শ্রদ্ধাঞ্জলি-বড় অভিমান ছিল তাঁর
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল সারা দেশ, উত্তাল ঢাকার চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বড় ভাই বা সহপাঠীদের সঙ্গে সারা দিন ব্যস্ত থাকা। দিনমান শুধু দেয়াললিখন আর পোস্টার তৈরি করা। ভাষা আন্দোলনের জন্য মনের মধ্যে নতুন ভাবনার উঁকি দেওয়া। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। শিল্পী মবিনুল আজিম তখন চারুকলায় দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন মায়ের ভাষাকে আগলে রাখতে।
হেমন্তের এক মধ্যদুপুরে যখন শিল্পী মবিনুল আজিমের গল্প শোনার জন্য তাঁর স্ত্রী মমতাজ আজিমের বাসায় হাজির হলাম, মমতাজ আজিম তখন স্বামীকে নিয়ে খুলে বসলেন স্মৃতির ঝাঁপি। ফিরে গেলেন অতীতের দিনগুলোতে।
দেয়ালে শোভা পাওয়া চিত্রকর্মগুলো দেখে যখন শিল্পী মবিনুল আজিমকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, তখন এই শিল্পী আছেন কোনো এক না-ফেরার দেশে।
কবিতা বড্ড বেশি ভালোবাসতেন মবিনুল আজিম। আর এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীনের কবিতার সঙ্গে চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন শিল্পী। ইচ্ছা ছিল, এই কবিতার সঙ্গে চিত্রকর্মগুলো দিয়ে স্থায়ী একটি জাদুঘর গড়বেন। সেই ইচ্ছা সঙ্গে নিয়ে সাভারে একটি স্থানে জমিও কেনা হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছারা ডানা মেলার আগেই শিল্পী চলে গেলেন এই জগৎ ছেড়ে।
শিল্পী মবিনুল আজিমের কথা বলছি। নিভৃতচারী এই শিল্পী ১৯৩৪ সালে জন্মেছেন মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছিলেন। এই স্বপ্নের ডালপালা মেলে ধরতে ১৯৫০ সালে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ১৯৫৫ সালে চারুকলায় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ছবি আঁকায়ই নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
শিল্পী মবিনুল আজিমের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে বসেই শিল্পী অনেক সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম করেছেন। করাচিতে থাকা অবস্থায় তাঁর বাড়িতে এ দেশের বিভিন্ন শিল্পী বেড়াতে যেতেন। তাঁদের দেখেই বারবার দেশে আসার জন্য ছটফট করতে থাকেন শিল্পী মবিনুল আজিম। দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের করাচিতে সব ফেলে দেশে এসেই নতুনভাবে জীবন শুরু করেন তিনি।
শিল্পী মবিনুল আজিমের জীবদ্দশায় ছবির প্রদর্শনী হয়েছে মোট ৫৪টি। এর মধ্যে ৩৭টি ছিল যৌথ ও ১৭টি একক। এর মধ্যে ১৪টি প্রদর্শনী হয়েছে বাংলাদেশে এবং ৪০টি প্রদর্শনী হয়েছে দেশের বাইরে।
সে সময় পশ্চিম পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিল্পীর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়।
১৯৯৮ সালে শিল্পী মবিনুল আজিমের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সে সময় শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে মবিনুল আজিমকে নিয়ে শিল্পী ও শিল্পসমালোচক সৈয়দ জাহাঙ্গীর লিখেছেন, তিনি একজন সত্যিকার অর্থে ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট’ বা বিমূর্ত প্রকাশবাদী শিল্পী ছিলেন।
পেশাদার শিল্পী হিসেবে মবিনুল আজিম বাস্তবধর্মী ছবি আঁকতেন, মাটি আর মানুষ ছিল যার বিষয়বস্তু। তিনি এঁকেছেন নদী, পালতোলা নৌকা, গ্রাম, ঘরবাড়ি। এরপর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি মবিনুল আজিম জলরং আর মিশ্র মাধ্যমে কাজ করতেন। তাঁর আঁকা শত শত জলরঙের মধ্যে রয়েছে একটি পাহাড়ি নিসর্গ, যার সামনের অংশে একটি হ্রদ এবং পেছনে দাঁড়ানো সারি সারি পাইনগাছ। সোনারগাঁ, গ্রামের পুকুর থেকে দুই কিশোরীর জল সংগ্রহের দৃশ্য, লাল রঙে ভরাট জমিনে সাদাকালো রঙে আঁকা এক জোড়া পায়রা। এ ছাড়া মরু ফুল, আদিবাসী নারী, রাতে জেলেনৌকা, বসন্তের সিরিজ, চন্দ্রালোকিত বুড়িগঙ্গা প্রভৃতি ছবি থেকেও শিল্পী মবিনুল আজিমের তেলরঙের মুনশিয়ানার কথা জানা যায়।
স্বাধীনতার পর বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক স্যার মার্ক টালি বাংলাদেশ সফরে এলে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মার্ক টালিকে শিল্পী মবিনুল আজিমের আঁকা একটি ছবি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৪ সালে শিল্পী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি পোর্ট্রেট আঁকেন। এর মধ্যে একটি এখন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার কাছে আছে।
দেশের টানে শিল্পী মবিনুল আজিমের ফিরে আসা হলেও নানাভাবে তিনি থেকে গেছেন অন্তরালে। দেশে ফিরে এক রকম অভিমান পেয়ে বসেছিল এই শিল্পীকে। আর এই অভিমানে তিনি ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর না-ফেরার দেশে চলে যান। শিল্পীর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর মেয়ে সুমায়রা আজিম লিখেছিলেন, ‘আশা করি, বাবা মবিনুল আজিম নন, শিল্পী মবিনুল আজিম হারিয়ে যাবেন না চিরতরে। তিনি আছেন এখনো যেমন আমাদের পরিবারের মধ্যে, তেমনি থাকবেন এ দেশের শিল্পী ও শিল্পরসিকদের মধ্যে চিরদিন, তাঁর শৈল্পিক সৃষ্টির মাধ্যমে।’ শিল্পী মবিনুল আজিমের স্ত্রী মমতাজ আজিম কিছুটা অভিমান করেই বলেন, ‘দেশের জন্য শিল্পী মবিনুল আজিমের অনেক অবদান থাকলেও এখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তাঁকে সম্মানজনক কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।’ একরাশ হতাশা নিয়ে তিনি তাঁর স্বামী মবিনুল আজিমের কথা নয়, একজন শিল্পী মবিনুল আজিমের স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন বারবার। আর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে শিল্পী মবিনুল আজিমের একটি সাদাকালো ছবি দেখিয়ে ফিরে যান পুরোনো সেই দিনগুলোতে; যখন তুলি আর রং নিয়ে হরদম খেলতেন শিল্পী। শিল্পী মবিনুল আজিম বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে—এমন স্বপ্নই দেখেন তিনি।
মোছাব্বের হোসেন
লক্ষ করুন: ৩০ অক্টোবর খোলা কলম ফিচারে কবি মঈনুদ্দীনের নাম অনবধানতাবশত মঈনুদ্দীন হোসাইন ছাপা হয়েছে। দুঃখিত। —বি.স.
দেয়ালে শোভা পাওয়া চিত্রকর্মগুলো দেখে যখন শিল্পী মবিনুল আজিমকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, তখন এই শিল্পী আছেন কোনো এক না-ফেরার দেশে।
কবিতা বড্ড বেশি ভালোবাসতেন মবিনুল আজিম। আর এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীনের কবিতার সঙ্গে চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন শিল্পী। ইচ্ছা ছিল, এই কবিতার সঙ্গে চিত্রকর্মগুলো দিয়ে স্থায়ী একটি জাদুঘর গড়বেন। সেই ইচ্ছা সঙ্গে নিয়ে সাভারে একটি স্থানে জমিও কেনা হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছারা ডানা মেলার আগেই শিল্পী চলে গেলেন এই জগৎ ছেড়ে।
শিল্পী মবিনুল আজিমের কথা বলছি। নিভৃতচারী এই শিল্পী ১৯৩৪ সালে জন্মেছেন মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছিলেন। এই স্বপ্নের ডালপালা মেলে ধরতে ১৯৫০ সালে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ১৯৫৫ সালে চারুকলায় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ছবি আঁকায়ই নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
শিল্পী মবিনুল আজিমের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে বসেই শিল্পী অনেক সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম করেছেন। করাচিতে থাকা অবস্থায় তাঁর বাড়িতে এ দেশের বিভিন্ন শিল্পী বেড়াতে যেতেন। তাঁদের দেখেই বারবার দেশে আসার জন্য ছটফট করতে থাকেন শিল্পী মবিনুল আজিম। দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের করাচিতে সব ফেলে দেশে এসেই নতুনভাবে জীবন শুরু করেন তিনি।
শিল্পী মবিনুল আজিমের জীবদ্দশায় ছবির প্রদর্শনী হয়েছে মোট ৫৪টি। এর মধ্যে ৩৭টি ছিল যৌথ ও ১৭টি একক। এর মধ্যে ১৪টি প্রদর্শনী হয়েছে বাংলাদেশে এবং ৪০টি প্রদর্শনী হয়েছে দেশের বাইরে।
সে সময় পশ্চিম পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিল্পীর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়।
১৯৯৮ সালে শিল্পী মবিনুল আজিমের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সে সময় শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে মবিনুল আজিমকে নিয়ে শিল্পী ও শিল্পসমালোচক সৈয়দ জাহাঙ্গীর লিখেছেন, তিনি একজন সত্যিকার অর্থে ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট’ বা বিমূর্ত প্রকাশবাদী শিল্পী ছিলেন।
পেশাদার শিল্পী হিসেবে মবিনুল আজিম বাস্তবধর্মী ছবি আঁকতেন, মাটি আর মানুষ ছিল যার বিষয়বস্তু। তিনি এঁকেছেন নদী, পালতোলা নৌকা, গ্রাম, ঘরবাড়ি। এরপর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি মবিনুল আজিম জলরং আর মিশ্র মাধ্যমে কাজ করতেন। তাঁর আঁকা শত শত জলরঙের মধ্যে রয়েছে একটি পাহাড়ি নিসর্গ, যার সামনের অংশে একটি হ্রদ এবং পেছনে দাঁড়ানো সারি সারি পাইনগাছ। সোনারগাঁ, গ্রামের পুকুর থেকে দুই কিশোরীর জল সংগ্রহের দৃশ্য, লাল রঙে ভরাট জমিনে সাদাকালো রঙে আঁকা এক জোড়া পায়রা। এ ছাড়া মরু ফুল, আদিবাসী নারী, রাতে জেলেনৌকা, বসন্তের সিরিজ, চন্দ্রালোকিত বুড়িগঙ্গা প্রভৃতি ছবি থেকেও শিল্পী মবিনুল আজিমের তেলরঙের মুনশিয়ানার কথা জানা যায়।
স্বাধীনতার পর বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক স্যার মার্ক টালি বাংলাদেশ সফরে এলে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মার্ক টালিকে শিল্পী মবিনুল আজিমের আঁকা একটি ছবি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৪ সালে শিল্পী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি পোর্ট্রেট আঁকেন। এর মধ্যে একটি এখন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার কাছে আছে।
দেশের টানে শিল্পী মবিনুল আজিমের ফিরে আসা হলেও নানাভাবে তিনি থেকে গেছেন অন্তরালে। দেশে ফিরে এক রকম অভিমান পেয়ে বসেছিল এই শিল্পীকে। আর এই অভিমানে তিনি ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর না-ফেরার দেশে চলে যান। শিল্পীর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর মেয়ে সুমায়রা আজিম লিখেছিলেন, ‘আশা করি, বাবা মবিনুল আজিম নন, শিল্পী মবিনুল আজিম হারিয়ে যাবেন না চিরতরে। তিনি আছেন এখনো যেমন আমাদের পরিবারের মধ্যে, তেমনি থাকবেন এ দেশের শিল্পী ও শিল্পরসিকদের মধ্যে চিরদিন, তাঁর শৈল্পিক সৃষ্টির মাধ্যমে।’ শিল্পী মবিনুল আজিমের স্ত্রী মমতাজ আজিম কিছুটা অভিমান করেই বলেন, ‘দেশের জন্য শিল্পী মবিনুল আজিমের অনেক অবদান থাকলেও এখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তাঁকে সম্মানজনক কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।’ একরাশ হতাশা নিয়ে তিনি তাঁর স্বামী মবিনুল আজিমের কথা নয়, একজন শিল্পী মবিনুল আজিমের স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন বারবার। আর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে শিল্পী মবিনুল আজিমের একটি সাদাকালো ছবি দেখিয়ে ফিরে যান পুরোনো সেই দিনগুলোতে; যখন তুলি আর রং নিয়ে হরদম খেলতেন শিল্পী। শিল্পী মবিনুল আজিম বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে—এমন স্বপ্নই দেখেন তিনি।
মোছাব্বের হোসেন
লক্ষ করুন: ৩০ অক্টোবর খোলা কলম ফিচারে কবি মঈনুদ্দীনের নাম অনবধানতাবশত মঈনুদ্দীন হোসাইন ছাপা হয়েছে। দুঃখিত। —বি.স.
No comments