এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এবং বাস্তবতা by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
এশীয় রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রনীতি ফলপ্রসূ ও কার্যকর হতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা ও এর কেন্দ্রীয় ব্যক্তি ওসামা বিন লাদেনকে আর্থিক, সামরিক, নৈতিক সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে গড়ে তোলে এবং একপর্যায়ে আফগানিস্তানের মুজাহিদ বাহিনী, আফগান মুক্তিযোদ্ধা ও আফগান জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে আফগানিস্তানে সোভিয়েত প্রাধান্য বিলুপ্ত হয় এবং তার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তালিকায় লাদেনসহ আফগান প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নাম লিপিবদ্ধ হয়।
৯/১১-এর আকস্মিক আঘাতে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র টুইন টাওয়ার ধসে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র লাদেনসহ তাঁর অনুসারী এবং অনেক আফগান যোদ্ধাকে এ ঘটনার ক্রীড়নক হিসেবে দায়ী করে এবং আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। অসংখ্য সহজ-সরল আফগান বেসামরিক নাগরিক মার্কিন সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়, বহু আফগান জনপদ ন্যাটো ও মর্কিন সৈন্যদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়। অবশেষে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দেয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রচ্ছন্ন ছিল। ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের' অবতারণা করে। যার অন্যতম প্রজ্বালনক্ষেত্র (ঋষধংযঢ়ড়রহঃং) হিসেবে হিন্দুকুশ ও হিমালয়ের পাদদেশ, খাইবার গিরিপথ, আফগানিস্তানের মরুময় প্রান্তর, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের 'মুক্ত এলাকা' এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক এলাকা ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তপ্ত রণাঙ্গনে পরিণত হয়।
আফগানিস্তানের মোল্লা ওমর, তালেবান ও তাঁদের সহযোগীদের হটাতে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব আরো শাণিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পিপিপির চেয়ারম্যান বেনজির ভুট্টো মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী আসিফ আলী জারদারির নানা দুর্বলতা এবং তাঁর আগেকার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতার অবৈধতাজাত সীমাবদ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রকে মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়।
আফগানিস্তানের মাটিতে জিততে হলে পাকিস্তানের সহযোগিতার যে কোনো বিকল্প নেই_এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র আগেই বুঝতে সক্ষম হয় এবং সে কারণে পারভেজ মোশাররফ ও আসিফ আলী জারদারিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলে। ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালু হয় পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, শাসনামলের শেষ ভাগে পারভেজ মোশাররফের প্রয়োজন নেই বলে নিশ্চিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ছুড়ে ফেলে, এমনকি বারবার করে ফোন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট মোশাররফের সঙ্গে কথা বলার সৌজন্যটুকু দেখাননি।
সম্প্রতি মেমোগেট কেলেঙ্কারি রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়লে আসিফ আলী জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সরকার পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তোপের মুখে পড়ে। আসিফ আলী জারদারি মেমোগেট কেলেঙ্কারির গুপ্ত রহস্যের অভিযোগ অস্বীকার করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এ কেলেঙ্কারির কথা স্বীকার করে জারদারি ও তাঁর সরকারকে ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থায় নিক্ষেপ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের পেলব পরশ জারদারিকে এতটুকু স্বস্তি দিতে পারেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মিত্র ছিল। এসব শেখ রাজ-প্রেসিডেন্টরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে স্বীয় জনগণের জীবনে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে আসছেন। তিউনিসিয়ার জাইন বিন আলী, মিসরের হোসনি মুবারক, ইয়েমেনের বাদশাহ সালেহসহ অনেক একনায়ক স্বৈরতন্ত্রের অধীনে আরব বিশ্বের কোটি কোটি জনগণকে অত্যাচারীর শাসন ও শোষণের নিগড়ে বন্দি করে রেখেছেন।
অবশেষে এসব দেশের জনগণ আরব বসন্তোত্তরকালে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগরণ গড়ে তুললে স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। তাঁদের ক্ষমতা থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও তাঁদের ছুড়ে দেয় এবং এসব দেশের নতুন উদীয়মান তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে তৎপর হয়। উল্লেখ্য, এসব তরুণের সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিগ্রহ, অত্যাচার ও যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন অতীতে আর এখন তাঁরাই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের তালিকার নতুন অতিথি।
উদাহরণস্বরূপ, কথিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে' পাকিস্তানের চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণা অব্যাহত থাকলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করেছে যে, তারা পাকিস্তানের একটি ইসলামপন্থী গ্রুপকে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। সুনি্ন ইত্তেহাত পরিষদ নামের ওই গ্রুপটি মার্কিন সহায়তা নিয়ে তালেবানবিরোধী সমাবেশ আয়োজন করলেও একই সঙ্গে এক উদারপন্থী রাজনীতিবিদকে হত্যাকারী চরমপন্থীদের প্রতিও অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।
এর আগে উল্লেখ করেছি, কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণের উপায় হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের অত্যাচারী একনায়কদের প্রতি অন্ধ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে ওই একনায়ক শাসকবর্গের বিরোধী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতি নানামুখী নির্যাতনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। জেল, নির্বাসন, হত্যা, গুপ্তাঘাত প্রভৃতি অমানবিক কার্যক্রম চালিয়ে বিরোধী মত, পথ ও দল কঠোরভাবে দমন করা হয়। এমনি এক গোষ্ঠী ছিল মিসরের অর্ধ শতাব্দী ধরে নিষিদ্ধ ঘোষিত ভ্রাতৃসংঘ (ইখওয়ানুল মুসলিমিন)।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থান্ধ বাস্তববাদী নীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় মিসর কর্তৃক নির্যাতিত ভ্রাতৃসংঘের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি প্রীতি গঠনের প্রক্রিয়া। ১১ জানুয়ারি ভ্রাতৃসংঘ বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম বার্নস এক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এমন এক সময়, যখন মুবারক-পরবর্তী মিসরের সিংহাসনে আরোহণ করতে যাচ্ছে ব্রাদারহুড। মুবারকের পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ব্রাদারহুডের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র পুরনো বন্ধুদের ছুড়ে দিয়ে ব্রাদারহুডের বন্ধুত্বকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিককালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অপর একটি মুবারকবিরোধী রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সঙ্গেও বার্নস সাক্ষাৎ করেছেন বলে এএফপির খবরে প্রচার করা হয়েছে। এফজেপির মুখপাত্র আহমেদ সবি জানিয়েছেন, সম্প্রতি মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেফরি ফেল্টম্যান কায়রো সফরকালে এফজেপির উপপ্রধান এসাম আল-এরিয়ানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে নিবিড় বৈঠকে মিলিত হন। মিসরের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এ দলগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্ভাব্য মৈত্রী গঠন-প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় নীতিতে তার চরম স্বার্থপর মনোভাব ও কার্যক্রমের স্পষ্ট উদাহরণ। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের পূর্বঘোষিত 'সীমিত যোগাযোগ'নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই স্ববিরোধিতা, স্বার্থান্ধতা ও দ্বিমুখিতাই মুসলিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
আমার স্মৃতিতে এখনো ভেসে ওঠে ইরানি তরুণী ইভা দাদ্দেলাহির নিশ্চল চাহনি আর তার গোলাপি গণ্ড দিয়ে ঝরে পড়া অশ্রু। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ছিল আমার সহপাঠী, ইরান-ইরাক যুদ্ধের রণাঙ্গনে আপনজনকে হারিয়ে সুদূর বাংলাদেশের আশ্রয়ে। ভ্রাতৃপ্রতিম দুটি দেশের মধ্যে সেই যুদ্ধের কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার পুতুল সরকার শাহ্ ক্ষমতাচ্যুত হলে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে। একপর্যায়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সাদ্দামের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় আমেরিকার কাছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ সমবেত বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাদ্দামের ইরাকের ওপর, যার সূত্র ধরে তাঁর সন্তান জুনিয়র বুশও ইরাকের বিরুদ্ধে চালিয়ে যান নিধনযজ্ঞ। প্রায় ২০ বছর ধরে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিবর্গের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত সাদ্দাম শেষ পর্যন্ত পরাজয়ের গ্লানি বহন করেন এবং একসময়কার বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা চরমভাবে লাঞ্ছিত হন।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্র, এ সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কিন্তু সত্তর দশকের শেষদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ইরানকে বন্ধুত্বের আসন থেকে নামিয়ে রাখে যুক্তরাষ্ট্র এবং সেই থেকে অদ্যাবধি একের পর এক নানা অজুহাতে ইরানকে অস্থিতিশীল করতে কোনো কার্পণ্য করেনি দেশটি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যেকোনো সময় যুদ্ধ বেধে যেতে পারে এবং তা আঞ্চলিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে বলেও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন।
লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতারোহণের পর প্রচণ্ড পাশ্চাত্যবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ওপর ভীষণ চটে যায়। পরবর্তী সময়ে কোনোমতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ম্যানেজ করে চলতে থাকেন। সাম্প্রতিক আরব গণজাগরণের জোয়ার লিবিয়ায় উপচে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র তা আরো বেগবান করে তোলে এবং বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। ত্রিপোলি, বেনগাজি ও সিরতায় মুহুর্মুহু ন্যাটো বিমান হামলা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী আরেক প্রতিবাদী কণ্ঠ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার। কেবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হওয়ার কারণে বাশারবিরোধী আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের নানাভাবে প্ররোচিত করছে এবং সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে শক্তিশালী করছে। কেন? কারণ হলো, বাশার সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের প্রভু যুক্তরাষ্ট্রকে তোয়াক্কা করেন না। শ্রুত হচ্ছে, রাশিয়া ইতিমধ্যে আশঙ্কা করছে, যেকোনো সময় ন্যাটো সিরিয়ায় বিমান হামলা চালাতে পারে এবং গাদ্দাফির মতো বাশারকেও ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আফগানিস্তানের মোল্লা ওমর, তালেবান ও তাঁদের সহযোগীদের হটাতে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব আরো শাণিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পিপিপির চেয়ারম্যান বেনজির ভুট্টো মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী আসিফ আলী জারদারির নানা দুর্বলতা এবং তাঁর আগেকার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতার অবৈধতাজাত সীমাবদ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রকে মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়।
আফগানিস্তানের মাটিতে জিততে হলে পাকিস্তানের সহযোগিতার যে কোনো বিকল্প নেই_এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র আগেই বুঝতে সক্ষম হয় এবং সে কারণে পারভেজ মোশাররফ ও আসিফ আলী জারদারিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলে। ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালু হয় পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, শাসনামলের শেষ ভাগে পারভেজ মোশাররফের প্রয়োজন নেই বলে নিশ্চিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ছুড়ে ফেলে, এমনকি বারবার করে ফোন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট মোশাররফের সঙ্গে কথা বলার সৌজন্যটুকু দেখাননি।
সম্প্রতি মেমোগেট কেলেঙ্কারি রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়লে আসিফ আলী জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সরকার পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তোপের মুখে পড়ে। আসিফ আলী জারদারি মেমোগেট কেলেঙ্কারির গুপ্ত রহস্যের অভিযোগ অস্বীকার করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এ কেলেঙ্কারির কথা স্বীকার করে জারদারি ও তাঁর সরকারকে ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থায় নিক্ষেপ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের পেলব পরশ জারদারিকে এতটুকু স্বস্তি দিতে পারেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মিত্র ছিল। এসব শেখ রাজ-প্রেসিডেন্টরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে স্বীয় জনগণের জীবনে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে আসছেন। তিউনিসিয়ার জাইন বিন আলী, মিসরের হোসনি মুবারক, ইয়েমেনের বাদশাহ সালেহসহ অনেক একনায়ক স্বৈরতন্ত্রের অধীনে আরব বিশ্বের কোটি কোটি জনগণকে অত্যাচারীর শাসন ও শোষণের নিগড়ে বন্দি করে রেখেছেন।
অবশেষে এসব দেশের জনগণ আরব বসন্তোত্তরকালে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগরণ গড়ে তুললে স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। তাঁদের ক্ষমতা থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও তাঁদের ছুড়ে দেয় এবং এসব দেশের নতুন উদীয়মান তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে তৎপর হয়। উল্লেখ্য, এসব তরুণের সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিগ্রহ, অত্যাচার ও যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন অতীতে আর এখন তাঁরাই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের তালিকার নতুন অতিথি।
উদাহরণস্বরূপ, কথিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে' পাকিস্তানের চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণা অব্যাহত থাকলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করেছে যে, তারা পাকিস্তানের একটি ইসলামপন্থী গ্রুপকে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। সুনি্ন ইত্তেহাত পরিষদ নামের ওই গ্রুপটি মার্কিন সহায়তা নিয়ে তালেবানবিরোধী সমাবেশ আয়োজন করলেও একই সঙ্গে এক উদারপন্থী রাজনীতিবিদকে হত্যাকারী চরমপন্থীদের প্রতিও অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।
এর আগে উল্লেখ করেছি, কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণের উপায় হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের অত্যাচারী একনায়কদের প্রতি অন্ধ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে ওই একনায়ক শাসকবর্গের বিরোধী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতি নানামুখী নির্যাতনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। জেল, নির্বাসন, হত্যা, গুপ্তাঘাত প্রভৃতি অমানবিক কার্যক্রম চালিয়ে বিরোধী মত, পথ ও দল কঠোরভাবে দমন করা হয়। এমনি এক গোষ্ঠী ছিল মিসরের অর্ধ শতাব্দী ধরে নিষিদ্ধ ঘোষিত ভ্রাতৃসংঘ (ইখওয়ানুল মুসলিমিন)।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থান্ধ বাস্তববাদী নীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় মিসর কর্তৃক নির্যাতিত ভ্রাতৃসংঘের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি প্রীতি গঠনের প্রক্রিয়া। ১১ জানুয়ারি ভ্রাতৃসংঘ বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম বার্নস এক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এমন এক সময়, যখন মুবারক-পরবর্তী মিসরের সিংহাসনে আরোহণ করতে যাচ্ছে ব্রাদারহুড। মুবারকের পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ব্রাদারহুডের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র পুরনো বন্ধুদের ছুড়ে দিয়ে ব্রাদারহুডের বন্ধুত্বকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিককালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অপর একটি মুবারকবিরোধী রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সঙ্গেও বার্নস সাক্ষাৎ করেছেন বলে এএফপির খবরে প্রচার করা হয়েছে। এফজেপির মুখপাত্র আহমেদ সবি জানিয়েছেন, সম্প্রতি মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেফরি ফেল্টম্যান কায়রো সফরকালে এফজেপির উপপ্রধান এসাম আল-এরিয়ানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে নিবিড় বৈঠকে মিলিত হন। মিসরের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এ দলগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্ভাব্য মৈত্রী গঠন-প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় নীতিতে তার চরম স্বার্থপর মনোভাব ও কার্যক্রমের স্পষ্ট উদাহরণ। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের পূর্বঘোষিত 'সীমিত যোগাযোগ'নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই স্ববিরোধিতা, স্বার্থান্ধতা ও দ্বিমুখিতাই মুসলিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
আমার স্মৃতিতে এখনো ভেসে ওঠে ইরানি তরুণী ইভা দাদ্দেলাহির নিশ্চল চাহনি আর তার গোলাপি গণ্ড দিয়ে ঝরে পড়া অশ্রু। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ছিল আমার সহপাঠী, ইরান-ইরাক যুদ্ধের রণাঙ্গনে আপনজনকে হারিয়ে সুদূর বাংলাদেশের আশ্রয়ে। ভ্রাতৃপ্রতিম দুটি দেশের মধ্যে সেই যুদ্ধের কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার পুতুল সরকার শাহ্ ক্ষমতাচ্যুত হলে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে। একপর্যায়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সাদ্দামের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় আমেরিকার কাছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ সমবেত বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাদ্দামের ইরাকের ওপর, যার সূত্র ধরে তাঁর সন্তান জুনিয়র বুশও ইরাকের বিরুদ্ধে চালিয়ে যান নিধনযজ্ঞ। প্রায় ২০ বছর ধরে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিবর্গের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত সাদ্দাম শেষ পর্যন্ত পরাজয়ের গ্লানি বহন করেন এবং একসময়কার বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা চরমভাবে লাঞ্ছিত হন।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্র, এ সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কিন্তু সত্তর দশকের শেষদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ইরানকে বন্ধুত্বের আসন থেকে নামিয়ে রাখে যুক্তরাষ্ট্র এবং সেই থেকে অদ্যাবধি একের পর এক নানা অজুহাতে ইরানকে অস্থিতিশীল করতে কোনো কার্পণ্য করেনি দেশটি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যেকোনো সময় যুদ্ধ বেধে যেতে পারে এবং তা আঞ্চলিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে বলেও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন।
লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতারোহণের পর প্রচণ্ড পাশ্চাত্যবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ওপর ভীষণ চটে যায়। পরবর্তী সময়ে কোনোমতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ম্যানেজ করে চলতে থাকেন। সাম্প্রতিক আরব গণজাগরণের জোয়ার লিবিয়ায় উপচে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র তা আরো বেগবান করে তোলে এবং বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। ত্রিপোলি, বেনগাজি ও সিরতায় মুহুর্মুহু ন্যাটো বিমান হামলা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী আরেক প্রতিবাদী কণ্ঠ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার। কেবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হওয়ার কারণে বাশারবিরোধী আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের নানাভাবে প্ররোচিত করছে এবং সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে শক্তিশালী করছে। কেন? কারণ হলো, বাশার সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের প্রভু যুক্তরাষ্ট্রকে তোয়াক্কা করেন না। শ্রুত হচ্ছে, রাশিয়া ইতিমধ্যে আশঙ্কা করছে, যেকোনো সময় ন্যাটো সিরিয়ায় বিমান হামলা চালাতে পারে এবং গাদ্দাফির মতো বাশারকেও ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments