শ্রদ্ধাঞ্জলি-প্রফেসর শরফুদ্দিন: স্মৃতি অম্লান

বেদনাভারাক্রান্ত মনে লিখতে হচ্ছে আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর এস এম শরফুদ্দিনকে নিয়ে। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার লালমাটিয়ার সিটি হাসপাতালে শরফুদ্দিন স্যার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাঁর পরিবার, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের শোকাচ্ছন্ন করে। তিনি ছিলেন এ দেশে বসবাসকারী জ্যেষ্ঠতম গণিতবিদ। জীবনের আট দশককাল পেরিয়ে যেন সহসা নিভে গেল তাঁর জীবনপ্রদীপ।


তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী ও সুযোগ্য দুই পুত্র। আজ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। প্রফেসর শরফুদ্দিনের কর্মজীবন ছিল বর্ণাঢ্য। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও একনিষ্ঠ গণিতসাধক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র প্রফেসর শরফুদ্দিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৪ সালে। পরের বছর তিনি যুক্তরাজ্যের ‘ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্স অ্যান্ড ইটস অ্যাপ্লিকেশনস’-এর ফেলো নির্বাচিত হন।
বর্তমানের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শরফুদ্দিনের শিক্ষকতা শুরু। পরবর্তীকালে তাঁর অধ্যাপনা চট্টগ্রাম কলেজ ও রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকও ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান। ফের আশির দশকে এ বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কালক্রমে তিনি ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর নিয়োজিত থাকেন। ঢাকার ইস্কাটন রোডে অবস্থিত আইএএসটিটির গণিত বিশেষজ্ঞ হিসেবে দীর্ঘদিন অধিষ্ঠিত থেকে দেশে সামার সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় তিনি প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন।
গণিতশিক্ষার উন্নতিবিধানে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠিত গণিতবিষয়ক বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ ও সম্মেলনে যোগদানের সুযোগ হয়েছে তাঁর। ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ কার্যকালে প্রফেসর শরফুদ্দিন বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি হিসেবে আমার কার্যকালে (২০০৮ ও ২০০৯) ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে সমিতি ১৯ জন বর্ষীয়ান গণিতবিদকে সম্মাননা প্রদান করে। আমার সভাপতিত্বে আয়োজিত এ মহতী ও প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। প্রফেসর শরফুদ্দিনও ছিলেন সম্মাননাপ্রাপ্ত গণিতবিদদের অন্যতম।
২০০৯ সালের ১৩ আগস্ট ড. শরফুদ্দিন সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর কয়েক লাখ টাকার সহস্রাধিক নিজস্ব গণিত বই গণিত সমিতিকে দান করেন। পত্রপত্রিকায় এ-সংক্রান্ত খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশ গণিত সমিতির কার্যকালে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত।
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালামের সঙ্গে প্রফেসর শরফুদ্দিনের ছিল ঘনিষ্ঠতা। প্রফেসর শরফুদ্দিন গণিত সমিতির সভাপতি থাকাকালীন ১৯৮৬ সালে ডিসেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমিতির পঞ্চম গণিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমি ছিলাম ওই সম্মেলনের সাংগঠনিক সম্পাদক। সম্মেলনে প্রফেসর সালামকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলে অন্য কর্মসূচি থাকার কারণে সবিনয়ে তিনি এতে যোগদানের অপারগতা প্রকাশ করেন এবং একইসঙ্গে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ সালের প্রফেসর শরফুদ্দিনের কাছে লেখা এক পত্রের মাধ্যমে। পত্রটি উৎসাহব্যঞ্জক ও প্রেরণাদায়ক।
শরফুদ্দিন স্যার কেন জানি না, আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমিও স্যারের প্রতি ছিলাম শ্রদ্ধাশীল। সব সময়ই তিনি হাসিমুখে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন।
সুঠামদেহী প্রফেসর শরফুদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে গণিত অঙ্গনের যে ক্ষতিসাধিত হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এই খ্যাতিমান গণিতবিদ, এই মনস্বী শিক্ষাবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর কর্ম, তাঁর জীবনদর্শন আমাদের কাছে উজ্জ্বল ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তিনি জয়ী হয়েছেন গণিতের জন্য ভালোবাসায় উজ্জীবিত কর্মের সাধনায়।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে অনেক গণিতজ্ঞের পরিবারেও নেমে আসে চরম দুর্দিন। বিপন্ন পরিবারগুলোকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পুনর্বাসনের জন্য কিছু ঐতিহ্যবাহী বিদেশি সংস্থার প্রতি আবেদন-নিবেদনের মহৎ কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ড. শরফুদ্দিন। আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি, দি পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সঙ্গে পত্রযোগাযোগ করে তিনি আর্থিক অনুদান প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। এ অনুদান নবগঠিত বাংলাদেশ গণিত সমিতির কাছে হস্তান্তর করা হয়। উদার সহযোগিতা ও মহানুভবতার জন্য প্রফেসর এস এম শরফুদ্দিন আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
গণিত শিক্ষার মহানব্রতে উৎসর্গীকৃত গণিত অঙ্গনের এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাঁকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি। নিবেদন করছি তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রফেসর এম শামসুর রহমান
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ গণিত সমিতি

No comments

Powered by Blogger.