শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ইতিহাস পাঠ কেন জরুরি? by পুলক চাকমা
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ও ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। বাংলাদেশের এই গৌরবময় ইতিহাস বিশ্বের ইতিহাসেও বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস দীর্ঘ ৪০ বছরে বিভিন্নভাবে বিকৃত হওয়ার ফলে বর্তমান প্রজন্ম দেশের প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করছে, সেই দায় তাদের। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী বিরূপ ফল ভোগ করবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
ইতিহাস সব সময় তার নিজস্ব গতিতে চলে, কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার। যে জাতির ইতিহাসে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় অধ্যায় রয়েছে, আজ সেই জাতির উত্তরসূরিরা কতটুকু ইতিহাস-সচেতনভাবে গড়ে উঠছে? আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের দিনগুলো কেবল আনুষ্ঠানিকতা পালন বা বিশেষ দিনে পরিণত হচ্ছে কি না সেটি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। কারণ, বর্তমান ইন্টারনেট যুগে ফেসবুকের অবাধ পদচারণায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রটি নতুন প্রজন্মের কাছে কতটুকু চিন্তার জায়গা দখল করতে পারছে তা সমাজবিজ্ঞানীদেরও ভাবিয়ে তুলছে। হয়তো কম্পিউটারের বোতামে চাপ দিলেই গোটা ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিন্তু স্ক্রিনের সেই ইতিহাসের গভীরে পৌঁছার মানসিকতা ও ধৈর্য কয়জনের আছে?
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম মূলত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ারই ফল। এই প্রতিষ্ঠানটি ১২টি বিভাগ নিয়ে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাযাত্রা শুরু করেছিল। এই ১২টি বিভাগের মধ্যে ‘ইতিহাস’ বিভাগটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারকে বিভাগীয় প্রধান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগটি চালু হয়েছিল। ১৯২৯ সালে এই ইতিহাস বিভাগের অধীনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়টিও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাতে গোনা কয়েকটি কলেজে ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসকে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সেই প্রথম চালু করা হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগকে বিভক্ত করে ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামে আরেকটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়। এ ছাড়া ১৯৫২ সালে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানীর প্রচেষ্টায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭২ সালে এটি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়াটিক সোসাইটি তাদের জন্মলগ্ন থেকেই ইতিহাস চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস চর্চা চালু রয়েছে বটে, কিন্তু ইতিহাসের সেই অতীত গৌরব ও জৌলুশ আর নেই। ইতিহাস চর্চার এই দুর্দশার মধ্যেও আমরা আশার ক্ষীণ আলো খুঁজে পাই, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে। ১৯৯০ সালে এই বিভাগটি চালু হওয়ার পর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একমাত্র এই বিভাগটি বাংলার আদি ইতিহাসকে এখনো খুঁজে চলেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস পাঠের বাধ্যবাধকতার নিয়ম চালু নেই। ফলে দেখা যায়, জাতির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস না জেনেই প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইতিহাসজ্ঞানবর্জিত হয়ে পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন, উদার, গণমুখী, প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আর এসবের জন্য দরকার ইতিহাস সচেতনতা। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, বর্তমানে দেশের আটটি জেলার ৩০টি সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক পর্যায়ে এখনো ইতিহাস বিষয় পড়ানো হয় না। এ ছাড়া ৬৮টি সরকারি কলেজ ও তিনটি সরকারি মাদ্রাসায় ইতিহাস শিক্ষকের কোনো পদই নেই! কাজেই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই দৈন্যদশা থেকেই ইতিহাস চর্চার বর্তমান চিত্রটি সহজে অনুমেয়। যদিও বর্তমান শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার কারিকুলামে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস চর্চার বর্তমান দৈন্যদশা এই উদ্যোগেও ঘুচবে কি?
বর্তমানে দেশে মোট ১২২০টি এমপিওভুক্ত কলেজের মধ্যে ৫৮১টিতে ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান হয় না। অন্যদিকে ২২৩৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাদ্রাসার কোনোটিতে ইতিহাস বিষয়ে পড়ানো হয় না। অথচ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান দায়িত্বই হলো ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোলসহ বিভিন্ন বিষয়ে চৌকস করে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এমনকি সম্প্রতি গোপালগঞ্জে জাতির জনকের নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারি কলেজেও (শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ) ইতিহাস বিষয়টি স্থান পায়নি, যেটি খুবই হতাশাজনক।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজকে অনার্স ও মাস্টার্স স্তরে উন্নীত করায় সাধারণ জনগণের কাছে উচ্চশিক্ষার দুয়ার উন্মোচন হয়। কিন্তু দুয়ারে উচ্চশিক্ষা পৌঁছালেও শিক্ষার গুণগতমানের দিকটি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর তুলে দেওয়ায় উচ্চমাধ্যমিকের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে বেসরকারি কলেজগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অধিকাংশ বেসরকারি কলেজের উদ্দেশ্যই থাকে কীভাবে সহজ পন্থায় ছাত্রছাত্রীদের বেশি নম্বর দিয়ে পাস করানো যায়। এই বাণিজ্যিক দৌড়ে ইতিহাস বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে। কারণ, প্রচলিত ধারণামতে ইতিহাস বিষয়ে নম্বর বেশি পাওয়া যায় না। কলেজগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ইতিহাস বিষয়টির প্রবেশাধিকার একদম নেই। বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই মোহনীয় শিক্ষা-বাণিজ্যের অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আজ জিম্মি। যেখানে ছাত্রছাত্রীদের মানবিক গুণাবলি গড়ে তোলার ক্ষেত্রগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে, সেখানে শুধু পরীক্ষায় পাস করানো মানসিকতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ইতিহাস-দর্শনবিহীন শিক্ষা কখনো মানবিক মূল্যবোধকে পুরোপুরিভাবে বিকশিত করতে পারে না। জাতীয় ইতিহাস পঠন ছাড়া কোনো জাতির মধ্যে দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির উন্মেষ ঘটা সম্ভব নয়। তাই ইতিহাস চর্চার সংকুচিত ক্ষেত্রকে বিকশিত করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে ইতিহাস গবেষণার জন্য সরকারি সহযোগিতাও বাড়ানো দরকার।
পুলক চাকমা: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা।
pulakchakma21@gmail.com
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম মূলত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ারই ফল। এই প্রতিষ্ঠানটি ১২টি বিভাগ নিয়ে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাযাত্রা শুরু করেছিল। এই ১২টি বিভাগের মধ্যে ‘ইতিহাস’ বিভাগটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারকে বিভাগীয় প্রধান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগটি চালু হয়েছিল। ১৯২৯ সালে এই ইতিহাস বিভাগের অধীনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়টিও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাতে গোনা কয়েকটি কলেজে ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসকে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সেই প্রথম চালু করা হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগকে বিভক্ত করে ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামে আরেকটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়। এ ছাড়া ১৯৫২ সালে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানীর প্রচেষ্টায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭২ সালে এটি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়াটিক সোসাইটি তাদের জন্মলগ্ন থেকেই ইতিহাস চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস চর্চা চালু রয়েছে বটে, কিন্তু ইতিহাসের সেই অতীত গৌরব ও জৌলুশ আর নেই। ইতিহাস চর্চার এই দুর্দশার মধ্যেও আমরা আশার ক্ষীণ আলো খুঁজে পাই, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে। ১৯৯০ সালে এই বিভাগটি চালু হওয়ার পর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একমাত্র এই বিভাগটি বাংলার আদি ইতিহাসকে এখনো খুঁজে চলেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস পাঠের বাধ্যবাধকতার নিয়ম চালু নেই। ফলে দেখা যায়, জাতির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস না জেনেই প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইতিহাসজ্ঞানবর্জিত হয়ে পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন, উদার, গণমুখী, প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আর এসবের জন্য দরকার ইতিহাস সচেতনতা। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, বর্তমানে দেশের আটটি জেলার ৩০টি সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক পর্যায়ে এখনো ইতিহাস বিষয় পড়ানো হয় না। এ ছাড়া ৬৮টি সরকারি কলেজ ও তিনটি সরকারি মাদ্রাসায় ইতিহাস শিক্ষকের কোনো পদই নেই! কাজেই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই দৈন্যদশা থেকেই ইতিহাস চর্চার বর্তমান চিত্রটি সহজে অনুমেয়। যদিও বর্তমান শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার কারিকুলামে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস চর্চার বর্তমান দৈন্যদশা এই উদ্যোগেও ঘুচবে কি?
বর্তমানে দেশে মোট ১২২০টি এমপিওভুক্ত কলেজের মধ্যে ৫৮১টিতে ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান হয় না। অন্যদিকে ২২৩৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাদ্রাসার কোনোটিতে ইতিহাস বিষয়ে পড়ানো হয় না। অথচ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান দায়িত্বই হলো ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোলসহ বিভিন্ন বিষয়ে চৌকস করে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এমনকি সম্প্রতি গোপালগঞ্জে জাতির জনকের নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারি কলেজেও (শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ) ইতিহাস বিষয়টি স্থান পায়নি, যেটি খুবই হতাশাজনক।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজকে অনার্স ও মাস্টার্স স্তরে উন্নীত করায় সাধারণ জনগণের কাছে উচ্চশিক্ষার দুয়ার উন্মোচন হয়। কিন্তু দুয়ারে উচ্চশিক্ষা পৌঁছালেও শিক্ষার গুণগতমানের দিকটি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর তুলে দেওয়ায় উচ্চমাধ্যমিকের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে বেসরকারি কলেজগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অধিকাংশ বেসরকারি কলেজের উদ্দেশ্যই থাকে কীভাবে সহজ পন্থায় ছাত্রছাত্রীদের বেশি নম্বর দিয়ে পাস করানো যায়। এই বাণিজ্যিক দৌড়ে ইতিহাস বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে। কারণ, প্রচলিত ধারণামতে ইতিহাস বিষয়ে নম্বর বেশি পাওয়া যায় না। কলেজগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ইতিহাস বিষয়টির প্রবেশাধিকার একদম নেই। বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই মোহনীয় শিক্ষা-বাণিজ্যের অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আজ জিম্মি। যেখানে ছাত্রছাত্রীদের মানবিক গুণাবলি গড়ে তোলার ক্ষেত্রগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে, সেখানে শুধু পরীক্ষায় পাস করানো মানসিকতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ইতিহাস-দর্শনবিহীন শিক্ষা কখনো মানবিক মূল্যবোধকে পুরোপুরিভাবে বিকশিত করতে পারে না। জাতীয় ইতিহাস পঠন ছাড়া কোনো জাতির মধ্যে দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির উন্মেষ ঘটা সম্ভব নয়। তাই ইতিহাস চর্চার সংকুচিত ক্ষেত্রকে বিকশিত করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে ইতিহাস গবেষণার জন্য সরকারি সহযোগিতাও বাড়ানো দরকার।
পুলক চাকমা: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা।
pulakchakma21@gmail.com
No comments