বিডিআরের মত ছাত্রলীগের নাম পাল্টানোও কি জরুরি? by ফজলুল বারী
দেশে তাদের সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র চলছে। এখনও অভ্যুত্থান চক্রান্তের পুরোটা উদঘাটিত হতে পারল না, আর উনারা আছেন মহাআনন্দে-মনেরসুখে।এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে কোপাতে দা হাতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। উনাদের দলীয় স্বপ্ন, প্রতিজ্ঞা ডিজিটাল বাংলাদেশ। আর উনাদের তরুণ প্রজন্মের কর্মীদের হাতে দা।
বটি দা, রাম দা, ছুরি-চাপাতি, এসব। হরকাতুল জিহাদের জঙ্গি মোল্লারা যখন এমন দা-চাপাতি হাতে দেশবরেণ্য সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদকে কোপালো, রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদের পাশে দাঁড়িয়ে ঘৃণায়-প্রতিবাদে উচ্চকিত হল সারা বাংলাদেশ। আর এখানে দেখছি কী সব চেহারা? অস্ত্র তো এক, নাঙ্গা দা-চাপাতি। স্পট আর চেহারা-পোশাকগুলো শুধু আলাদা। ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা যে এভাবে রাজধানী ঢাকা শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত নাঙ্গা দা হাতে সন্ত্রাসের প্রকাশ্য মহড়া দিল এরা কার, কোন আদর্শের সৈনিক? আমি জানি, মানুষ মনে মনে-এর মাঝে কার নাম বলে ফেলেছেন। প্লিজ এদের মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলার অপচেষ্টা কেউ করবেন না। এরা স্রেফ গুন্ডা। গুন্ডার কোনো আদর্শ থাকে না। থাকা লাগে না।
তোফায়েল আহমেদসহ ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নেতারা কথা বলুন প্লিজ। প্রতিবাদ করুন। মন্ত্রিত্বের আশায় চুপ করে বসে থাকবেন না। মন্ত্রিত্বের চাইতে বাংলাদেশের ইতিহাসে আপনাদের আসন-অবস্থান অনেক উঁচুতে।
বিডিআরের নাম পাল্টে যেমন বিজিবি করা হয়েছে, এ ধরনের নীতি-আদর্শ খোয়া যাওয়া সংগঠন রাখতে চাইলে দরকার হলে ছাত্রলীগের নাম পাল্টাতে বলুন। এই গুন্ডাদের চেহারা ছাত্রলীগের না। মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের ইজ্জত কা সওয়াল।
ছবিতে আমরা যে গুন্ডাদের দেখলাম, এদের মা-বাবা, অভিভাবকই বা কারা? এদের পারিবারিক শিক্ষাই বা কী?
অভিভাবকরা কী এদের পড়াশুনার খরচ দেন না? না এভাবে আয়-রোজগারের জন্য নাঙ্গা দা হাতে নামিয়ে দিয়েছেন রাস্তায়?
বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেদের হাতে এমন নাঙ্গা দা-চাপাতি দেখে কী বাবা-মা হিসেবে বিন্দুমাত্র লজ্জা-অনুশোচনা হয়েছে কী? ছেলে বখে গেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তো আইনের হাতে তুলে দেওয়া বা ত্যাজ্য করারও আইনগত বিধান আছে।
এমন কিছুও যদি আপনাদের মন না চায়, তাহলে দেশের মানুষের পক্ষে একটি মন্তব্যই করার আছে, তাহলো, ছি!
মঙ্গলবার ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা দিনে দুপুরে দা হাতে এমন উন্মত্ত সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। এক গ্রুপের কোপে আহত-জখম হয়েছে আরেক গ্রুপের ক্যাডাররা। কারণ কথিত মাগুরা সমিতির নামে চাঁদা তোলাতুলির দ্বন্দ্ব।
দেশের প্রায় সব পত্রিকা-মিডিয়ার ফটো সাংবাদিকরা এসব উন্মত্ত সরকারি গুন্ডাদের ছবি তুলেছেন। কিন্তু পুলিশের চোখের সামনে সবকিছু ঘটলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা এদের একটারেও আটকায়নি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে সতর্ক অবস্থান নেওয়াতে হতাহতের ঘটনা কম ঘটেছে।
এটা কী পুলিশের কাজ? চোখের সামনে দিনে দুপুরে গুন্ডা ধরা পড়ে যাওয়াতে ছাত্রলীগ যাদের আইওয়াশ মার্কা বহিষ্কার করেছে, তাদের একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করে আইনের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বা সে চেষ্টাও আছে কি? ছি!ছি!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বচন শুনতে আর ভাল লাগে না। ঘেন্না লাগে। মঙ্গলবারও মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আজকাল মিডিয়ার সঙ্গে তার কথা বলা মানে আরও এক প্রস্থ অসত্য-মিথ্যা বলা। দেশে অপ্রতিরোধ্য গুম সন্ত্রাস নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক লাইনে বলে দিলেন রিপোর্ট মিথ্যা। ক্রসফায়ার মিথ্যা, গুম মিথ্যা, লিমনের যে একটা পা নেই, সেটিও মিথ্যা। দেশের সব মানুষ খালি সারাদিন মিথ্যা বলছে। আর একমাত্র সত্যবাদী, সততার পরাকাষ্ঠা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন।
ভাগ্যিস মঙ্গলবার জগন্নাথে ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা যে দা হাতে কোপাকুপি করেছে, সেটিকেও মিথ্যা দাবি করে বসেননি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। করলে করতেও পারতেন। তার পক্ষে তো কিছুই অসম্ভব না। অন্তত সে প্রমাণ তিনি ঢের রেখেছেন।
ঢাকা শহরে কামাল মজুমদার নামের একজন এমপি যে সবার চোখের সামনে একজন নারী সাংবাদিকের গায়ে হাত তুলেছিলেন, তাকে কী গ্রেফতার করা হয়েছিল? ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা কি করে শুধুই বেপরোয়া হওয়ায় স্পর্ধা-আস্কারা পায়, তা কি ভেবে দেখার দায়দায়িত্ব সরকার তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়? আইন যে তার কাছে সমান নয় তা কি এই একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট নয়? উল্টো সারাদিন নানা সত্যকে মিথ্যা মিথ্যা বলে চিল্লালে দেশভর্তি মিথ্যাবাদী ভোটাররাই কী ভোট দিয়ে এই সরকারকে, এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল? ইনাদের আগামীতে ভোট করতে কি দেশের পাবলিকের ভোট লাগবে না? পাবলিককে সারাদিন ডাঁহা মিথ্যাবাদী বলে গেলে অথবা তাদের সঙ্গে বিরামহীন মিথ্যা বলতে থাকলে পাবলিকের উনাদের ব্ল্যাঙ্কচেক ভোট দিয়ে যেতে কোনো দায় পড়েছে? একটা অসম্ভব জনপ্রিয় একটি দল চোখের সামনে কি করে জনপ্রিয়তা হারাল এবং হারাচ্ছে তা আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ইনাদের শেয়ার বাজারের পরিস্থিতিতে কিছু যায় আসে না, সীমান্তে দেশের মানুষকে ন্যাঙটা করে পিটালেও না।
ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডাদের সন্ত্রাস নিয়ে আমরা লিখেই চলেছি। সরকারি লোকজনের এসব নিয়ে কোনো বিকার-প্রতিক্রিয়া নেই! সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওবায়দুল কাদের আগে মাঝে মাঝে যা একটু সত্য বলতেন, তাও এখন বন্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের এমন দাওয়াই দিয়েছেন যে, মন্ত্রিত্ব পেয়ে তাদেরও মুখ বন্ধ। যেন আগে মন্ত্রিত্ব না পাবার রাগে-দু:খে তারা এমনসব ভাল ভাল কথা বলতেন! মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন ভাল কথার দুই বাপজান। প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে আরও যাদের মন্ত্রী হবার আশা তাদের মুখও বন্ধ। যে দেবতা যে ভোগে সন্তুষ্ট! কিন্তু দেশের মানুষের চোখ-মুখ বন্ধ করবে কে? ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা এই ক’দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জুবায়ের নামের এক কর্মীকে জিআই পাইপ দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। এখন পর্যন্ত অশান্ত জাবি ক্যাম্পাস। শিক্ষকরা ক্লাস বাদ দিয়ে কাফনের কাপড় পরে মিছিল করছেন। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এদের কারোরই এ নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমদ জাবির সাবেক উপাচার্য। তার মুখেও এসব নিয়ে কোনও রা নেই! জুবায়ের হত্যার পর সেখানে উপাচার্য গ্রুপ নামের ছাত্রলীগ নামধারী একদল গুন্ডার কথা জানা গেল। এ গ্রুপের গুন্ডারা জুবায়েরকে হত্যা করেছে। কিন্তু যেখানে একজন শিক্ষক নামধারী ব্যক্তির উপাচার্যগিরি করতে এ ধরনের একটা গুন্ডাবাহিনী পোষা লাগে, তাকে সেখানে গদিনশীন রেখে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করে বিদ্যা শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ আশা করা যায়, এ প্রশ্ন আমরা রেখেছি আগে। কিন্তু কেউ শোনেননি। জাবির একাডেমিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হচ্ছে না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে উন্নয়ন ফির নামে বাড়তি টাকা আদায় প্রতিরোধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করলে পুলিশের পাশাপাশি তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী একদল গুন্ডা। আক্রান্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তখন অভিযোগ করে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের মেরে-কুটে আন্দোলন নস্যাৎ করতে ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা ভাড়া করেছে। দায়িত্বশীলদের কেউ তাদের অভিযোগে তখন গা করেননি। কিন্তু ওই সময়ই দেখা গেল ক্যান্টিনে ফাও খাওয়ার দাবি নিয়ে এসব গুন্ডারা ক্যান্টিন ভাঙচুর, ক্যান্টিন ম্যানেজারকে মারধর করল। তখন অনেকে মজা করে বললেন, গুন্ডা ভাড়া করলে তো তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা করেনি বলে ফ্রি খাওয়াদাওয়ার দাবিতে তারা একটু হৈচৈ করেছে তো, এমন কি আর খারাপ করেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর যারা জানেন, তারা বলছেন সেখানে ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা যে এমন তেড়েবেড়ে উঠেছে, এখন এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দা হাতে কোপাতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এর পুরো দায়দায়িত্ব সেখানকার মেরুদণ্ডহীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুরনো ঢাকার পুরনো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গত দুই-আড়াই যুগে কখনোই ছাত্রলীগের আধিপত্য ছিল না। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে চলে গেলে ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা ছাত্রলীগে থাকে না। ছাত্রদল বা ছাত্রসমাজ হয়ে যায়। আওয়ামী আগামীতে বিরোধী দলে চলে গেলেও এদের একটিও থাকবে না। এখন দলকে ডোবাতে যা যা করার দরকার সব এই তস্কররা করছে। এখন গুন্ডামির জন্য ছাত্রলীগ যাদের বহিষ্কার করেছে অন্তত তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করবে কর্তৃপক্ষ? এসব দা মার্কা গুন্ডা-সন্ত্রাসীকে রেখে কি সেখানে পড়াশুনার স্বাভাবিক পরিবেশ সম্ভব? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মেরুদণ্ডের জোর দেখা যাক।
দেশে আমরা হিযবুত তাহরীর নামের নিষিদ্ধ মোল্লা সংগঠন, যুদ্ধাপরাধীদের আন্ডাবাচ্চা সংগঠন রগকাটা শিবিরের বিরুদ্ধে বলছি-লিখছি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কোনোদিন সেশনজট জমতে পারেনি, গোলাম আযমের মতো যুদ্ধাপরাধী নাম্বার ওয়ানের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে শিবির সেখানে কি ত্রাসের সৃষ্টি করে রেখেছে তা সবাই ওয়াকিফহাল আছেন। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ছাত্রলীগ কি করছে? এটির এখন কী চেহারা? ছাত্রলীগ নামধারী ঐতিহ্যের সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃ্ত্বের ব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্য হারিয়ে কি প্রকারে আদর্শ-লক্ষ্যহীন সন্ত্রাসীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, এটি দেশের সব মানুষ দেখছেন। দেশ শাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণের সামর্থ থাকবে না, সমস্যা কোথায়, এসব বারবার বলেও নিরুত্তর শাসকদল! এটির কাজ কি শুধু শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফর আর ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির খুশিতে মিছিল আর বছরের বাকিসময় গুন্ডামি-চাঁদাবাজি করা? এমন কী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রগতিশীল সংগঠন বা স্বাধীন ব্লগারদের যে ভূমিকা আছে এর বিন্দুবিসর্গও ছাত্রলীগের আছে কি? না তাদের সে সময় আছে? চাঁদাবাজি আর গুন্ডামি, ছাত্রলীগ নামধারীদের এসব নয়া কর্মসূচি ঠিক করে দিয়েছে কে? এর উত্তর আওয়ামী নেতৃ্ত্বকে দিতে হবে। মুখ বন্ধ করে থাকলে কি পাবলিকের মুখ বন্ধ আছে? মানুষ কিন্তু ক্ষেপে আছে।
গুন্ডামিতে দেখলে পুলিশ যদি সবাইকে ধরে আর ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের ধরা এড়িয়ে চলে তাহলে কিন্তু ধৈর্যের বাঁধভাঙ্গা ধরাধরি শুরু করে দিলে কিন্তু তাদের থামানো যাবে না। পাবলিক কখন ক্ষেপে আর ক্ষেপে গেলে কি করে তা নিশ্চয় আওয়ামী লীগের মতো দলকে কারও গ্রামার বই হাতে নিয়ে ধরে ধরে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
তোফায়েল আহমেদসহ ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নেতারা কথা বলুন প্লিজ। প্রতিবাদ করুন। মন্ত্রিত্বের আশায় চুপ করে বসে থাকবেন না। মন্ত্রিত্বের চাইতে বাংলাদেশের ইতিহাসে আপনাদের আসন-অবস্থান অনেক উঁচুতে।
বিডিআরের নাম পাল্টে যেমন বিজিবি করা হয়েছে, এ ধরনের নীতি-আদর্শ খোয়া যাওয়া সংগঠন রাখতে চাইলে দরকার হলে ছাত্রলীগের নাম পাল্টাতে বলুন। এই গুন্ডাদের চেহারা ছাত্রলীগের না। মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের ইজ্জত কা সওয়াল।
ছবিতে আমরা যে গুন্ডাদের দেখলাম, এদের মা-বাবা, অভিভাবকই বা কারা? এদের পারিবারিক শিক্ষাই বা কী?
অভিভাবকরা কী এদের পড়াশুনার খরচ দেন না? না এভাবে আয়-রোজগারের জন্য নাঙ্গা দা হাতে নামিয়ে দিয়েছেন রাস্তায়?
বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেদের হাতে এমন নাঙ্গা দা-চাপাতি দেখে কী বাবা-মা হিসেবে বিন্দুমাত্র লজ্জা-অনুশোচনা হয়েছে কী? ছেলে বখে গেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তো আইনের হাতে তুলে দেওয়া বা ত্যাজ্য করারও আইনগত বিধান আছে।
এমন কিছুও যদি আপনাদের মন না চায়, তাহলে দেশের মানুষের পক্ষে একটি মন্তব্যই করার আছে, তাহলো, ছি!
মঙ্গলবার ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা দিনে দুপুরে দা হাতে এমন উন্মত্ত সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। এক গ্রুপের কোপে আহত-জখম হয়েছে আরেক গ্রুপের ক্যাডাররা। কারণ কথিত মাগুরা সমিতির নামে চাঁদা তোলাতুলির দ্বন্দ্ব।
দেশের প্রায় সব পত্রিকা-মিডিয়ার ফটো সাংবাদিকরা এসব উন্মত্ত সরকারি গুন্ডাদের ছবি তুলেছেন। কিন্তু পুলিশের চোখের সামনে সবকিছু ঘটলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা এদের একটারেও আটকায়নি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে সতর্ক অবস্থান নেওয়াতে হতাহতের ঘটনা কম ঘটেছে।
এটা কী পুলিশের কাজ? চোখের সামনে দিনে দুপুরে গুন্ডা ধরা পড়ে যাওয়াতে ছাত্রলীগ যাদের আইওয়াশ মার্কা বহিষ্কার করেছে, তাদের একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করে আইনের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বা সে চেষ্টাও আছে কি? ছি!ছি!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বচন শুনতে আর ভাল লাগে না। ঘেন্না লাগে। মঙ্গলবারও মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আজকাল মিডিয়ার সঙ্গে তার কথা বলা মানে আরও এক প্রস্থ অসত্য-মিথ্যা বলা। দেশে অপ্রতিরোধ্য গুম সন্ত্রাস নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক লাইনে বলে দিলেন রিপোর্ট মিথ্যা। ক্রসফায়ার মিথ্যা, গুম মিথ্যা, লিমনের যে একটা পা নেই, সেটিও মিথ্যা। দেশের সব মানুষ খালি সারাদিন মিথ্যা বলছে। আর একমাত্র সত্যবাদী, সততার পরাকাষ্ঠা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন।
ভাগ্যিস মঙ্গলবার জগন্নাথে ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা যে দা হাতে কোপাকুপি করেছে, সেটিকেও মিথ্যা দাবি করে বসেননি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। করলে করতেও পারতেন। তার পক্ষে তো কিছুই অসম্ভব না। অন্তত সে প্রমাণ তিনি ঢের রেখেছেন।
ঢাকা শহরে কামাল মজুমদার নামের একজন এমপি যে সবার চোখের সামনে একজন নারী সাংবাদিকের গায়ে হাত তুলেছিলেন, তাকে কী গ্রেফতার করা হয়েছিল? ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা কি করে শুধুই বেপরোয়া হওয়ায় স্পর্ধা-আস্কারা পায়, তা কি ভেবে দেখার দায়দায়িত্ব সরকার তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়? আইন যে তার কাছে সমান নয় তা কি এই একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট নয়? উল্টো সারাদিন নানা সত্যকে মিথ্যা মিথ্যা বলে চিল্লালে দেশভর্তি মিথ্যাবাদী ভোটাররাই কী ভোট দিয়ে এই সরকারকে, এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল? ইনাদের আগামীতে ভোট করতে কি দেশের পাবলিকের ভোট লাগবে না? পাবলিককে সারাদিন ডাঁহা মিথ্যাবাদী বলে গেলে অথবা তাদের সঙ্গে বিরামহীন মিথ্যা বলতে থাকলে পাবলিকের উনাদের ব্ল্যাঙ্কচেক ভোট দিয়ে যেতে কোনো দায় পড়েছে? একটা অসম্ভব জনপ্রিয় একটি দল চোখের সামনে কি করে জনপ্রিয়তা হারাল এবং হারাচ্ছে তা আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ইনাদের শেয়ার বাজারের পরিস্থিতিতে কিছু যায় আসে না, সীমান্তে দেশের মানুষকে ন্যাঙটা করে পিটালেও না।
ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডাদের সন্ত্রাস নিয়ে আমরা লিখেই চলেছি। সরকারি লোকজনের এসব নিয়ে কোনো বিকার-প্রতিক্রিয়া নেই! সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওবায়দুল কাদের আগে মাঝে মাঝে যা একটু সত্য বলতেন, তাও এখন বন্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের এমন দাওয়াই দিয়েছেন যে, মন্ত্রিত্ব পেয়ে তাদেরও মুখ বন্ধ। যেন আগে মন্ত্রিত্ব না পাবার রাগে-দু:খে তারা এমনসব ভাল ভাল কথা বলতেন! মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন ভাল কথার দুই বাপজান। প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে আরও যাদের মন্ত্রী হবার আশা তাদের মুখও বন্ধ। যে দেবতা যে ভোগে সন্তুষ্ট! কিন্তু দেশের মানুষের চোখ-মুখ বন্ধ করবে কে? ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা এই ক’দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জুবায়ের নামের এক কর্মীকে জিআই পাইপ দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। এখন পর্যন্ত অশান্ত জাবি ক্যাম্পাস। শিক্ষকরা ক্লাস বাদ দিয়ে কাফনের কাপড় পরে মিছিল করছেন। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এদের কারোরই এ নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমদ জাবির সাবেক উপাচার্য। তার মুখেও এসব নিয়ে কোনও রা নেই! জুবায়ের হত্যার পর সেখানে উপাচার্য গ্রুপ নামের ছাত্রলীগ নামধারী একদল গুন্ডার কথা জানা গেল। এ গ্রুপের গুন্ডারা জুবায়েরকে হত্যা করেছে। কিন্তু যেখানে একজন শিক্ষক নামধারী ব্যক্তির উপাচার্যগিরি করতে এ ধরনের একটা গুন্ডাবাহিনী পোষা লাগে, তাকে সেখানে গদিনশীন রেখে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করে বিদ্যা শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ আশা করা যায়, এ প্রশ্ন আমরা রেখেছি আগে। কিন্তু কেউ শোনেননি। জাবির একাডেমিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হচ্ছে না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে উন্নয়ন ফির নামে বাড়তি টাকা আদায় প্রতিরোধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করলে পুলিশের পাশাপাশি তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী একদল গুন্ডা। আক্রান্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তখন অভিযোগ করে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের মেরে-কুটে আন্দোলন নস্যাৎ করতে ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা ভাড়া করেছে। দায়িত্বশীলদের কেউ তাদের অভিযোগে তখন গা করেননি। কিন্তু ওই সময়ই দেখা গেল ক্যান্টিনে ফাও খাওয়ার দাবি নিয়ে এসব গুন্ডারা ক্যান্টিন ভাঙচুর, ক্যান্টিন ম্যানেজারকে মারধর করল। তখন অনেকে মজা করে বললেন, গুন্ডা ভাড়া করলে তো তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা করেনি বলে ফ্রি খাওয়াদাওয়ার দাবিতে তারা একটু হৈচৈ করেছে তো, এমন কি আর খারাপ করেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর যারা জানেন, তারা বলছেন সেখানে ছাত্রলীগ নামধারী গুন্ডারা যে এমন তেড়েবেড়ে উঠেছে, এখন এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দা হাতে কোপাতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এর পুরো দায়দায়িত্ব সেখানকার মেরুদণ্ডহীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুরনো ঢাকার পুরনো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গত দুই-আড়াই যুগে কখনোই ছাত্রলীগের আধিপত্য ছিল না। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে চলে গেলে ছাত্রলীগ নামধারী এসব গুন্ডা ছাত্রলীগে থাকে না। ছাত্রদল বা ছাত্রসমাজ হয়ে যায়। আওয়ামী আগামীতে বিরোধী দলে চলে গেলেও এদের একটিও থাকবে না। এখন দলকে ডোবাতে যা যা করার দরকার সব এই তস্কররা করছে। এখন গুন্ডামির জন্য ছাত্রলীগ যাদের বহিষ্কার করেছে অন্তত তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করবে কর্তৃপক্ষ? এসব দা মার্কা গুন্ডা-সন্ত্রাসীকে রেখে কি সেখানে পড়াশুনার স্বাভাবিক পরিবেশ সম্ভব? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মেরুদণ্ডের জোর দেখা যাক।
দেশে আমরা হিযবুত তাহরীর নামের নিষিদ্ধ মোল্লা সংগঠন, যুদ্ধাপরাধীদের আন্ডাবাচ্চা সংগঠন রগকাটা শিবিরের বিরুদ্ধে বলছি-লিখছি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কোনোদিন সেশনজট জমতে পারেনি, গোলাম আযমের মতো যুদ্ধাপরাধী নাম্বার ওয়ানের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে শিবির সেখানে কি ত্রাসের সৃষ্টি করে রেখেছে তা সবাই ওয়াকিফহাল আছেন। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ছাত্রলীগ কি করছে? এটির এখন কী চেহারা? ছাত্রলীগ নামধারী ঐতিহ্যের সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃ্ত্বের ব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্য হারিয়ে কি প্রকারে আদর্শ-লক্ষ্যহীন সন্ত্রাসীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, এটি দেশের সব মানুষ দেখছেন। দেশ শাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণের সামর্থ থাকবে না, সমস্যা কোথায়, এসব বারবার বলেও নিরুত্তর শাসকদল! এটির কাজ কি শুধু শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফর আর ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির খুশিতে মিছিল আর বছরের বাকিসময় গুন্ডামি-চাঁদাবাজি করা? এমন কী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রগতিশীল সংগঠন বা স্বাধীন ব্লগারদের যে ভূমিকা আছে এর বিন্দুবিসর্গও ছাত্রলীগের আছে কি? না তাদের সে সময় আছে? চাঁদাবাজি আর গুন্ডামি, ছাত্রলীগ নামধারীদের এসব নয়া কর্মসূচি ঠিক করে দিয়েছে কে? এর উত্তর আওয়ামী নেতৃ্ত্বকে দিতে হবে। মুখ বন্ধ করে থাকলে কি পাবলিকের মুখ বন্ধ আছে? মানুষ কিন্তু ক্ষেপে আছে।
গুন্ডামিতে দেখলে পুলিশ যদি সবাইকে ধরে আর ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের ধরা এড়িয়ে চলে তাহলে কিন্তু ধৈর্যের বাঁধভাঙ্গা ধরাধরি শুরু করে দিলে কিন্তু তাদের থামানো যাবে না। পাবলিক কখন ক্ষেপে আর ক্ষেপে গেলে কি করে তা নিশ্চয় আওয়ামী লীগের মতো দলকে কারও গ্রামার বই হাতে নিয়ে ধরে ধরে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
No comments