অন্তঃকলহে মারা যায়, তখন তা জোরালোভাবে বলার ধারা আমরা আর কত দিন দেখব। নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপানোর এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বের হব? রাজনীতির মাঠের এ দ্বৈতনীতির ফলে বহু রাজনীতিবিদ হয়তো লাভবান হন, কিন্তু যাদের মায়ের কোল খালি হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ আদৌ সম্ভব কি? এ জন্যই বলছি, গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, সুশাসন, আইনের শাসনের ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকম। আমি যখন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকি তখন একরকম কথা বলি, আর ভিন্ন অবস্থায় সুর পাল্টে দিই। আমাদের উচিত, রাজনীতির এই ডামাডোল থেকে বেরিয়ে আসা। নইলে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, কিন্তু গণতন্ত্র মজবুত এবং টেকসই হবে কি না সন্দেহ।
একটি দেশের মিডিয়ার কাজ হলো সঠিক তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো তা ভালোভাবেই করছে। সুশীল সমাজের কাজ হলো সরকারের দোষত্রুটি তুলে ধরা। সুশীল সমাজও কমবেশি তা করছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র যদি বিষয়গুলো সহজভাবে না নেয়, তাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এদের প্রতিপক্ষ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এদের ক্ষমতা এক অর্থে সীমিতই। অন্য অর্থে অনেক বড়। সীমিত অর্থে এই জন্য বলছি যে তারা রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে না। তাদের কথায় রাষ্ট্র চলে না। পুলিশ, প্রশাসন_কেউই তাদের কথায় কর্ণপাত করে না। উল্টো তাদের হয়রানি করা হয়। তাদের ক্ষমতা বিশাল এই অর্থে যে তারা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে পাঁচ বছর অতিক্রম করার পর ভোটারদের গণতন্ত্রের দিনে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments