প্রজ্ঞাপন জারি করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অপেক্ষায় অভিযুক্ত স্কুলগুলো-বাড়তি টাকা ফেরত দিতে হবে by শরিফুজ্জামান ও মানসুরা হোসাইন

স্কুলে ভর্তির জন্য নেওয়া অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে হবে। শুধু ভর্তি ফি নয়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে মোটা অঙ্কের অনুদানও (ডোনেশন) নিচ্ছে। এই টাকাও ফেরত দিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানান, প্রজ্ঞাপন জারির আগে আনুষঙ্গিক কিছু প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, সবাই বেশি টাকা নেওয়ার প্রতিবাদ করছে, নিন্দা জানাচ্ছে। স্কুলগুলোর উচিত আর বেশি টাকা না নেওয়া এবং যারা বেশি নিয়েছে, তাদের উচিত নৈতিক দায়িত্ব থেকে টাকা ফেরত দেওয়া।
এদিকে, বাড়তি টাকা ফেরত দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে রাজধানীর অভিযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ডেকে তা কার্যকর করা হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা সভাপতি পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাই সাংসদ বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এ ধরনের অন্যায় থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করা সাংসদদের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং তাঁরা এমন দায়িত্বশীল আচরণ করবেন, এটা আমজনতার প্রত্যাশা।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জানুয়ারি আদালত সরকারি নীতিমালার বাইরে ভর্তির ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ আদায়ের ঘটনা তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। ঘটনা তদন্ত করে বাড়তি অর্থ কেন ফেরত দেওয়া হবে না এবং বাড়তি অর্থ আদায়কারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত।
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তির ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকার বেশি নিতে পারবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক খরচ বিবেচনা করে এ বছর কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যমে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে। যেকোনো শ্রেণীতে এর বেশি টাকা যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়েছে, তা ফেরত অথবা সমন্বয় করতে বলা হবে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টাকা ফেরত দেওয়া ছাড়া এ বছর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে ২০১৩ সালের স্কুলভর্তির ক্ষেত্রে বেশি টাকা নেওয়া হলে এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) বাতিল, অনুদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল এবং প্রয়োজনে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বন্ধ করা হবে। ২০১৩ সালের ভর্তি উপলক্ষে চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে ভর্তি নীতিমালা প্রকাশ করা হবে।
সূত্রমতে, ওই নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প ভাবা হচ্ছে। একটি হলো বিশেষ, বড় ও অভিজাত কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা ভর্তি ফি নির্ধারণ করা। অন্যটি হলো, সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সাধারণ ভর্তি ফি থাকলেও এর বেশি যারা নিতে চায়, তাদের যুক্তি দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ কোটি বই বিনা মূল্যে দেওয়া, লটারির মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত উপায়ে শিশুদের ভর্তি করার যে ভালো লাগা সবার মধ্যে বিরাজ করছিল, তাতে কালিমা লেপন করেছে অতিরিক্ত ফি আদায়ের ঘটনা।
৩২ প্রতিষ্ঠানে জরিপ, ২৪টি বেশি টাকা নিয়েছে: ভর্তি নীতিমালার আলোকে কোন প্রতিষ্ঠান কত টাকা নিচ্ছে, তা অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা মহানগরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৪০০। এগুলোর মধ্যে ৩২টি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ চালিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত সাত সদস্যের কমিটি। কমিটি এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখেছে, ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টিই সরকারি ভর্তি নীতিমালার বাইরে টাকা নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান ভর্তি ফি ১০ হাজার টাকার বেশি নিয়েছে। নীতিমালার বাইরে বেশি টাকা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, মিরপুর বাংলা হাইস্কুল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
বেশি টাকা নেয়নি যেসব প্রতিষ্ঠান: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দেখা গেছে, ২৪টির মধ্যে আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি টাকা নেয়নি। এগুলো হচ্ছে: ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কিশলয় বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, বর্ণমালা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল এবং কাকলী উচ্চবিদ্যালয়।
আদেশ পেলে টাকা ফেরত: মনিপুর স্কুলে বেশি টাকা নেওয়ার ঘটনা নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক সমালোচনা শুরু হয়। তথ্য জানতে গেলে ওই স্কুলের সভাপতি ও সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার একজন নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করেন। পরে ওই সাংসদ অভিযোগ অস্বীকার করলেও বেশি টাকা নেওয়ার প্রতিবাদে অভিভাবকেরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন।
মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখেছি, সরকার টাকা ফেরত দিতে বা সমন্বয় করতে বলেছে। আনুষ্ঠানিক চিঠি পেলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, কেন বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে, তা বারবার বলা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ৬৫০ শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে এমপিওভুক্ত ১০১ জন। বাকিদের বেতন, বিশুদ্ধ পানি, লিফট, মেডিকেল সেন্টার, যাতায়াত, অভিভাবকদের বসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ইব্রাহিমপুর ও শেওড়াপাড়ায় দুটি শাখা খোলার জন্য ঋণ নিতে হয়েছে। এসব সুযোগ-সুবিধা চলমান রাখতে হলে টাকা নেওয়ার বিকল্প নেই।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ বেড়েছে। নতুন কমিটির এখনো সভা হয়নি। এ মাসের শেষ নাগাদ কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার বললে টাকা ফেরত দিতেই হবে।
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন বলেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানটির তিনটি ভবনের মধ্যে দুটি নতুন কেনা হয়েছে। তাই প্লে-গ্রুপে উন্নয়ন ফি ২২ হাজার (এ ছাড়া সেশন ফি চার হাজার, বেতন ৭৫০ টাকা) টাকা নেওয়া হয়েছে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি গোলাম আশরাফ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তি ফি ফেরত দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সিদ্ধান্ত হয়নি।’
শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি নীতিমালা মানতে সবাই বাধ্য। যারা বেশি টাকা নিয়েছে, ফেরত দেবে এবং শিগগির এ নির্দেশ দেবে মন্ত্রণালয়।

জনপ্রতি ভর্তি ফি (বেতন ছাড়া)
আইডিয়াল স্কুল, মুগদা শাখা (অনুদান) ২,১১,৯০০ টাকা
আইডিয়াল স্কুল, মুগদা শাখা (মেধা) ৩১,৯০০ টাকা
আইডিয়াল স্কুল, মতিঝিল (ইংরেজি) ১৭,৯০০ টাকা
আইডিয়াল স্কুল, মতিঝিল (বাংলা) ১১,৯০০ টাকা
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ২৭,৫০০ টাকা
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ২৪,৮০০ টাকা
শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল ২৩,৭৪০ টাকা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল (ইংরেজি) ১৩,৩০০ টাকা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল (বাংলা) ১১,৬০০ টাকা
বিয়াম মডেল স্কুল ১৩,১০০ টাকা

No comments

Powered by Blogger.