যুক্তি তর্ক গল্প-গণতন্ত্রের ভিতকেই শক্তিশালী করতে হবে by আবুল মোমেন
আশির দশকে বাংলাদেশের ক্যু-অভ্যাসের কথা লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ-দরদি লেখক মনীষী অন্নদাশংকর রায়। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে জেনারেল এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসছিল। এসেছিল বলা যাচ্ছে না। কারণ, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক আমলে, ২০০৭ সালে এক-এগারোর পরিবর্তনের মাধ্যমে সামরিক হস্তক্ষেপের ভিন্ন মাত্রার দুটি ঘটনা ঘটেছিল।
বোঝা যায়, বাংলাদেশে ক্ষমতা কাঠামোতে এখনো সামরিক বাহিনীর অবস্থান বেশ ওপরে ও অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বেসামরিক প্রশাসনের যে নিরঙ্কুশ অগ্রবর্তিতা থাকে, তা এখনো এখানে অর্জিত হয়নি। গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের দক্ষতা, কর্মক্ষমতা, পারস্পরিক সমঝোতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পেলে একসময় বাস্তবতার পরিবর্তন হবে। রাজনীতি ও প্রশাসনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কোন্দল, অদক্ষতার মতো দুর্বলতা নিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অভীষ্ট গতি ও সাফল্য পেতে পারে না। তবে মাঝেমধ্যেই সামরিক হস্তক্ষেপ চলতে থাকলে তা আরও বিলম্বিত ও বিঘ্নিত হবে।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত অনেক সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও ব্যর্থতার মধ্যেও বেশ কিছু ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো জেনারেল জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা। নানাভাবে মূল্যায়িত ও গৃহীত মতামত হলো সামরিক শাসনে দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাই যে কেবল ব্যাহত হয় তা নয়, এতে দেশের অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক অগ্রগতিও ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে পঁচাত্তর থেকে বারবার যেসব সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে, তার কোনোটি অবৈধ আর কোনোটি বৈধ মনে করার যে ধারা চলে এসেছিল, তার অবকাশ থাকে না আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ বৈধ সামরিক শাসনের কোনো আইনি বা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা তো নেই।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সব রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে মেনে নিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ যেসব দল অতীতে ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে, তরুণদের দেখিয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি অগ্রহণযোগ্য বলেছে, তারা সত্যি সত্যি ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচি পরিবর্তন করেছে কি না, বলা মুশকিল। জামায়াতের তুলনায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব ইসলামি দল আছে, তাদের যেহেতু বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অতিসত্বর তেমন প্রত্যক্ষ ফল লাভের আশা নেই, তাই প্রায়ই তাদের দেখা যায় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কট্টর ভাষায় ইসলামি বিপ্লবের ধুয়া তুলতে।
মুসলিমপ্রধান সমাজে ইসলামি শিক্ষা, চিন্তা, দর্শনচর্চার আবাহন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। তদুপরি বর্তমান বস্তুতান্ত্রিক ভোগবিলাসের যুগে মানুষকে নীতি-নৈতিকতা ও বিবেকের অনুশাসনে ফিরিয়ে আনার জন্য ইসলামের নামে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথাও কেউ বলতে পারেন।
সমাজমানস কোনো জড় পদার্থ নয়, এটি স্থবির বা নিষ্ক্রিয় বিষয় নয়; সব সময় সক্রিয়, গ্রহণ-বর্জন চলতে থাকে নিরন্তর। সত্যিই তো বর্তমানে বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যিক বিস্ফোরণ ইত্যাদি মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের চিরায়ত যে ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা, তা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। সচেতন সব মানুষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এ অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই ধারা চলতে থাকলে পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে তাঁরা উৎকণ্ঠিত। আর উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত মানুষ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। তাঁরা প্রতিকারে এগিয়ে না এলে তা কেবল তাঁদের ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে না, পরবর্তী কালে এর পরিণতির জন্য তাঁরা দায়ী থাকবেন। যেহেতু সমাজ এক সজীব সৃজনশীল চলমান মানবগোষ্ঠী, তাই এর সমস্যার সমাধানেও সৃষ্টিশীলতা ও মানবতার পরিচয় দিতে হবে। মুক্তমন নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে এবং বর্তমান প্রবণতাগুলোকে বোঝার চেষ্টা না করলে সংঘাত অনিবার্য। তাতে সমাজে অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ভাঙন ও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
যেসব তথ্য আমরা পাচ্ছি, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে যাঁরা সম্প্রতি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছেন, তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে জবরদস্তির মাধ্যমে তাঁদের চিন্তাভাবনার একটি ধর্মীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এখানে এ সূত্রে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় এসে যায়। অভ্যুত্থানের প্রয়াসকারীদের বিবেচনায় বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ও ইসলাম সহাবস্থান করছে না। এ আমলে ইসলাম বিপন্ন, ধর্মচর্চা ব্যাহত হচ্ছে ইত্যাদি ধুয়া তুলছে তারা। কিন্তু কি ব্যক্তিগত পর্যায়ে, কী সামাজিক পর্যায়ে, কী জাতীয় পর্যায়ে—ইসলাম বা ধর্মচর্চা কোথাও ব্যাহত, ক্ষুণ্ন বা কমতি হচ্ছে, তা মনে করার মতো কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা এবং এই ভক্তিবাদী দেশে যে অসংখ্য মাজার, দরবার আছে (আমি জানি এ নিয়ে মতপার্থক্য আছে, শাস্ত্রীয় বিতর্ক চর্চা অবশ্যই চলবে) কোথাও থেকে এ রকম অভিযোগ-সমালোচনা ওঠেনি।
যেসব সমালোচনা ও অভিযোগ মাঝেমধ্যে উঠতে দেখি আমরা, তা উত্থাপন করে থাকে সেসব ইসলামি ও মুসলমান নামধারী সংগঠন, যারা মূলত রাজনীতি করে, তারা কতটা আন্তরিকভাবে ধর্মচর্চা করে, তা নিয়ে বিতর্ক কম নেই। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি তাদের লক্ষ্য যে বরাবর রয়েছে তা মানুষ জানে। আর এ দেশের সব ধর্মের মানুষ যেহেতু ধর্মভীরু এবং দেশের সিংহভাগ মানুষ যেহেতু মুসলমান, তাই আজ বহুকাল ধরে এখানকার রাজনীতিতে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে রয়েছে। ইসলাম বিপন্ন, মুসলমানের স্বার্থ বিঘ্নিত, দেশ ভারত তথা হিন্দুদের দখলে চলে যাচ্ছে ইত্যাদি ধুয়া তুলে সাধারণ মানুষ তথা ভোটারদের ভোলানোর চেষ্টাও পুরোনো বিষয়।
আমরা লক্ষ করি এই রাজনীতির চক্করে পড়ে এককালের সেক্যুলার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতিতে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও বক্তব্যকে ভালোভাবে যুক্ত করেছে। বিএনপিই অতীতে এই রাজনীতির একক বটবৃক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাতে আওয়ামী লীগ কিছুটা ভাগ বসাতে পেরেছে। এ অবস্থায় যাঁরা ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থানে রয়েছেন, যাঁরা সত্যিই ইসলামি বিপ্লব কায়েমের পক্ষেই রাজনীতি করছেন, তাঁরা বিশেষভাবে বিএনপির ওপরই নির্ভর করছেন। এ কারণেই গত জোট আমলে বিএনপিকে জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর ও কট্টর ধর্মান্ধ বিভিন্ন দলের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল উদ্যোক্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের যেসব বক্তব্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে নতুন কোনো কথা নেই। আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী, ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে চিহ্নিত করা, ফলে এ আমলে যেকোনো সময় ভারত কর্তৃক দেশ দখল ইত্যাদি পুরোনো কথাবার্তাই এসেছে। রাজনীতি বা রাজনৈতিক চাল হিসেবেও এটা নতুন কিছু নয়। এতে ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান বা প্রজ্ঞার পরিচয় যেমন মেলে না, তেমনি সমাজ, রাষ্ট্র বা ইতিহাসের ধারা সম্পর্কে প্রকৃত শিক্ষারও আলামত পাওয়া যায় না।
ফলে এসব শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে হঠকারী ভ্রান্ত পদক্ষেপরূপেই গণ্য হতে বাধ্য। এর সঙ্গে যদি ঘৃণা, বিদ্বেষ, হত্যাও যুক্ত হতো, তাহলে তা হতো জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা।
মানুষ কখন ধর্মান্ধতার শিকার হয়, কোনো অবস্থায় সমাজে অন্ধবিশ্বাস, ঘৃণা ও হানাহানির জিঘাংসাবৃত্তি জায়গা করে নেয়—সেগুলো আমাদের ভাবতে হবে।
বর্তমান ঘটনায় আইন নিশ্চয় নিজস্ব গতিতেই চলবে। এ থেকে যেন আমরা কোনোরূপ অসহিষ্ণুতা বা বিদ্বেষের পথে পা না বাড়াই। আমাদের লক্ষ্য যথার্থ মানবিক, কল্যাণকর, উন্নয়নশীল একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা, তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে (সামরিক বাহিনীর পাঠক্রমসহ) আরও যুগোপযোগী করতে হবে। গণতন্ত্রকে সত্যি সত্যি বহু মত এবং বিপরীত মতকেও ধারণ করার মতো পরিণত ও শক্তিশালী করতে হবে। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র ও ইসলাম পরস্পর বিরোধী নয়; বরং সাম্যের ধর্ম ইসলাম প্রকৃত গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাতেই পূর্ণ বিকশিত হয়ে নাগরিকদের সুন্দর জীবন গঠনে সহায়ক হতে পারে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত অনেক সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও ব্যর্থতার মধ্যেও বেশ কিছু ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো জেনারেল জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা। নানাভাবে মূল্যায়িত ও গৃহীত মতামত হলো সামরিক শাসনে দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাই যে কেবল ব্যাহত হয় তা নয়, এতে দেশের অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক অগ্রগতিও ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে পঁচাত্তর থেকে বারবার যেসব সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে, তার কোনোটি অবৈধ আর কোনোটি বৈধ মনে করার যে ধারা চলে এসেছিল, তার অবকাশ থাকে না আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ বৈধ সামরিক শাসনের কোনো আইনি বা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা তো নেই।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সব রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে মেনে নিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ যেসব দল অতীতে ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে, তরুণদের দেখিয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি অগ্রহণযোগ্য বলেছে, তারা সত্যি সত্যি ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচি পরিবর্তন করেছে কি না, বলা মুশকিল। জামায়াতের তুলনায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব ইসলামি দল আছে, তাদের যেহেতু বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অতিসত্বর তেমন প্রত্যক্ষ ফল লাভের আশা নেই, তাই প্রায়ই তাদের দেখা যায় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কট্টর ভাষায় ইসলামি বিপ্লবের ধুয়া তুলতে।
মুসলিমপ্রধান সমাজে ইসলামি শিক্ষা, চিন্তা, দর্শনচর্চার আবাহন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। তদুপরি বর্তমান বস্তুতান্ত্রিক ভোগবিলাসের যুগে মানুষকে নীতি-নৈতিকতা ও বিবেকের অনুশাসনে ফিরিয়ে আনার জন্য ইসলামের নামে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথাও কেউ বলতে পারেন।
সমাজমানস কোনো জড় পদার্থ নয়, এটি স্থবির বা নিষ্ক্রিয় বিষয় নয়; সব সময় সক্রিয়, গ্রহণ-বর্জন চলতে থাকে নিরন্তর। সত্যিই তো বর্তমানে বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যিক বিস্ফোরণ ইত্যাদি মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের চিরায়ত যে ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা, তা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। সচেতন সব মানুষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এ অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই ধারা চলতে থাকলে পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে তাঁরা উৎকণ্ঠিত। আর উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত মানুষ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। তাঁরা প্রতিকারে এগিয়ে না এলে তা কেবল তাঁদের ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে না, পরবর্তী কালে এর পরিণতির জন্য তাঁরা দায়ী থাকবেন। যেহেতু সমাজ এক সজীব সৃজনশীল চলমান মানবগোষ্ঠী, তাই এর সমস্যার সমাধানেও সৃষ্টিশীলতা ও মানবতার পরিচয় দিতে হবে। মুক্তমন নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে এবং বর্তমান প্রবণতাগুলোকে বোঝার চেষ্টা না করলে সংঘাত অনিবার্য। তাতে সমাজে অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ভাঙন ও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
যেসব তথ্য আমরা পাচ্ছি, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে যাঁরা সম্প্রতি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছেন, তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে জবরদস্তির মাধ্যমে তাঁদের চিন্তাভাবনার একটি ধর্মীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এখানে এ সূত্রে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় এসে যায়। অভ্যুত্থানের প্রয়াসকারীদের বিবেচনায় বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ও ইসলাম সহাবস্থান করছে না। এ আমলে ইসলাম বিপন্ন, ধর্মচর্চা ব্যাহত হচ্ছে ইত্যাদি ধুয়া তুলছে তারা। কিন্তু কি ব্যক্তিগত পর্যায়ে, কী সামাজিক পর্যায়ে, কী জাতীয় পর্যায়ে—ইসলাম বা ধর্মচর্চা কোথাও ব্যাহত, ক্ষুণ্ন বা কমতি হচ্ছে, তা মনে করার মতো কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা এবং এই ভক্তিবাদী দেশে যে অসংখ্য মাজার, দরবার আছে (আমি জানি এ নিয়ে মতপার্থক্য আছে, শাস্ত্রীয় বিতর্ক চর্চা অবশ্যই চলবে) কোথাও থেকে এ রকম অভিযোগ-সমালোচনা ওঠেনি।
যেসব সমালোচনা ও অভিযোগ মাঝেমধ্যে উঠতে দেখি আমরা, তা উত্থাপন করে থাকে সেসব ইসলামি ও মুসলমান নামধারী সংগঠন, যারা মূলত রাজনীতি করে, তারা কতটা আন্তরিকভাবে ধর্মচর্চা করে, তা নিয়ে বিতর্ক কম নেই। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি তাদের লক্ষ্য যে বরাবর রয়েছে তা মানুষ জানে। আর এ দেশের সব ধর্মের মানুষ যেহেতু ধর্মভীরু এবং দেশের সিংহভাগ মানুষ যেহেতু মুসলমান, তাই আজ বহুকাল ধরে এখানকার রাজনীতিতে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে রয়েছে। ইসলাম বিপন্ন, মুসলমানের স্বার্থ বিঘ্নিত, দেশ ভারত তথা হিন্দুদের দখলে চলে যাচ্ছে ইত্যাদি ধুয়া তুলে সাধারণ মানুষ তথা ভোটারদের ভোলানোর চেষ্টাও পুরোনো বিষয়।
আমরা লক্ষ করি এই রাজনীতির চক্করে পড়ে এককালের সেক্যুলার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতিতে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও বক্তব্যকে ভালোভাবে যুক্ত করেছে। বিএনপিই অতীতে এই রাজনীতির একক বটবৃক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাতে আওয়ামী লীগ কিছুটা ভাগ বসাতে পেরেছে। এ অবস্থায় যাঁরা ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থানে রয়েছেন, যাঁরা সত্যিই ইসলামি বিপ্লব কায়েমের পক্ষেই রাজনীতি করছেন, তাঁরা বিশেষভাবে বিএনপির ওপরই নির্ভর করছেন। এ কারণেই গত জোট আমলে বিএনপিকে জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর ও কট্টর ধর্মান্ধ বিভিন্ন দলের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল উদ্যোক্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের যেসব বক্তব্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে নতুন কোনো কথা নেই। আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী, ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে চিহ্নিত করা, ফলে এ আমলে যেকোনো সময় ভারত কর্তৃক দেশ দখল ইত্যাদি পুরোনো কথাবার্তাই এসেছে। রাজনীতি বা রাজনৈতিক চাল হিসেবেও এটা নতুন কিছু নয়। এতে ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান বা প্রজ্ঞার পরিচয় যেমন মেলে না, তেমনি সমাজ, রাষ্ট্র বা ইতিহাসের ধারা সম্পর্কে প্রকৃত শিক্ষারও আলামত পাওয়া যায় না।
ফলে এসব শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে হঠকারী ভ্রান্ত পদক্ষেপরূপেই গণ্য হতে বাধ্য। এর সঙ্গে যদি ঘৃণা, বিদ্বেষ, হত্যাও যুক্ত হতো, তাহলে তা হতো জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা।
মানুষ কখন ধর্মান্ধতার শিকার হয়, কোনো অবস্থায় সমাজে অন্ধবিশ্বাস, ঘৃণা ও হানাহানির জিঘাংসাবৃত্তি জায়গা করে নেয়—সেগুলো আমাদের ভাবতে হবে।
বর্তমান ঘটনায় আইন নিশ্চয় নিজস্ব গতিতেই চলবে। এ থেকে যেন আমরা কোনোরূপ অসহিষ্ণুতা বা বিদ্বেষের পথে পা না বাড়াই। আমাদের লক্ষ্য যথার্থ মানবিক, কল্যাণকর, উন্নয়নশীল একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা, তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে (সামরিক বাহিনীর পাঠক্রমসহ) আরও যুগোপযোগী করতে হবে। গণতন্ত্রকে সত্যি সত্যি বহু মত এবং বিপরীত মতকেও ধারণ করার মতো পরিণত ও শক্তিশালী করতে হবে। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র ও ইসলাম পরস্পর বিরোধী নয়; বরং সাম্যের ধর্ম ইসলাম প্রকৃত গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাতেই পূর্ণ বিকশিত হয়ে নাগরিকদের সুন্দর জীবন গঠনে সহায়ক হতে পারে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments